চিত্র-১
সাল 1952। 21 ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তানের শাসকদের পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লুটিয়ে পড়লেন তরতাজা সালাম-বরকত-জব্বর-শফিকুর। ওঁরা মাতৃভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে পাকিস্তানের শাসকদের বিরূদ্ধে গড়ে তুলেছিল প্রতিরোধ ।
চিত্র- ২
সাল 2021। 21 ফেব্রুয়ারি। ঢাকা শহরের অভিজাত ধানমন্ডি এলাকায় শহিদদের মুরাল পড়ে রয়েছে অযত্নে। কয়েক হাত দূরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবাসস্থল। আজ সংগ্রহশালা। '52 সালে পাকিস্তানের শাসক দ্বারা বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের উপর জোর করে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরূদ্ধে ছাত্র আন্দোলন একদিন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রূপান্তরিত হল। পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলার ঘরে ঘরে গড়ে উঠল দুর্গ। বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা-সমাজতন্ত্র হল স্বাধীন সোনার বাংলা গড়ার সোপান। সুফি ইসলাম হল জীবন দর্শন।
কবি অন্নদাশঙ্কর লিখেছিলেন- “যতদিন রবে পদ্মা-যমুনা-গৌরী-মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।” 1975 সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরে বাংলাদেশ এক অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি ।পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দিয়ে বহু স্রোত বয়ে গিয়েছে । সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আধুনিক বাংলাদেশ ফের এক সন্ধিক্ষণে। মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে একটা জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নজির বিশ্বে দ্বিতীয় নেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষ পালনের বর্ষে বাংলা ভাষার প্রতি কতটা যত্বশীল হয়েছেন বাঙালি--আজ একুশের দিনে সেই পর্যালোচনার সময়। বাংলা ভাষার মর্যাদার লড়াইয়ে শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে বাংলাদেশ আজ শহিদ দিবস রূপে পালন করে।
আরও পড়ুন : এখনও অনেক পথ চলতে হবে...
1999 সালে সে সময়ের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি ইউনেস্কোতে প্রথম প্রস্তাব পেশ করেন । তারপর ইউনেস্কো 21 ফেব্রুয়ারি আন্তজাতিক ভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। তার পরের বছর থেকে রাষ্ট্রসংঘ সেই প্রস্তাব স্বীকার করে। যে কারণে আজ সর্বত্র ভাষা দিবস উদযাপিত হয় । সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলির ভ্রাতুষ্পুত্র। দেশ ভাগের পর মুজতবা আলি পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান। 1947 সালের 30 নভেম্বর তিনি সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি প্রথম তোলেন। তারপর কলকাতার চতুরঙ্গ পত্রিকায় এক প্রবন্ধে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন। এ কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা তাঁর কাছ থেকে কৈফিয়ত দাবি করেন।
কেন তিনি উর্দু ভাষার বিরূদ্ধে প্রচার করছেন ?
মুজতবা আলি অধ্যাপনা থেকে ইস্তফা দিয়ে কলকাতা চলে আসেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে । বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে গান রচনা করেছিলেন সেই 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি' হবে জাতীয় সঙ্গীত । দেশ ভাগের সময়ে বঙ্গবন্ধু বাংলা দ্বিখন্ডিত হোক চাননি। তবুও হয়েছে । সেটা অন্য ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরে ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মেশানো নিষিদ্ধ করেছিলেন । তাঁর হত্যার পর সেনা আধিকারিকরা সেই প্রতিবন্ধকতা বিলোপ করেন। ধীরে ধীরে দক্ষিণপন্থী মৌলবাদীদের উত্থান হতে থাকে ।
গণ আন্দোলনের জেরে ফের বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটে। রাজনৈতিক লাভের কারণেই প্রথম বিএনপি-র খালেদা জিয়া পাকিস্তান পন্থী জামাত-এ ইসলামিদের শরিক করেন। এবং ঘোষণাও করেন, “এটা ভোটের জোট। যেহেতু তাদের সাত শতাংশ ভোট রয়েছে। এই জামাতরা কোনওদিনই স্বাধীনতা মেনে নেয়নি । খালেদা জিয়ার পরে শেখ হাসিনা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ভিত্তি মজবুত করে তোলেন। বিএনপি একেবারে কোণঠাসা । পর পর তিনবার সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই তত দিনে বাংলাদেশের ইসলামিক সমাজে এক পরিবর্তন এসেছে । জামাতরা নির্বাচনের জন্য নিষিদ্ধ হলেও নানা নামে ছাতার মত সংগঠন খুলে ফেলেছে । একাংশের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলেছে । এরা হল হেফাজত ইসলামি। জামাতদের বিরোধী। তবে সুফি ইসলামের প্রবর্তক নয় ।
আরও পড়ুন : একুশের বইমেলা ও ঢাকা
এক সময়ে এঁরা শেখ হাসিনাকে বলতেন নাস্তিক। ইসলাম বিরোধী। যে দিন শেখ হাসিনা এঁদের জমায়েতে হাজির হয়ে কার্যত সরকারি স্বীকৃতি দিলেন সেই দিন থেকে শেখ হাসিনা হয়ে গেলেন কমিউনিজ়ম । তার আগে থেকেই বাংলা ভাষায় উর্দুর প্রভাব বাড়তে থাকল । খোদা হাফিজ হয়ে গেল আল্লা হাফিজ । এর মূল কারণ মধ্য প্রাচ্যে ওয়াহাবি দর্শনের প্রভাব। কাশ্মীর এবং বাঙালি মুসলিম কখনই মধ্যপ্রাচ্য দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন না । এ-সবই অধুনিক ঘটনা।
এক সময়ে বাংলাদেশ থেকে কাজের সন্ধানে অনেকেই পাড়ি জমালেন মধ্যপ্রাচ্যে। এঁরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান ঘটালেন 'রেমিটেন্সের' মাধ্যমে । কেবল মাত্র পেট্রো-ডলারই নয়, এল মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সংস্কৃতি । যার সঙ্গে আউল-বাউল-লালন ফকিরের কোনও সম্পর্ক নেই। ধীরে ধীরে ভাষায় অনুপ্রবেশ করল সেই সংস্কৃতি। বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ ঘটল উর্দু-র । যার প্রতিবাদে স্বাধীনতার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। হেফাজতের আবদার এতই বাড়ল যে পাঠ্যপুস্তকে রবীন্দ্রনাথের ইসলাম বিরোধী রচনা বিলোপ করা হল।
আরও পড়ুন : বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘর
সুখের কথা গর্জে উঠল বাঙালি । শেখ হাসিনা এবার শক্ত হাতে হাল ধরলেন । বললেন- আর নয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লঘু হতে দেওয়া যাবে না। কিছুদিন আগেই এই প্রথম সুপ্রিম কোর্টের যাবতীয় রায় বাংলায় প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে । ভুল বাংলা বানান শুধরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে । এটাই স্বস্তির বিষয়। একুশে পালনের দিনে আজ সকলকে দিনটির মাহাত্ম বোঝার প্রয়োজন রয়েছে। না হলে ঘোর বিপদ। ভাষা না বাঁচলে জাতি বাঁচে না। বহু জাতির বিলোপ ঘটেছে ভাষার অপমৃত্যুর কারণে।
(লেখক প্রবীণ সাংবাদিক, প্রেস ক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি । মতামত লেখকের নিজস্ব।)