পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / state

অতীতের শেফিল্ড থেকে বর্তমানের রুগ্ন শিল্পনগরী হাওড়া, কতটা কাজ করেছেন সাংসদ প্রসূন ? - Prasun Banerjee Report Card

Prasun Banerjee Report Card: প্রাচ্য়ের শেফিল্ড হাওড়া এখন মৃতপ্রায় শিল্পনগরী ৷ এর বেশিরভাগ অংশই পড়ে হাওড়া সদর লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৷ সেখানে 2013 সাল থেকে সাংসদ তৃণমূল কংগ্রেসের প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ 11 বছরে কী কী কাজ করেছেন তিনি ? কী বলছে তাঁর রিপোর্ট কার্ড ? খতিয়ে দেখল ইটিভি ভারত ৷

Prasun Banerjee Report Card
Prasun Banerjee Report Card

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Apr 23, 2024, 7:35 PM IST

Updated : Apr 24, 2024, 10:25 AM IST

অতীতের শেফিল্ড থেকে বর্তমানের রুগ্ন শিল্পনগরী হাওড়া, কতটা কাজ করেছেন সাংসদ প্রসূন ?

হাওড়া, 22 এপ্রিল: এক সময় প্রাচ্যের শেফিল্ড বলা হত হাওড়াকে ৷ সেই হাওড়া তার শিল্পনগরীর তকমা অনেক আগেই হারিয়েছে ৷ একে বন্ধ হয়েছে ছোট-বড় কারখানা ৷ যেগুলো আছে, সেগুলোর অবস্থায় ‘মৃতপ্রায়’ ৷ ভোট এলেই হাওড়ার অতীতের গৌরব আর বর্তমান দুর্দশার ছবির তুলমূল্য বিচার শুরু হয়ে যায় ৷ 2024 সালের লোকসভা নির্বাচনও তার ব্যতিক্রম নয় ৷

শিল্পের জন্যই একসময় হাওড়ার পরিচিত ছিল ৷ ছোট-বড় অনেক কারখানাই ছিল সেখানে ৷ তথ্য বলছে, সাতের দশকের পর থেকে সেভাবে হাওড়ার শিল্পোন্নয়নের কাজ সেভাবে হয়নি । হাওড়ার শিল্পের যা কিছু ছিল, তা সবই সাতের দশকের সময়ে । যার মধ্যে অন্যতম ছিল বার্ন স্ট্যান্ডার্ড, জে কে ডব্লিউ, হুগলি ডক, গ্যাসকিং-সহ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শিল্প । যে নগরীর জন্য প্রণীত হয়েছিল বিশেষ আইন । যদিও তার সবই এখন ইতিহাসের পাতাতেই সীমাবদ্ধ ।

একদা প্রাচ্যের শেফিল্ড তকমা পাওয়া হাওড়া শিল্পনগরীর দশা বড়ই বেহাল । এই কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে আরতি কটন মিল, ব্রিজ অ্যান্ড রুফ, রেল প্রিন্টিং প্রেসের মতো কেন্দ্রীয় সংস্থা, একইভাবে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা বার্ন স্ট্যান্ডাড, হুগলি ডক, গ্যাসকিং-সহ বহু মাঝারি ও ছোট শিল্প ।

হাওড়ার দাস নগর এলাকা তথা ইছাপুর এলাকাতে ছোট বড় লেদ মেশিনের কারখানা রয়েছে । সেখানেও ব্যবসার হাল মন্দ হওয়ার জন্য শ্রমিকদের সংখ্যাও দিনের পর দিন কমেছে । এই সকল লেদ কারখানাতে অতীতে শ্রমিকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো । যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাওড়ার শিল্পের জৌলুশ তলানিতে এসে ঠেকার কারণে এই ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে পরবর্তী প্রজন্ম ।

অথচ হাওড়ার শিল্পনগরীর উত্থান ও অর্থনীতির বিকাশে ছোট-বড় সব সংস্থারই অবদান ছিল । এই কেন্দ্রে এই সমস্ত অতীতের কারখানাগুলোকে চালু করানোর উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে কেন্দ্রের জীবিকা সংস্থানে এলাকার অর্থনৈতিক বিকাশে উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হতে পারতো । সেই পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার কি সম্ভব ? সেটাই এখন ভোটের ইস্যু হাওড়ায় ৷

আগামী 20 মে হাওড়ার লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচন । স্থানীয় সাংসদ তথা প্রাক্তন ফুটবলার প্রসূন বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের উপরই ভরসা রেখেছে তৃণমূল ৷ তাঁর মূল দুই প্রতিপক্ষের একজন রথীন চক্রবর্তী ৷ এক সময় তৃণমূলে প্রসূনের সতীর্থ রথীন এখন হাওড়ার পদ্ম ফোটাতে নেমেছেন ৷ আর রয়েছেন সিপিএমের সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় ৷ আইনজীবী হিসেবেও তাঁর বেশ পরিচিতি রয়েছে ৷

