মেদিনীপুর, 9 জুন : ভোররাত থেকে কাজ লেগে পড়তেন তাঁরা । চলত মাঝরাত অবধি। ট্রেনে যাত্রীর ভিড় হলেই তাঁদের মুখে হাসি ফুটত । সারাদিন নানা প্রান্ত থেকে যাত্রীদের আনাগোনা চলত । আর সকালের খাবার থেকে রাত্রের নিশ্চিন্তে ঘুম, যাত্রীদের জন্য সমস্ত ব্য়বস্থা করতেন তাঁরা । ট্রেনের চাকা ঘুরলে তাঁদের পেট চলত । কিন্তু কোরোনা আর লকডাউন পুরো ছবি বদলে দিয়েছে । এখন প্রায় সুনসান স্টেশন চত্বর । না যাত্রীদের ভিড়, না রকমারি খাবারের অর্ডার, না হোটেল বুকিং । রোজগার হারিয়ে চরম বিপাকে মেদিনীপুর রেল স্টেশন চত্বরের ছোটো ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে আশপাশের হোটেল মালিকরা । তাঁদের আবেদন সরকার যেন তাঁদের দিকে একবার তাকায় । পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত যেন কিছু আর্থিক সংস্থানের ব্যবস্থা করা হয় ।
প্রতিদিন লোকাল ট্রেন, দুরন্ত এক্সপ্রেস যাতায়াতে গমগম করত মেদিনীপুর স্টেশন চত্বর । চলত কেনা-কাটা । হোটেল বুকিং । আর এর মাধ্য়মেই সংসার চলত স্টেশন চত্বরের ছোটো ছোটো ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে হোটেল মালিকদের । এই রেল স্টেশন চত্বরে হোটেলের সংখ্যা প্রায় 250-300 । অন্য দোকানের সংখ্যা 200-250-এর কাছাকাছি । রেল পরিষেবার উপর নির্ভর করেই প্রায় 10 হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা চলে । টিফিন থেকে শুরু করে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থার পাশাপাশি হোটেলে থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে। স্থানীয়ের পাশাপাশি ভিনরাজ্যের বহু মানুষজনও এই হোটেল, খাবারের দোকানগুলিতে কাজ করেন । তাই তাঁদের পেট চালায় এই রেল পরিষেবা । বিশেষ করে মেদিনীপুর থেকে হাওড়া লোকাল ট্রেনে যাত্রীদের পরিমাণটা বেশি। এছাড়াও আসানসোল থেকে হাওড়া এবং দুরন্ত এক্সপ্রেসের যাতায়াতের ফলে যাত্রীদের আনাগোনাতেই হোটেলগুলির ব্যবসা চলে । কিন্তু দীর্ঘদিন লকডাউন আর ক্রমবর্ধমান সংক্রমণের জেরে চরম ক্ষতির সম্মুখীন স্টেশন চত্বরের হোটেল ও ছোটো-ছোটো দোকানের ব্যবসায়ীরা। শুধুমাত্র নিত্যপ্রয়োজনে মালগাড়ি এবং শ্রমিক স্পেশাল ছাড়া সব ট্রেন চলাচল বন্ধ । সেই ট্রেনগুলিও আবার নির্দিষ্ট স্টেশন ছাড়া কোথাও দাঁড়াচ্ছে না। তাই বিপাকে পড়েছেন বড় থেকে ছোটো সমস্ত দোকানদার।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে স্থানীয় ব্যবসায়ী কিশোর মিশ্র বলেন, "মূলত রেল পরিষেবার উপরই আমাদের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে । পরিষেবা সচল থাকলেই, যাত্রীদের ভিড় বাড়ে । ভোরবেলা থেকে গভীররাত পর্যন্ত আসা-যাওয়া লেগে থাকে । এর সঙ্গেই হোটেলে থাকা- খাওয়ার বিষয়টিও সুনিশ্চিত হয় । আর আমাদের রুজি-রোজগার বাড়ে । কিন্তু দীর্ঘ 60-70 দিন রেল পরিষেবা বন্ধ। তাই দোকানপাটও বন্ধ রয়েছে । তাই আমাদের রোজগারও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একদিকে সংক্রমণ, তারউপর আর্থিক সমস্যা । প্রতিদিন আতঙ্কে কাটছে ।" ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, রেল থেকে এখনও কোনও সদুত্তর মেলেনি । বিভিন্ন ফোরাম ও সংগঠনের মাধ্যমে আবেদন জানানো হয়েছে । কিন্তু কোনও লাভ হয়নি । অন্য এক ব্যবসায়ী প্রকাশ মিশ্র বলেন, "এই রেল পরিষেবার উপরই আমাদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যবসা । এখন আর যাত্রী নেই। টুকটাক এলাকার যে মানুষজন ঘোরাফেরা করে, তারাও লকডাউনে সবাই গৃহবন্দী। আমাদের মজুত টাকাও ধীরে ধীর ফুরোচ্ছে । আগামী দিনে এরকম চলতে থাকে, না খেতে পেয়ে মরতে হবে।"
স্টেশন চত্বরে কিছু হোটল রয়েছে, যেখানে চাকরি সূত্রে যাতায়াত করতে গিয়ে হোটেলে থাকেন কর্পোরেট কর্মীরা। হোটেল ম্যানেজার চঞ্চল মুখোপাধ্যায় বলেন, "আমাদের এই ব্যবসা মূলত কর্পোরেট সেক্টরের উপর নির্ভরশীল। আমাদের 70-80% গ্রাহক কর্পোরেট সেক্টরের কর্মী। যাঁরা কলকাতা,পুরুলিয়া,বাঁকুড়া থেকে কাজের সূত্রে এসে এখানকার হোটেলে ওঠেন । এখন তো সবকিছুই বন্ধ । আমরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন । তাছাড়া আনলক 1.0-তে যাঁরা আসছেন, তাঁরা প্রাইভেট গাড়িতে আসছেন । কাজ সেরে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন । রেল যোগাযোগের প্রশ্নই উঠছে না । অনেকে হোটেল বুকিং করে, আবার বুকিং বাতিল করে দিচ্ছেন । এখন এটি প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবে যে সবকিছু স্বাভাবিক হবে,এখন সেদিকে তাকিয়ে রয়েছি ।"
সমস্য়ায় মেদিনীপুর স্টেশন চত্বরের ব্যবসায়ীরা রেল পরিষেবার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছোটো-বড় এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দাবিকে সমর্থন জানিয়েছেন মেদিনীপুর কনফেডারেশন ডিস্ট্রিক্ট চেম্বার্স কমার্সের সদস্যরা । ডিস্ট্রিক্ট চেম্বার্স কমার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট অসীম কাইতি বলেন, "আমরা এই ছোটো দোকানিদের সঙ্গে একমত। সত্যিই তাঁদের জীবন-জীবিকা অনিশ্চয়তায় রয়েছে । আমরা তাঁদের দাবি-দাওয়া সরকারকে পাঠিয়েছি । যদিও এখনও পর্যন্ত কোনও সদুত্তর মেলেনি । রাজ্য সরকারের কাছে আমাদের আবেদন এই গরিব ছোটো ব্য়বসায়ীদের জন্য যেন আর্থিক সাহায্য়ের ব্যবস্থা করা হয় ।"