কলকাতা, 12 অগস্ট: নানা ধর্ম ও সম্প্রদায়ের দেশ ভারতে রয়েছে হাজারো ঐতিহ্য, রীতি, রেওয়াজ ৷ কখনও ফসল কাটার আনন্দে মেতে ওঠে গোটা সমাজ ৷ আবার কখনও প্রিয়জনের বিয়োগে ঈশ্বরকে অর্পণ করা হয় মাথার চুল ৷ কখনও বা নৃত্যশৈলীতে মিশে যায় লড়াইয়ের ভঙ্গি ! স্বাধীনতার 75 বছর পূর্তি উপলক্ষে (75 Years of Independence) এমনই কয়েকটি সংস্কৃতির কথা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম আমরা ৷
ভারতের সর্বজনীন এবং প্রাচীন ঐতিহ্যগুলির মধ্যে অন্যতম, মুণ্ডন প্রথা (Mundan Ceremony) ৷ শিশুর জন্মের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার মাথার প্রথম চুল সম্পূর্ণ কামিয়ে ফেলা হয় ৷ কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা উৎসর্গ করা হয় আরাধ্য দেবতা বা দেবীকে ৷ আবার কখনও শিশুর মাথা কামানোর পর নিয়ম মাফিক কিছু ধর্মীয় আচার পালন করা হয় ৷ হিন্দু পরিবারে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় শিশুর জন্মের চারমাস থেকে তিন বছরের মধ্যে ৷ অন্যদিকে, মুসলিম পরিবারগুলি একই ঐতিহ্য পালনে সামিল হয় শিশুর জন্মের 40 থেকে 47 দিনের মধ্যে ৷ ভারতের প্রায় সর্বত্রই মস্তক মুণ্ডনের এই ধারা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে ৷
শিশুর মাথা কামানোর পর বেশ কিছু পুজার্চনা করার রীতি রয়েছে হিন্দু পরিবারগুলিতে ৷ এর পিছনে শতাব্দীপ্রাচীন একটি ধারণা রয়েছে ৷ হিন্দুরা মনে করেন, শিশু তার প্রথম চুল পায় পূর্বজন্ম থেকে ৷ তাই সেই চুল মাথায় থেকে গেলে শিশুর মনে পূর্বজন্মের স্মৃতি অক্ষত থেকে যায় ৷ এর ফলে বর্তমান জীবনে ওই শিশুকে কষ্ট পেতে হয় ৷ সেই কষ্টের হাত থেকে মুক্তি দিতেই শিশুর মাথার প্রথম চুল ফেলে দেওয়া হয় ৷ লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, হিন্দু এবং মুসলিম, দু'টি ক্ষেত্রেই মস্তক মুণ্ডনের পর শিশুকে ভালো করে স্নান করানো হয় ৷
আরও পড়ুন: তাপি নদীতে স্বাধীনতার 75তম বর্ষপূর্তি পালন, দেখুন ভিডিয়ো
বাঙালি জাতি-সহ হিন্দুদের বিভিন্ন শাখা পুত্র এবং কন্যাসন্তানের জন্মের পর মস্তক মুণ্ডনের প্রথা পালন করে ৷ একইসঙ্গে সেরে ফেলা হয় তাদের মুখেভাত বা অন্নপ্রাশনের নিয়মও ৷ অনেক সময়েই কোনও মন্দির বা পবিত্র স্থানে এই প্রথা সারা হয় ৷ ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও শিশুর জন্মের পর একইভাবে তার মাথার প্রথম চুল ফেলে দেন ৷ শিখদের মধ্যেও প্রায় এই ধরনেরই একটি প্রথা চালু রয়েছে ৷ যাকে বলা হয়, 'কেশি দহি' ৷ এক্ষেত্রে সদ্যোজাতের চুলে দই মাখিয়ে দেওয়া হয় ৷
