আসানসোল, 3 নভেম্বর: আদিবাসী পাড়ায় চারপাশে মাটির নিকোনো দেওয়াল । আর সেই দেওয়ালে আঁকা হয়েছে ব্ল্যাকবোর্ড । ছাত্রছাত্রীরা তো বটেই, তাদের মা, ঠাকুমা তিন প্রজন্ম মিলে সেই ব্ল্যাকবোর্ডে লিখছে অ-আ-ক-খ । ছাত্রছাত্রীরা সুরে সুরে বলে উঠছে 'জমা জল যেথায়, ডেঙ্গুর মশা সেথায় ৷" এমনই অভিনব ভাবে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান করেন জামুড়িয়ার তিলকা মাঝি আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক দীপনারায়ণ নায়ক । যিনি কোভিডকালের পর থেকে রাস্তার মাস্টার হিসেবে চিহ্নিত । আর এ বার তাঁর এই অভিনব পাঠদানের জন্য তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতির দৌড়ে ।
ইউনেস্কো, ভারতী ফাউন্ডেশন এবং দুবাই কেয়ার - এই তিনটি সংগঠন যৌথভাবে ঘোষণা করেছে গ্লোবাল টিচার্স অ্যাওয়ার্ড । আর সেই অ্যাওয়ার্ডের প্রথম দশে নাম উঠে এসেছে দীপনারায়ণ নায়কের । আগামী আট নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত হবে এই গ্লোবাল টিচার্স অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান । সেখানে দীপনারায়ণ নায়ক নিজে উপস্থিত থাকবেন । তিনি যাতে প্রথম স্থানে থেকে এই গ্লোবাল টিচার্স অ্যাওয়ার্ড জিতে আসতে পারেন সেই কারণে তাঁকে শুভেচ্ছার বন্যায় ভরিয়ে দিয়েছেন তাঁর সহকর্মী থেকে শুরু করে জামুড়িয়া চক্রের স্কুল পরিদর্শক, এমনকি জেলার স্কুল পরিদর্শকও ।
দীপনারায়ণ ইটিভি ভারতকে জানিয়েছেন, "শিক্ষকতার জন্য আমাকে সারা দেশ থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে । এ আমার কাছে বড় গর্বের । তবে আগামী দিনে আরও দায়িত্ব বেড়ে গেল । প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে আমি বদ্ধপরিকর ।"
আসানসোলের জামুড়িয়ান নন্ডিগ্রামের বাসিন্দা দীপনারায়ণ নায়ক । পরিবারে তেমন স্বচ্ছলতা ছিল না । তাই উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন থাকলেও বেশি দূর যেতে পারেননি । নিতে হয়েছিল সরকারি স্কুলে শিক্ষকতার কাজ । জামুড়িয়া তিলকা মাঝি আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক দীপনারায়ণ নায়ক । স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে আসা এবং কোথাও কোথাও প্রথম প্রজন্মের আদিবাসী সমাজের শিশুদের আলোকিত করা, এমন উদ্দেশ্যেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আসতেন স্কুলে । কিন্তু বাধ সাধল কোভিড । স্কুল বন্ধ হয়ে গেল । শুরু হল অনলাইন ক্লাস । কিন্তু আদিবাসী ছাত্রছাত্রীরা কোথায় পাবে অ্যান্ড্রয়েড ফোন ? আর এই অবস্থায় যদি পঠনপাঠন বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তাদের আর স্কুলমুখী করা যাবে না । আর তাই অভিনব ভাবনা ভাবলেন দীপনারায়ণ নায়ক । তিনি রাস্তাকেই স্কুল তৈরি করলেন । আদিবাসী পাড়ায় মাটির দেওয়াল হয়ে উঠল ব্ল্যাকবোর্ড এবং ছাত্রছাত্রীদের রাস্তায় বসিয়েই সামাজিক দূরত্ব মেনে পাঠদান করতে শুরু করলেন ৷ অভিনব এই ভাবনার কথা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে । দীপনারায়ণ হয়ে গেলেন রাস্তার মাস্টার ।