ETV Bharat / bharat

বছরের পর বছর ধরে বন্যার বিরুদ্ধে লড়ছে বিহার

এ'বছর নতুন রেকর্ড করেছে । এবছরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বিহারের 20টি জেলা এবং চারটি জেলা আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ।

Bihar floods
Bihar floods
author img

By

Published : Aug 28, 2020, 9:21 PM IST

পটনা, 28 অগাস্ট : বিগত 40 বছর ধরে প্রতি বছর বন্যার সম্মুখীন হচ্ছে বিহার । বিহার সরকারের জলসম্পদ বিভাগের মতে, রাজ্যের 68 হাজার 800 বর্গকিলোমিটার এলাকা বন্যায় ডুবে গিয়েছে এবং প্রতি বছর 12টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয় । তবে, এ'বছর নতুন রেকর্ড করেছে । এবছরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বিহারের 20টি জেলা এবং চারটি জেলা আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । রাজ্যের 38টির মধ্যে 24টি জেলায় বন্যার জেরে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে ।

প্রত্যেক বছর বন্যার সময় বিহারের দুর্দশা নিয়ে বিতর্ক হয়, আশা উত্থাপিত হয়, কিন্তু, শেষ অবধি, পটনা থেকে দিল্লি পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফাইলের বাক্সে সমস্ত কিছুই হারিয়ে যায় । তবু একদিন এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে এবং বন্যা মোকাবিলা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে - এই আশায় বুক বাঁধেন বিহারের মানুষ । কিন্তু, শেষমেশ যা হয় তা এক ধরণের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছুই নয় । বাস্তবে, বন্যার মুখোমুখি হয়ে অনুশোচনা এবং নিজেদের অভিশাপ দিতে বাধ্য হয় বিহারবাসী ।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা

বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থার বিষয়ে বিশদে বলতে গেলে, 1954 সালে বিহারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল ছিল 25 লাখ হেক্টর, সেখানে 160 কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ ছিল । 2020 সালে, 73.01 লাখ হেক্টর অঞ্চল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বাঁধের দৈর্ঘ্য বেড়েছে মাত্র 700 কিলোমিটার । আসলে, বিহারে যেভাবে বন্যার প্রকোপ বেড়েছে, তা নিয়ন্ত্রণের সমস্ত প্রচেষ্টাই অপ্রতুল প্রমাণিত হয়েছে । তবে, কোসি নদীই বিহারে বন্যার একমাত্র কারণ, একথা বলা যায় না । সন্দেহ নেই যে, বিহারে কোসি নদীটি যে অঞ্চলে প্রবাহিত হয় সেই অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি করে, তবে এর পাশাপাশি অন্যান্য কারণও রয়েছে যা প্রতিবছর বন্যার সৃষ্টি করে ।অনুমান, কোসি নদীর জল পেয়েছে 74,030 বর্গকিলোমিটার যার মধ্যে 62 হাজার 20 বর্গকিলোমিটার নেপাল এবং তিব্বতে রয়েছে । বিহারে রয়েছে মাত্র 11 হাজার 410 বর্গকিলোমিটার এলাকা । বলা বাহুল্য, প্রকৃতির ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার করাও রাজ্যে বন্যার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । বনাঞ্চলের নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা যার মধ্যে অন্যতম । নেপাল এবং ভারতের মধ্যে একটি চুক্তির পরে 1956 সালে কোসি নদীর বাঁধটি নির্মিত হয়েছিল । চুক্তি অনুসারে, যদি নেপালের কোসি নদীতে আরও বেশি জল জমে থাকে তবে, দেশটির বাঁধ খুলে দেওয়ার অধিকার রয়েছে, যা বিহারে বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।

