পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / state

ইংরেজ শাসকদের ঘুম কেড়েছিল চন্দননগরের বোমা ! এই ঘাতক অস্ত্রের স্রষ্টা কে জানেন? - INDEPENDENCE DAY 2024

Bombs Used in Indian Freedom Movement: চন্দননগরের বোমা ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল ইংরেজ শাসকদের ৷ একাধিক বিপ্লবী অত্যন্ত গোপনে তৈরি করতেন এই বোমা, যা স্বাধীনতা সংগ্রামের বড় অস্ত্র তৈরি হয়েছিল বিপ্লবীদের কাছে। ভারতের 78তম স্বাধীনতাদিবসে সেই ইতিহাসের পাতা উলটে দেখা হল চন্দননগরের বোমা তৈরির নানা অজানা কথা ৷

Chandannagar supplied bombs in India's freedom struggle
ইংরেজ শাসকদের ঘুম কেড়েছিল চন্দননগরের বোমা (ইটিভি ভারত)

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Aug 14, 2024, 9:39 PM IST

Updated : Aug 14, 2024, 9:54 PM IST

চন্দননগর, 14 অগস্ট: চন্দননগরের বোমা দিল্লির চাঁদনীচক কাঁপিয়েছিল । 1912 সালে রাজকীয় সম্বর্ধনার সময় ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ উপর বোমা হামলা হয়। তাতেই মৃত্যু হয় হাতির মাহুতের । আহত হন ভাইসরয় । ইংরেজ শাসকদের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল। সেই গাতক বোমা তৈরি হয়েছিল এই বাংলার চন্দননগরে ৷ সেই বোমার স্রষ্টা কে জানেন?

ইংরেজ শাসকদের ঘুম কেড়েছিল চন্দননগরের বোমা (ইটিভি ভারত)

ইতিহাস বলছে, সেই বোমা ছিল চন্দননগরের তৈরি। তার প্রধান স্রষ্টা ছিলেন বিপ্লবী মনীন্দ্রনাথ নায়েক। এছাড়াও, একাধিক বিপ্লবী অত্যন্ত গোপনে তৈরি করতেন এই বোমা, যা স্বাধীনতা সংগ্রামের বড় অস্ত্র তৈরি হয়েছিল বিপ্লবীদের কাছে। ব্রিটিশ সরকারকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল এই বোমা। এখান থেকেই বাংলা, পেশোয়ার, পঞ্জাব ও অসমে যেত বোমা। চন্দননগরে তার গন্ধ পেয়েছিলেন ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার চালর্স ট্রেগার্ড। কিন্তু, প্রবর্তক সঙ্ঘের বোমা তৈরি খবর পেয়েও কিছুই করতে পারেননি মনীন্দ্র নাথ ও মতিলালের । সেই সময় চারুচন্দ্র রায়, শ্রীশচন্দ্র ঘোষ, মতিলাল রায় ও রাসবিহারী বসুর মতো বিপ্লবীদের হাত ধরেই চন্দননগরে বিল্পবের আগুন জ্বলেছিল।

প্রবর্তক সঙ্ঘের বর্তমান কোষাধ্যক্ষ অমর নিয়োগী ছোট বেলায় বিপ্লবী মনীন্দ্র নাথের কাছে পড়াশোনা করতেন। তাঁর সানিধ্যে এসে নানা বিপ্লবের কথা শুনেছেন। মনিন্দ্রনাথের ইংরেজিতে লেখা নিজের আত্মজীবনী নিয়ে বাংলা বই তৈরি করেছিলেন অমর নিয়োগী। তাঁর স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে চন্দননগরে প্রথম বোমা কীভাবে তৈরি হয়েছিল। মনীন্দ্রনাথ, রাসবিহারী বসু, মতিলাল রায়, সাগরকালী দত্ত-সহ একাধিক বিপ্লবী কীভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, বাড়ির অন্দর মহলের মহিলারা কীভাবে বিপ্লবে সঙ্গ দিয়েছিল, তা উঠে এসেছে তাঁর স্মৃতিচারণায় । প্রবর্তকের অন্নপূর্ণা মন্দিরের বাড়িতে মতিলাল-সহ বিপ্লবীদের বোমা তৈরির কার্যকলাপ ধরে ফেলেও বিফল হয়েছিল ট্রেগার্ড সাহেব।

চন্দননগরের প্রবর্তক সঙ্ঘ (ইটিভি ভারত)

ভারতবর্ষের সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য মানিকতলা বাগানে অস্ত্রভাণ্ডার ধরা পড়ার পর নতুন করে অস্ত্রভাণ্ডার তৈরি করার প্রয়োজন হয়। আর সেই প্রয়োজন বা চাহিদা মিটিয়েছিলেন চন্দননগরের মনীন্দ্রনাথ নায়েক। তাঁর হাতেই তৈরি হয় একাধিক বোমা। তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন একাধিক বিপ্লবী এবং মতিলালের স্ত্রী রাধারানী দেবী ও সাগরকালী দত্তের স্ত্রী। পরবর্তীকালে বাংলায় তৈরি বোমা দিল্লি-সহ একাধিক প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