বিজেপির রথীন হোক, কিংবা সিপিএমের সব্যসাচী, দু’জনেই প্রচারে মানুষের দুয়ারে পৌঁছে এই ইস্যুকেই উস্কে দিচ্ছেন ৷ পাশাপাশি আগামিদিনে হাওড়ার শিল্পে সুদিন ফেরানোর আশ্বাসও দিচ্ছেন ৷ এই কেন্দ্রের বাম প্রার্থী সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় বলছেন, "মানিকপুর ডেল্টা জুটমিল থেকে এই কেন্দ্রের শুরু । সেখানে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার অবস্থা খুব করুণ । রাজগঞ্জ, আরতি কটন মিল চললেও সেখানে শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা নেই । হুগলি ডক বন্ধ, আপনি কোথায় যাবেন ! এগুলো চালাতে গেলে পরিকল্পনা লাগে । বন্ধ কারখানার জমি বেচারামের মতো বেচে দিয়ে সেখানে বড়লোকদের থাকার জন্য আবাসন তুললেও কেনার মতো এত বড়লোক হাওড়াতেও নেই ।"

হাওড়ার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিজেপি প্রার্থী রথীন চক্রবর্তী অভিযোগ করেন, "হাওড়া 600 বছরের প্রাচীন শহর । এই শহরকে বিশেষ পদ্ধতিতে হত্যা করা হয়েছে । এখানে থাকা বড়, মাঝারি, ছোট সব শিল্প শেষ হয়ে গিয়েছে । হাওড়াতে বার্ন স্ট্যান্ডার্ড, জিকে ডব্লিউ মতো শিল্প ছিল । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে রেলমন্ত্রী হলেও বার্ন স্ট্যান্ডার্ড বাঁচাতে অক্ষম ছিলেন । রেলের সবচেয়ে বড় ওয়াগন তৈরির কারখানা বন্ধ হয়ে গেল, বাঁচাতে পারেননি । এখন মেট্রো রেল ময়দান অবধি চালু হয়েছে, আগামিদিনে এর সম্প্রসারণ হবে সাঁতরাগাছি অবধি । আমাদের দাবি একে ধূলাগড়, বালিখাল অবধি নিয়ে যাওয়া ।"

রথীনের আরও অভিযোগ, "হাওড়াতে নবান্ন করা হলেও শহরটার জন্য কিছু করা হল না । একদা 600 বছর পুরানো শেফিল্ড নগরী থেকে বর্তমানে জঞ্জাল নগরীর তকমা পেয়েছে । হাওড়া সবদিক থেকে বঞ্চিত রয়ে গিয়েছে । সামান্য সরকারি মেডিক্যাল কলেজ শহরে তৈরি হয়নি । স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্প নিয়ে আমরা ভাবছি । আগামীদিনে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আমরা তা তুলে ধরবো । আমরা বিশ্বাস করি, কেন্দ্রের সরকার অবশ্যই সাহায্য করবে ।"

যদিও হাওড়ার এই পরিস্থিতির জন্য পূর্ববর্তী বাম সরকারকেই সম্পূর্ণ দায়ী করে দায় এড়াচ্ছেন হাওড়া সদরের বিদায়ী সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় । তাঁর অভিযোগ, "আমরা জানি সব শেষ হয়ে গিয়েছে । আমরা আসার আগে সিপিএম-সিটু করে সব শেষ করে দিয়ে গিয়েছে । তবে আমরা চেষ্টা করছি৷ কিন্তু সবটা হয়ে গিয়েছে, এটা মিথ্যা কথা বলা হবে । এটা খুব কঠিন জায়গা, যেভাবে সিপিএম শেষ করে দিয়ে গিয়েছে সেখান থেকে ধীরে ধীরে আবার ভালো হতে শুরু করেছে ।"

প্রসূন আরতি কটন মিলের উল্লেখ করে বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই মিলকে বাড়িয়েছিলেন । বেশ কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর আমি সাংসদ হিসাবে চালু করার জন্য কথা বলেছি । আবার চালু হয়েছে । এই সিপিএম কারখানা বন্ধ করে বাংলাকে শেষ করে দিয়ে গিয়েছে । এখন আবার ভোট চাইতে আসে, এরা একটাও ভোট পাবে না ।"