পলি জমে থাকাও বিপর্যয়ের একটি বড় কারণ

নদীগুলিতে পলি জমে থাকা বন্যার আরও বড় কারণ । বিহারে, গঙ্গা নদী অন্যান্য বিভিন্ন উৎস থেকে সর্বাধিক জল পায় । কমপক্ষে, গঙ্গার 35টি শাখানদী এই রাজ্যের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে । এই নদীগুলি কেবল জলই নয়, পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে পলিও বয়ে নিয়ে আসে । এই সিল্টগুলি কেবল নদীর প্রবাহ এবং দিককেই ব্যাহত করে না, জল সংরক্ষণের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটিকেও প্রভাবিত করে । এই সমস্যা সমাধানের জন্য অনেকগুলি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল তবে তা সার্থক হয়নি । প্রধানমন্ত্রী অটলবিহার বাজপেয়ি এবং কেন্দ্রীয় নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শত্রুঘ্ন সিনহার আমলে গঙ্গা থেকে পলি অপসারণের জন্য কিছু প্রচেষ্টা করা হয়েছিল । যদিও এই প্রচেষ্টাগুলি ব্যর্থ হয় ।

কোসি ট্র্যাজেডি নিয়ে আলোচনা হলেও কোনও সমাধান হয়নি

কোসি নদীতে বিধ্বংসী বন্যার পর, বিহারের বন্যা মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, কিন্তু এই প্রকল্পগুলির কোনওটিই সুস্পষ্ট আকার নেয়নি । 2016 সালে, মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার এই বন্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন । সামগ্রিকভাবে সমস্যাটি বোঝার জন্য এবং আলোচনার জন্য বিমান সমীক্ষাও চালানো হয় । তবে সবকিছুই অফিসিয়াল ফাইলগুলিতেই আটকে থাকে এবং তারপর আর কিছুই করা হয়নি ।বলা বাহুল্য, বিহারে বন্যার সমস্যা এবং এর সম্ভাব্য সমাধান সম্পর্কে আলোচনার কোনও অভাব নেই, তবে আলোচনাকে এগিয়ে নেওয়ার সময় রাজনীতিতেই সবকিছু হারাতে বসেছে । উত্তর বিহার থেকে দক্ষিণ বিহারে জল নেওয়ার জন্য বহুবার আলোচনা হয়েছে যাতে রাজ্যের এক অংশে বন্যার সমস্যা এবং অন্য অংশে খরার সমস্যা সমাধান করা যায় । রাজ্যের সমস্ত নদীগুলির সংযোগ স্থাপনের জন্য নির্মিত সমস্ত প্রকল্পগুলি শুরুর আগেই বাতিল করা হয় ।

বুড়ি গণ্ডক-নুন-বায়া-গঙ্গা সংযোগ

2014-র 2 মে একটি বিস্তারিত প্রকল্পের প্রতিবেদন (DPR) জমা দেওয়া হয় । সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী 71 কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্য দিয়ে বুড়ি গণ্ডক নদীর জল নুন ও বায়া নদীর মধ্য দিয়ে গঙ্গায় প্রবাহিত করানোর কথা বলা হয় । এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল বৈশালী, সমতিপুর এবং মুজফফরপুর জেলাকে প্রতি বছর বন্যার হাত থেকে বাঁচানো । আরও বলা হয়েছিল, এই প্রকল্পটি সম্পূর্ণ হলে এই প্রকল্পটি 2 লাখ 14 হাজার হেক্টর জমির সেচ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে । 2014 সালে প্রকল্পটির আনুমানিক ব্যয় ছিল 4213.8 কোটি টাকা, যা এখন বেড়ে 6,500 কোটি টাকা হয়েছে ।

কোসি-মেচি সংযোগ

2014-র 2 মে কোসি-মেচি সংযোগের জন্য DPR জমা দেওয়া হয়েছিল, যার অধীনে একটি 120.15 কিলোমিটার দীর্ঘ খাল নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয় । কোসি অববাহিকার জল মেচি সংযোগ থেকে মহানন্দা অববাহিকায় আনা হবে, যার ফলে 2 লক্ষ 14 হাজার হেক্টরের বেশি জমি সেচের সুবিধা পাবে । এর ফলে সুপল, সাহারসা, আরারিয়া, কিশানগঞ্জ ও পূর্ণিয়া জেলা উপকৃত হবে বলে আশা করা হয় । এর আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় 5 হাজার কোটি টাকা, যা এখন বেড়ে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা হওয়ার কথা ।