ইংরেজ শাসনের ভীত নড়িয়ে দিয়েছিল চন্দননগরের তৈরি বোমা। ইংরেজদের ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল "চন্দননগরের গ্যাং"-এর মতো গুটিকয়েক বিপ্লবী। ভারতের স্বাধীনতা বিপ্লবে বোমা, বন্দুকের রসদ জুগিয়ে চন্দননগর। মতিলাল রায়ের হাত ধরে তৈরি হয়েছিল প্রবর্তক সঙ্ঘ। তার আগে সেখানেই তৈরি হতো বোমা।

মনীন্দ্রনাথ নায়েক (ইটিভি ভারত)

চন্দননগরে বিপ্লবীদের জন্য বোমা তৈরি করেছিলেন চন্দননগরেরই বিপ্লবী মনীন্দ্রনাথ নায়েক। তিনি ছিলেন রসায়নের ছাত্র । কলকাতায় কলেজে পড়তে গিয়ে রিপন কলেজের (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) তৎকালীন অধ্যাপক সুরেশ চন্দ্র দত্তের তত্ত্বাবধানে শিখেছিলেন বোমা তৈরী। এমনকি প্রবর্তক আশ্রমে ও তিনি বহুবার এসেছেন বোমা তৈরির ট্রেনিং দিতে। আর তাতেই পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছিলেন মনীন্দ্রনাথ। চন্দননগরের প্রবর্তক সঙ্ঘের অন্নপূর্ণা মন্দিরে তৈরি হতো বোমা আর এখানেই পরীক্ষা করা হয়েছিল। প্রথম বোমাটি কালী পুজোর রাতে ফাটানো হয়, যার তীব্রতা এতটাই ছিল যে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছিল রাজবিহারী বসুর ফটকগোড়ার বাড়ি থেকে । পরবর্তীকালে এই বোমা চন্দননগরের বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হতে থাকে । এর নেতৃত্ব দেন মনীন্দ্রনাথ নায়েক।

চন্দননগর পার্শি বাগানের বাড়িতে, মডার্নরোড, গোন্দলপাড়া ও অরুণ চন্দ্রের ভাঙা বাড়ির অংশ-সহ একাধিক জায়গায় বোমা তৈরি হতে থাকে। এই কাজে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করেছেন মহিলারাও। প্রবর্তক সঙ্ঘের জননী মতিলাল রায়ের স্ত্রী বোমার রসদ তৈরি করতেন নিজের রান্না ঘরেই । রান্নাঘরের পাশেই তৈরি হতো বোমা। মতিলালের বাড়ির পাশেই ছিল মনীন্দ্রনাথের বাড়ি । সেই জন্যই রাসবিহারী বসু-সহ একাধিক বিপ্লবীরা ডেরা গেড়েছিল এখানেই । সেই সময় ফরাসি আমলে চন্দননগরে অস্ত্র আইন ছিল না। সুযোগটা কাজে লাগিয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ৷ এখানেই বোমা তৈরি সঙ্গে সঙ্গেই বন্দুক কার্তুজ মজুত করতে থাকে। আর এখান থেকেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় বোম বন্দুক সাপ্লাই হতে থাকে। এর জন্য রাজবিহারী বসুর কৃতিত্ব কম ছিল না। আর এই বোমের রসদ আনতেন সত্যচরণ কর্মকার ও সাগর কালী ঘোষ।

মনীন্দ্রনাথ, রাসবিহারী বসু, মতিলাল রায়, সাগরকালী দত্ত-সহ একাধিক বিপ্লবী যুক্ত ছিলেন এই সঙ্ঘের সঙ্গে (ইটিভি ভারত)

1906 সালে পর মানকুন্ডুতে ছোটলাটের গাড়ি উড়িয়ে দেওয়ার জন্য যে বোমা বিস্ফোরণ করা হয়েছিল সেই বোমা তৈরি করেছিলেন সুরেশচন্দ্র দত্ত ও মনীন্দ্রনাথ। চারুচন্দ্র রায়, শ্রীশচন্দ্র ঘোষ, কানাইলাল দত্ত, মতিলাল রায় ও মনীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে বিপ্লবী কার্যকলাপ চলতে থাকে । চারুচন্দ্রবাবু অবশ্য অন্তরালে তাদের বন্দুক শেখানো এবং বোমা ও অন্যান্য অস্ত্র চালানো শেখাতেন। স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন বিপ্লবী নেতাদের মধ্যে বোমা একটি কার্যকরী মারনাস্ত্র ছিল । এমনকি, রডা কোম্পানির থেকে লুণ্ঠিত বিপুল মাউসার পিস্তল ও গুলির একটা অংশ চন্দননগরে আনা হয়েছিল। আর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন মনীন্দ্রনাথ।

