কোরোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও স্বাস্থ্যকর্মীদের একটা বড় অংশকে এই রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধের কাজে বিশেষভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে । ওই স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাসিন্দারা কোরোনায় আক্রান্ত হয়েছেন কি না, তা পরীক্ষা করা সহ অন্যান্য কাজ করছেন । কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বিশেষ সমস্যায় পড়েছে ভারতের মতো সেই দেশগুলো যেখানে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এখনও যথেষ্ট উন্নত নয় । যেহেতু কোরোনা প্রতিরোধে দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর একটা বড় অংশ এখন ব্যবহার করা হচ্ছে, তার জেরে স্বাস্থ্য পরিষেবার অন্য দিকগুলোতে বিশেষ সমস্যা হচ্ছে । আর এই সমস্যাগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য পরিষেবা ।
যেহেতু কোরোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর একটা বড় অংশকে এখন আমাদের দেশে কাজে লাগানো হচ্ছে, তাই মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য পরিষেবার দিকটি বিশেষভাবে অবহেলার সম্মুখীন হচ্ছে আর এর জেরে কোরোনো মহামারীর প্রাদুর্ভাবের পর থেকে ভারতে প্রসবকালীন মৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যুর হার কিন্তু অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে । UNFPA (ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ড) – এর তরফে দেওয়া এক পরিসংখ্যান বলছে যে, কোরোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাবের পর থেকে বিশ্বে অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের সংখ্যা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে । এই সংখ্যাটি প্রায় ৭০ লাখ । অন্যদিকে প্রসবের সময় উপযুক্ত আপৎকালীন পরিষেবা না থাকার জন্য জটিলতা যেমন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে গর্ভপাত না করার ফলে করোনার প্রাদুর্ভাবের পর বহু মহিলার মৃত্যু হয়েছে ।
ইউনাইটেড নেশনস চিলড্রেনস ফান্ড (UNICEF) - এর তরফে দেওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে মার্চ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে প্রায় ২ কোটি শিশুর জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে । এই সংখ্যাটি বিশ্বে সর্বোচ্চ । এছাড়া ইউনাইটেড নেশনস চিলড্রেনস ফান্ড সতর্ক করে আরও জানিয়েছে যে, কোরোনা মহামারীর এই সময়ে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অপ্রতুলতার জেরে গর্ভবতী মহিলাদের ও নবজাতকদের স্বাস্থ্যজনিত যথেষ্ট ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে । কারণ তারা পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা পাচ্ছে না । এর জেরে সমস্যা বিশেষভাবে বাড়ছে । অর্থাৎ সবমিলিয়ে যা দাঁড়াচ্ছে তা হল এই যে, কোরোনা মহামারীর মোকাবিলা করার পাশাপাশি ভারতকে স্বাস্থ্য পরিষেবার সেই দিকটিতেও নজর দিতে হবে যা এদেশের এক দীর্ঘকালীন সমস্যা । সেই সমস্যা হল সঠিক সময়ে মহিলাদের গর্ভধারণের বিষয়টি বুঝতে না পারা এবং নবজাতক ও শিশুদের উচ্চ মৃত্যুহার ইত্যাদি ।
তাই কোরোনা মহামারীর প্রকোপ চলাকালীন মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য পরিষেবার বিষয়টির গুরুত্বের কথা বিশেষভাবে মাথায় রেখে দেশের সরকারের উচিত গর্ভবতী মহিলাদের যাতে স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে কোনও সমস্যা না হয় সেজন্য অবিলম্বে উপযুক্ত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে পরিস্থিতির বিশেষভাবে মোকাবিলা করা । ইতিমধ্যে দেশের কিছু অংশে সমস্যার মোকাবিলায় প্রযুক্তির ব্যবহার কিন্তু শুরু হয়েছে । উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ‘আরোগ্য সখী’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের কথা । এই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি তৈরি করেছেন অপর্ণা হেগড়ে । অপর্ণা হেগড়ে পেশায় একজন ইউরোগাইনিকোলজিস্ট । এই অ্যাপটি তৈরি করা হয়েছে মহারাষ্ট্রের প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় গর্ভবতী মহিলাদের সাহায্য করার জন্য । প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় যে সমস্ত গর্ভবতী মহিলাদের পক্ষে স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে গিয়ে পরিষেবা পাওয়া সম্ভব নয় তাঁদের এই অ্যাপটির মাধ্যমে আশাকর্মীরা প্রয়োজনীয় পরিষেবা প্রদান করে থাকেন । প্রযুক্তির মাধ্যমে এই ধরনের পরিষেবা প্রদানের আরও একটি উদাহরণ হল ASMAN (অ্যালিয়্যান্স ফর সেভিং মাদারস অ্যান্ড নিউবর্নস) । এটি এমন একটি ডিজিটাল মঞ্চ যা প্রযুক্তির সাহায্যে রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের গর্ভবতীদের ও নবজাতকদের উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে কাজ করে চলেছে । এই প্রসঙ্গে এটা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় যে, ভারতের ওই দুটি রাজ্যে প্রসবকালীন ও নবজাতকদের মৃত্যুর হার কিন্তু দেশের অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় বেশি । ওই দুটি রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী গর্ভবতী মহিলাদের যখন প্রসব বেদনা ওঠে এবং দ্রুত নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে পৌঁছাতে তাঁদের সমস্যা হয় তখন এই ডিজিটাল মঞ্চের প্রযুক্তির সাহায্যে তাঁদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয় । পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠলে জরুরী পরিষেবার জন্য নিকটবর্তী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওই মহিলাদের যোগাযোগ করিয়ে দেয় ওই ডিজিটাল মঞ্চ এবং পরিস্থিতির মোকাবিলায় অনলাইনে চিকিৎসকদের মাধ্যমে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতেও সাহায্য করে । এই ধরনের প্রযুক্তিগত পরিষেবা যদি দেশের অন্য রাজ্যগুলির গ্রামীণ এলাকাগুলিতে প্রয়োগ করা হয় তবে অবশ্যই পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং বহু মা ও শিশুর প্রাণ বাঁচানো সম্ভবপর হবে ।