সাকরি-নাতা সংযোগ প্রকল্প

সাকরি নাতা লিঙ্ক প্রকল্পের DPR 30 মে, 2014-এ জমা দেওয়া হয়েছিল, যার অধীনে 20 কিলোমিটার দীর্ঘ খাল নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল । নওয়াদা, নালন্দা এবং আশেপাশের অঞ্চলগুলি এই প্রকল্পের মাধ্যমে উপকৃত হতে পারে বলে আশা করা হয় । এছাড়া 68 হাজার 808 হেক্টর জমিতে সেচের সম্ভাবনা তৈরির কথা বলা হয় । যখন DPR হস্তান্তরিত হয়েছিল তখন এর ব্যয় ছিল 572.38 কোটি টাকা, যা এখন বাড়িয়ে 1,200 কোটি টাকা হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে ।

ভোটের আগে প্রতিশ্রুতি

ভোটের আগে বিহারে ফের প্রতিশ্রুতির বন্যা বইছে । সিংহাসনের লোভে জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতির কথা প্রচার করা হচ্ছে, তবে কীভাবে বিহারকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করা যায় সে বিষয়ে সরকারের কোনও নীতি ও পরিকল্পনা নেই । প্রত্যেকেই মনে করেন, দুটি ইঞ্জিন নিয়ে পরিচালিত বিহার সরকার উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে পারছে না । বিহারের বন্যার সমস্যা সমাধানে যা কিছু করা দরকার তা রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারকেই করতে হবে । উভয় সরকারই বন্যার্তদের দুর্দশার বিষয়ে উদ্বিগ্ন ।

বন্যা নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা :

* নদীর ভাঙন রোধে যাতে নদীর প্রবাহিত অঞ্চলে পলি ভরে না যায়, তার জন্য সর্বাধিক বোল্ডার পিচিং করা উচিত ।

* বন্যার সময় জলের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে ।

* নদী-সংযোগ প্রকল্পগুলিকে বিভিন্ন বিভাগ এবং মন্ত্রকের রাজনীতি থেকে মুক্তি দিয়ে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ।

* নদীর জলাবদ্ধতা ক্ষেত্রগুলি দেখাশোনা করার জন্য একটি পৃথক নীতি তৈরি করতে হবে ।

* ভাঙন এড়ানোর জন্য, সমস্ত কাজ সময়মতো সম্পন্ন করা উচিত যাতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায় ।

ETV বিহার এই বছর রাজ্যের বন্যা সম্পর্কে জেলা থেকে গ্রামের ছবি তুলে ধরেছে । প্রত্যেকে বন্যায় ভীত এবং প্রত্যেকেরই প্রশ্ন, কেন বিহারকে স্থায়ীভাবে বন্যার হাত থেকে মুক্ত করার পরিকল্পনা নেই ? বিহারের বন্যার সমস্যা যাচাই করে এমন কিছু কেন করা হচ্ছে না যাতে বিহারের মানুষকে প্রতিবার বাড়ি বদল করতে না হয় এবং যাযাবরের জীবনযাপন করতে না হয় ?

সরকারের কোনও নীতি নেই কেন ?

সরকার কেন বিহারের বন্যার সমস্যা সম্পর্কে নীতি তৈরি করে না ? প্রশ্ন বহুদিনের । এই বছর বিধানসভা নির্বাচনের পর বিহার নতুন সরকার গঠন করতে চলেছে । নির্বাচনের সময় যারা জনগণের কাছে ঝুড়ি-ঝুড়ি প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে তাদের জিজ্ঞাসা করা দরকার, বিহার কবে বন্যার হাত থেকে মুক্তি পাবে ? এই প্রশ্নটি কেবলমাত্র দু'টি ইঞ্জিনের সরকারকে নয়, যারা আগে ক্ষমতায় ছিল তাদেরও করা উচিত ।রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে, বিহারে বন্যা নিয়ন্ত্রণ না করা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে । 1979 সালে বিহারে মাত্র 25 লাখ হেক্টর জমি বন্যা কবলিত হয়েছিল যা এখন 73 লাখ হেক্টর জমিতে পৌঁছেছে । উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি কোনও আকার নাও নিতে পারে, তবে বন্যা প্রতিবছর তার ধ্বংসের ক্ষেত্রটি বাড়িয়েছে । এজন্য সরকারকে কঠোর ও বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে । তবেই বিহারের মানুষ নদী ও বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে মুক্তি পাবে । এই বন্যাই বিহারের উন্নয়নকে প্রভাবিত করছে ।