1908 সালে কানাইলালের ফাঁসি ও আলিপুর বোমা মামলার পর চন্দননগর বিপ্লবী কার্যকলাপ বাধার মুখে পড়ে। 1911 সালের পর রাসবিহারী যখন সশস্ত্র বিপ্লবের অভ্যুত্থানের কথা ভাবছেন। সেই সময়ই মনীন্দ্রনাথ প্রবর্তক আশ্রম এবং বোরাইচন্ডী তলার অরুণচন্দ্র সময়ের বাড়ি দুটি বোমা তৈরি প্রধান কেন্দ্র তৈরি করে ফেলেছেন। এছাড়াও, রাসবিহারী বসুর পৈত্রিক বাড়ির হাটখোলা হালদারপাড়া লালবাগান অঞ্চলে কিছু কিছু বাড়ি এবং বাগানবাড়ির গোপন অংশে বোমা তৈরির করা হতো।

ভারতের স্বাধীনতা বিপ্লবে বোমা, বন্দুকের রসদ জুগিয়ে চন্দননগর (ইটিভি ভারত)

1912 সালে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের উপর ফেলা বোমাও মনীন্দ্রনাথের তৈরি । এছাড়াও, টেগার্টের, ডেন হ্যামের উপর ফেলা বোমা সবই ছিল চন্দননগরের। এখান থেকে দিল্লি, লাহোর, পঞ্জাব, অসাম ও বাংলার নানা প্রান্তে বোমা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মনীন্দ্র নায়েকের তৈরি বোমা বিপ্লবীদের বড় অস্ত্র হয় হয়েছিল। চন্দননগরের বোমা ইংরেজ শাসককে নাড়া দিতে থাকে। ইংরেজ অফিসার-সহ চালর্স টেগার্ট তথ্য প্রমাণ জোগাড় করে চন্দননগরের গ্যাং সম্বন্ধে। ইংরেজদের কাছে বিপ্লবীদের এই গ্রুপ তথ্য জোগাড় করতে থাকে। 1916 সালে মনিন্দ্রনাথ, মতিলালের বাড়ি ও চন্দননগরের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি শুরু করে। মতিলালের রান্নাঘর-সহ নানা জায়গায় দেওয়াল থেকে অ্যাসিড ও গন্ধকের হলুদ রঙের চিহ্ন পায়।যদিও, সে যাত্রায় বাঁচিয়ে দেন একজন ফরাসি অফিসার।

মনীন্দ্রনাথ নায়েকের দীর্ঘদিন সান্নিধ্যে ছিলেন প্রবর্তক সঙ্ঘের একনিষ্ঠ প্রবীণ কর্মী মমতা দাস। তিনি বলেন, "মনীন্দ্রনাথকে মনীনদা বলে ডাকতাম।উনি ছোটখাটো মানুষ ছিলেন। ওনাকে দেখে মনে হতো না উনি এতো বড় মাপের মতো কাজ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর এদের টানেই প্রবর্তক সঙ্ঘে আসা আমার। ঘনিষ্ট হয়ে ওঠা প্রবতর্ককের কাজের জন্যই। প্রথমদিকে সঙ্ঘগুরু মতিলাল রায় জাতেন না যে মনীনদা বোমা তৈরি কাজের পরিকল্পনা করেন। জানতে পারার পর তাঁর কাঠের কারখানার পাশেই পুরানো বাড়িতে বোমা তৈরি শুরু হয়।"

চন্দননগরের প্রবর্তক সঙ্ঘ (ইটিভি ভারত)

মমতা দাস আরও বলেন, "বোমা তৈরির সঙ্গে রাসবিহারী বসু যুক্ত ছিলেন। তার পরিকল্পনাতেই দিল্লির চাঁদিনী চকে হার্ডিঞ্জের উপর বোমা ছোঁড়া হয়। সেই বোমা মনীনদার তৈরি । এছাড়া, একাধিক জায়গায় এখানকার বোমা যায়। এই বোমা তৈরির সঙ্গে মহিলারাও যুক্ত ছিলেন। বোমার মসলার জন্য সঙ্ঘ জননী রাধারানী ও সাগরকালী দত্তের স্ত্রীও কাজ করেছেন। এসব শোনা মনীনদার কাছ থেকেই। একাধিক বিপ্লবীর দেখেছি আমি। তাঁদের সবটাই ছিল স্বাধীনতার জন্য। স্বাধীনতার পর তাঁরা সাধারণ মানুষের মতোই প্রবর্তকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।

Last Updated : Aug 14, 2024, 9:54 PM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details