তবে, শুধুমাত্র শিশুর জন্মের পর নয়, অনেক ক্ষেত্রে মনোস্কামনা পূরণ হলেও মস্তক মুণ্ডন করা হয় ৷ স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে নানা বয়সের মানুষ এই প্রথা পালন করেন ৷ সাধারণত, কোনও ধর্মীয় স্থানে ক্ষৌরকারদের দিয়ে চুল কামানো হয় ৷ হিন্দু পুরুষরা মাথা মুণ্ডন করালেও অনেকেই মাথার পিছনে টিকি রেখে দেন ৷ বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের মধ্য়ে এই রেওয়াজ দেখা যায় ৷ ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তানদের উপনয়নের সময় মুণ্ডনের রীতিও প্রচলিত রয়েছে ৷ পাশাপাশি, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও বৌদ্ধ সন্ন্য়াসীরা সন্ন্যাস গ্রহণের পর মাথা কামিয়ে ফেলেন ৷ মাথা কামিয়ে টিকি রাখার চল রয়েছে বৈষ্ণবদের মধ্যেও ৷ এছাড়াও বাবা-মা বা সেই তুল্য কোনও নিকট আত্মীয়ের প্রয়াণেও মাথা কামানো হয় ৷ একটা সময় হিন্দু বিধবাদের মাথায় চুল রাখার অনুমতি ছিল না ৷ কঠোরভাবে পালন করা হত সেই আচার ৷ যদিও এখন আর সেই কড়াকড়ি নেই ৷
বৈচিত্রের দেশ ভারতে এমনই অনেক সংস্কৃতি রয়েছে ৷ যা নজর কাড়ে সারা বিশ্বের ৷ তেমনই দু'টি প্রাচীন সংস্কৃতি হল ছৌ (Chhau) এবং বিহু (Bihu) ৷ এর মধ্যে ছৌ-কে আপাতভাবে নৃত্যশৈলী হিসাবে ব্যাখ্যা করা হলেও এর তাৎপর্য অনেক গভীর ৷ বস্তুত, ছৌ হল একটা গোটা জীবনশৈলী ৷ এর সঙ্গে লোকশিল্প ও শাস্ত্রীয় ভারতীয় নৃত্যের যেমন যোগ রয়েছে, তেমনই সম্পর্ক রয়েছে মার্শাল আর্টের ৷ এর মূলত তিনটি ঘরানা রয়েছে ৷ এগুলি হল, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার ছৌ, ঝাড়খণ্ডের সেরাইকেল্লার ছৌ এবং ওডিশার ময়ূরভঞ্জের ছৌ ৷ তবে, ছৌ-এর সঙ্গে হিন্দু ধর্মের গভীর সম্পর্ক রয়েছে ৷ এর সঙ্গে মিশে রয়েছে শিব, শক্তি ও বিষ্ণুর আরাধনা ৷
বিহু বলতেও অনেকেই কেবলমাত্র একটি নৃত্যশেলীকেই বোঝেন ৷ কিন্তু, আদতে বিহু হল অসমের তিনটি প্রধান উৎসবের মিশেল ৷ এগুলি হল, রোঙ্গালি বা বোহাগ বিহু, কোঙ্গালি বা কাটি বিহু এবং ভোগালি বা মাঘ বিহু ৷ এই উৎসবগুলি যথাক্রমে এপ্রিল, অক্টোবর এবং জানুয়ারি মাসে পালন করা হয় ৷ এই তিনটির মধ্যে রোঙ্গালি বিহু সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ৷ যা আদতে অসমিয়াদের বসন্ত উৎসব ৷ ভোগালি বা মাঘ বিহু হল নবান্নের মতো ৷ ফসল কাটার মরশুমে এই উৎসব পালন করা হয় ৷ উলটোদিকে, কোঙ্গালি বা কাটি বিহু মিতব্যায় বা স্বল্প উৎপাদনের ঋতুকে প্রতিফলিত করে ৷