পটনা, 28 অগাস্ট : বিগত 40 বছর ধরে প্রতি বছর বন্যার সম্মুখীন হচ্ছে বিহার । বিহার সরকারের জলসম্পদ বিভাগের মতে, রাজ্যের 68 হাজার 800 বর্গকিলোমিটার এলাকা বন্যায় ডুবে গিয়েছে এবং প্রতি বছর 12টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয় । তবে, এ'বছর নতুন রেকর্ড করেছে । এবছরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বিহারের 20টি জেলা এবং চারটি জেলা আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । রাজ্যের 38টির মধ্যে 24টি জেলায় বন্যার জেরে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে ।

প্রত্যেক বছর বন্যার সময় বিহারের দুর্দশা নিয়ে বিতর্ক হয়, আশা উত্থাপিত হয়, কিন্তু, শেষ অবধি, পটনা থেকে দিল্লি পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফাইলের বাক্সে সমস্ত কিছুই হারিয়ে যায় । তবু একদিন এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে এবং বন্যা মোকাবিলা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে - এই আশায় বুক বাঁধেন বিহারের মানুষ । কিন্তু, শেষমেশ যা হয় তা এক ধরণের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছুই নয় । বাস্তবে, বন্যার মুখোমুখি হয়ে অনুশোচনা এবং নিজেদের অভিশাপ দিতে বাধ্য হয় বিহারবাসী ।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা

বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থার বিষয়ে বিশদে বলতে গেলে, 1954 সালে বিহারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল ছিল 25 লাখ হেক্টর, সেখানে 160 কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ ছিল । 2020 সালে, 73.01 লাখ হেক্টর অঞ্চল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বাঁধের দৈর্ঘ্য বেড়েছে মাত্র 700 কিলোমিটার । আসলে, বিহারে যেভাবে বন্যার প্রকোপ বেড়েছে, তা নিয়ন্ত্রণের সমস্ত প্রচেষ্টাই অপ্রতুল প্রমাণিত হয়েছে । তবে, কোসি নদীই বিহারে বন্যার একমাত্র কারণ, একথা বলা যায় না । সন্দেহ নেই যে, বিহারে কোসি নদীটি যে অঞ্চলে প্রবাহিত হয় সেই অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি করে, তবে এর পাশাপাশি অন্যান্য কারণও রয়েছে যা প্রতিবছর বন্যার সৃষ্টি করে ।অনুমান, কোসি নদীর জল পেয়েছে 74,030 বর্গকিলোমিটার যার মধ্যে 62 হাজার 20 বর্গকিলোমিটার নেপাল এবং তিব্বতে রয়েছে । বিহারে রয়েছে মাত্র 11 হাজার 410 বর্গকিলোমিটার এলাকা । বলা বাহুল্য, প্রকৃতির ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার করাও রাজ্যে বন্যার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । বনাঞ্চলের নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা যার মধ্যে অন্যতম । নেপাল এবং ভারতের মধ্যে একটি চুক্তির পরে 1956 সালে কোসি নদীর বাঁধটি নির্মিত হয়েছিল । চুক্তি অনুসারে, যদি নেপালের কোসি নদীতে আরও বেশি জল জমে থাকে তবে, দেশটির বাঁধ খুলে দেওয়ার অধিকার রয়েছে, যা বিহারে বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।

পলি জমে থাকাও বিপর্যয়ের একটি বড় কারণ

নদীগুলিতে পলি জমে থাকা বন্যার আরও বড় কারণ । বিহারে, গঙ্গা নদী অন্যান্য বিভিন্ন উৎস থেকে সর্বাধিক জল পায় । কমপক্ষে, গঙ্গার 35টি শাখানদী এই রাজ্যের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে । এই নদীগুলি কেবল জলই নয়, পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে পলিও বয়ে নিয়ে আসে । এই সিল্টগুলি কেবল নদীর প্রবাহ এবং দিককেই ব্যাহত করে না, জল সংরক্ষণের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটিকেও প্রভাবিত করে । এই সমস্যা সমাধানের জন্য অনেকগুলি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল তবে তা সার্থক হয়নি । প্রধানমন্ত্রী অটলবিহার বাজপেয়ি এবং কেন্দ্রীয় নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শত্রুঘ্ন সিনহার আমলে গঙ্গা থেকে পলি অপসারণের জন্য কিছু প্রচেষ্টা করা হয়েছিল । যদিও এই প্রচেষ্টাগুলি ব্যর্থ হয় ।