যদিও এর পালটা জবাব দিয়েছেন সিপিএমের সব্যসাচী ৷ তাঁর দাবি, বাম সরকার রাজ্যে শিল্পের বিনিয়োগের জন্য অনেক সদর্থক ভূমিকা নিয়েছিল । তা নবান্ন তৈরি থেকে রাস্তার সম্প্রসারণ, কম্পিউটার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন উল্লেখযোগ্য । এই কাজে হাওড়ার বাম সাংসদদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ছিল বলেই তাঁর দাবি ।

তবে শিল্পের বেহাল দশার পাশাপাশি সাংসদ হিসেবে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের পারফরম্যান্স নিয়েও আলোচনা চলছে ৷ ভারত সরকারের এমপিল্যাড (সাংসদের জন্য বরাদ্দ তহবিল) সংক্রান্ত পোর্টালে দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, 2019 থেকে 2024 এই পাঁচ বছরে সাংসদ উন্নয়ন তহবিলে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের পাওয়ার কথা ছিল 17 কোটি টাকা ৷ এর মধ্যে ভারত সরকার থেকে টাকা এসেছে সাত কোটি টাকা ৷ বাকি 10 টাকা আসেনি ৷ যে টাকা তিনি পেয়েছিলেন, তাঁর মধ্যে 0.87 কোটি টাকা তিনি খরচ করতে পারেননি ৷

তিনবারে সাত কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল হাওড়ার সাংসদের জন্য৷ প্রথমবার আড়াই কোটি টাকা বরাদ্দ হয় 2019 সালের 26 ডিসেম্বর ৷ 2021 সালের 14 জুন বরাদ্দ হয় বরাদ্দ হয় আরও আড়াই কোটি টাকা ৷ 2022 সালের 9 জুন বরাদ্দ হয় আরও 2 কোটি টাকা ৷ বাকি টাকা কেন বরাদ্দ হয়নি ? এই নিয়ে সরকারি পোর্টালে লেখা রয়েছে যে প্রয়োজনীয় এমআরপি ও প্রভিশনাল ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট জমা পড়েনি ৷

এই নিয়ে সিপিএম প্রার্থী সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় কটাক্ষ করেছেন হাওড়ার সাংসদকে ৷ তিনি বলেন, "এটা জনগণের টাকা, এত কাজ করার জায়গা থাকলেও কোনও পরিকল্পনা নেই ৷ তাই খরচ করতে পারছেন না ।" এই নিয়ে অবশ্য হাওড়ার সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি ৷

হাওড়ায় কখনও সিপিএম জিতেছে ৷ আবার কখনও কংগ্রেস ৷ তৃণমূল তৈরি হওয়ার পর 1998 সালে প্রথমবার এই কেন্দ্র আসে ঘাসফুলের দখলে ৷ সাংসদ হন বিক্রম সরকার ৷ 1999 সালে সিপিএমের স্বদেশ চক্রবর্তীর কাছে হারে তৃণমূল ৷ তার পর 2009 সালে হাওড়া সদর পুনরুদ্ধার করে তৃণমূল ৷ তার পর আর হারতে হয়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে ৷

টানা 15 বছর সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ রয়েছে ৷ এর আগে কোনও দল এতদিন হাওড়া ধরে রাখতে পারেনি ৷ তবে সিপিএমের সমর মুখোপাধ্যায়ের হাওড়ার সবচেয়ে বেশি সময়ের সাংসদ ৷ 1971 থেকে 1984 পর্যন্ত (13 বছর) তিনি হাওড়ার সাংসদ ছিলেন ৷ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় হাওড়ার সাংসদ 2013 সালে ৷ 2009 সালে জয়ী অম্বিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পর উপ-নির্বাচনে জয়ী অর্জুন পুরস্কার প্রাপ্ত প্রাক্তন এই ক্রীড়াবিদ ৷ টানা 11 বছর তিনি হাওড়ার সাংসদ ৷

এবার জিততে পারলে সমর মুখোপাধ্যায়ের 13 বছর একটানা সাংসদ হওয়ার রেকর্ড ভেঙে শীর্ষ পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে প্রসূনের কাছে ৷ কিন্তু সেই সুযোগ কি তিনি পাবেন ? উত্তর মিলবে আগামী 4 জুন ৷

আরও পড়ুন:

  1. পাঁচ বছরে যাদবপুরের মানুষের প্রত্যাশা কি পূরণ করতে পেরেছেন মিমি চক্রবর্তী ?
  2. বিরোধীদের অভিযোগের মাঝে মতুয়া গড়ে পুরো তহবিল খরচের দাবি শান্তনুর
  3. সব টাকা খরচ করলেও দেবশ্রীকে নিয়ে রায়গঞ্জে 'ক্ষোভের পাহাড়', দেখুন রিপোর্ট কার্ড
Last Updated : Apr 24, 2024, 10:25 AM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details