কোসি ট্র্যাজেডি নিয়ে আলোচনা হলেও কোনও সমাধান হয়নি

কোসি নদীতে বিধ্বংসী বন্যার পর, বিহারের বন্যা মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, কিন্তু এই প্রকল্পগুলির কোনওটিই সুস্পষ্ট আকার নেয়নি । 2016 সালে, মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার এই বন্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন । সামগ্রিকভাবে সমস্যাটি বোঝার জন্য এবং আলোচনার জন্য বিমান সমীক্ষাও চালানো হয় । তবে সবকিছুই অফিসিয়াল ফাইলগুলিতেই আটকে থাকে এবং তারপর আর কিছুই করা হয়নি ।বলা বাহুল্য, বিহারে বন্যার সমস্যা এবং এর সম্ভাব্য সমাধান সম্পর্কে আলোচনার কোনও অভাব নেই, তবে আলোচনাকে এগিয়ে নেওয়ার সময় রাজনীতিতেই সবকিছু হারাতে বসেছে । উত্তর বিহার থেকে দক্ষিণ বিহারে জল নেওয়ার জন্য বহুবার আলোচনা হয়েছে যাতে রাজ্যের এক অংশে বন্যার সমস্যা এবং অন্য অংশে খরার সমস্যা সমাধান করা যায় । রাজ্যের সমস্ত নদীগুলির সংযোগ স্থাপনের জন্য নির্মিত সমস্ত প্রকল্পগুলি শুরুর আগেই বাতিল করা হয় ।

বুড়ি গণ্ডক-নুন-বায়া-গঙ্গা সংযোগ

2014-র 2 মে একটি বিস্তারিত প্রকল্পের প্রতিবেদন (DPR) জমা দেওয়া হয় । সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী 71 কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্য দিয়ে বুড়ি গণ্ডক নদীর জল নুন ও বায়া নদীর মধ্য দিয়ে গঙ্গায় প্রবাহিত করানোর কথা বলা হয় । এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল বৈশালী, সমতিপুর এবং মুজফফরপুর জেলাকে প্রতি বছর বন্যার হাত থেকে বাঁচানো । আরও বলা হয়েছিল, এই প্রকল্পটি সম্পূর্ণ হলে এই প্রকল্পটি 2 লাখ 14 হাজার হেক্টর জমির সেচ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে । 2014 সালে প্রকল্পটির আনুমানিক ব্যয় ছিল 4213.8 কোটি টাকা, যা এখন বেড়ে 6,500 কোটি টাকা হয়েছে ।

কোসি-মেচি সংযোগ

2014-র 2 মে কোসি-মেচি সংযোগের জন্য DPR জমা দেওয়া হয়েছিল, যার অধীনে একটি 120.15 কিলোমিটার দীর্ঘ খাল নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয় । কোসি অববাহিকার জল মেচি সংযোগ থেকে মহানন্দা অববাহিকায় আনা হবে, যার ফলে 2 লক্ষ 14 হাজার হেক্টরের বেশি জমি সেচের সুবিধা পাবে । এর ফলে সুপল, সাহারসা, আরারিয়া, কিশানগঞ্জ ও পূর্ণিয়া জেলা উপকৃত হবে বলে আশা করা হয় । এর আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় 5 হাজার কোটি টাকা, যা এখন বেড়ে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা হওয়ার কথা ।

সাকরি-নাতা সংযোগ প্রকল্প

সাকরি নাতা লিঙ্ক প্রকল্পের DPR 30 মে, 2014-এ জমা দেওয়া হয়েছিল, যার অধীনে 20 কিলোমিটার দীর্ঘ খাল নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল । নওয়াদা, নালন্দা এবং আশেপাশের অঞ্চলগুলি এই প্রকল্পের মাধ্যমে উপকৃত হতে পারে বলে আশা করা হয় । এছাড়া 68 হাজার 808 হেক্টর জমিতে সেচের সম্ভাবনা তৈরির কথা বলা হয় । যখন DPR হস্তান্তরিত হয়েছিল তখন এর ব্যয় ছিল 572.38 কোটি টাকা, যা এখন বাড়িয়ে 1,200 কোটি টাকা হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে ।

ভোটের আগে প্রতিশ্রুতি

ভোটের আগে বিহারে ফের প্রতিশ্রুতির বন্যা বইছে । সিংহাসনের লোভে জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতির কথা প্রচার করা হচ্ছে, তবে কীভাবে বিহারকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করা যায় সে বিষয়ে সরকারের কোনও নীতি ও পরিকল্পনা নেই । প্রত্যেকেই মনে করেন, দুটি ইঞ্জিন নিয়ে পরিচালিত বিহার সরকার উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে পারছে না । বিহারের বন্যার সমস্যা সমাধানে যা কিছু করা দরকার তা রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারকেই করতে হবে । উভয় সরকারই বন্যার্তদের দুর্দশার বিষয়ে উদ্বিগ্ন ।

বন্যা নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা :

* নদীর ভাঙন রোধে যাতে নদীর প্রবাহিত অঞ্চলে পলি ভরে না যায়, তার জন্য সর্বাধিক বোল্ডার পিচিং করা উচিত ।

* বন্যার সময় জলের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে ।

* নদী-সংযোগ প্রকল্পগুলিকে বিভিন্ন বিভাগ এবং মন্ত্রকের রাজনীতি থেকে মুক্তি দিয়ে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ।

* নদীর জলাবদ্ধতা ক্ষেত্রগুলি দেখাশোনা করার জন্য একটি পৃথক নীতি তৈরি করতে হবে ।

* ভাঙন এড়ানোর জন্য, সমস্ত কাজ সময়মতো সম্পন্ন করা উচিত যাতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায় ।

ETV বিহার এই বছর রাজ্যের বন্যা সম্পর্কে জেলা থেকে গ্রামের ছবি তুলে ধরেছে । প্রত্যেকে বন্যায় ভীত এবং প্রত্যেকেরই প্রশ্ন, কেন বিহারকে স্থায়ীভাবে বন্যার হাত থেকে মুক্ত করার পরিকল্পনা নেই ? বিহারের বন্যার সমস্যা যাচাই করে এমন কিছু কেন করা হচ্ছে না যাতে বিহারের মানুষকে প্রতিবার বাড়ি বদল করতে না হয় এবং যাযাবরের জীবনযাপন করতে না হয় ?

সরকারের কোনও নীতি নেই কেন ?

সরকার কেন বিহারের বন্যার সমস্যা সম্পর্কে নীতি তৈরি করে না ? প্রশ্ন বহুদিনের । এই বছর বিধানসভা নির্বাচনের পর বিহার নতুন সরকার গঠন করতে চলেছে । নির্বাচনের সময় যারা জনগণের কাছে ঝুড়ি-ঝুড়ি প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে তাদের জিজ্ঞাসা করা দরকার, বিহার কবে বন্যার হাত থেকে মুক্তি পাবে ? এই প্রশ্নটি কেবলমাত্র দু'টি ইঞ্জিনের সরকারকে নয়, যারা আগে ক্ষমতায় ছিল তাদেরও করা উচিত ।রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে, বিহারে বন্যা নিয়ন্ত্রণ না করা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে । 1979 সালে বিহারে মাত্র 25 লাখ হেক্টর জমি বন্যা কবলিত হয়েছিল যা এখন 73 লাখ হেক্টর জমিতে পৌঁছেছে । উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি কোনও আকার নাও নিতে পারে, তবে বন্যা প্রতিবছর তার ধ্বংসের ক্ষেত্রটি বাড়িয়েছে । এজন্য সরকারকে কঠোর ও বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে । তবেই বিহারের মানুষ নদী ও বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে মুক্তি পাবে । এই বন্যাই বিহারের উন্নয়নকে প্রভাবিত করছে ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.