কলকাতা : শুরুটা হয়েছিল 24 মার্চ । আর মে-র 20-এ যেন বিষফোঁড়া ।
কোরোনা ভাইরাস এবং লকডাউন । দেওয়ালে পিঠ ঠেকেই ছিল । তারই মাঝে ঘূর্ণিঝড় আমফানের তাণ্ডব । কার্যত লন্ডভন্ড গোটা বাংলা । শেষ বার 1737-এর বেঙ্গল সাইক্লোন । 280 বছরের মধ্যে এমন ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেনি রাজ্য । সাম্প্রতিক সময়ে গতি-তীব্রতা-ভয়াবহতা-ধ্বংসলীলার নিরিখে যার সঙ্গে তুলনীয় একমাত্র 1999-এর ওড়িশার সুপার সাইক্লোন । যে ক্ষত সারিয়ে উঠলেও 'সাইক্লোন' শব্দটা ওই প্রদেশের মানুষের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট । সরকারি তথ্য অনুসারে, সেই ঝড়ের তাণ্ডবলীলায় পড়শি রাজ্যে প্রাণ হারিয়েছিলেন 9,885 জন । যদিও বেসরকারি মতে মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছিল 30 হাজারে ।
কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটা বছর । এখন অনেক আগে থেকেই বিপদের পূর্বাভাস পাওয়া যায় । হওয়া যায় সর্তকও । বিপর্যয় মোকাবিলা করার ক্ষমতা হয়েছে আগের থেকে অনেক ক্ষুরধার ।
কিন্তু, 20 মে !
সব হিসেব-নিকেশ যেন ওলট-পালট হয়ে গেল এক সন্ধ্যায় । বঙ্গোপসাগর থেকে সুন্দরবনের দিকে যত এগোল আমফান ততই দিশেহারা হতে থাকল রাজ্য প্রশাসন, কেন্দ্রীয় সরকার থেকে সাধারণ মানুষ প্রত্যেকেই । কী করা উচিত, কী করলে সামান্যতম রক্ষা মিলবে- কোনও হিসেবই মিলছিল না । স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ঘোষণা, কোরোনায় আক্রান্ত হয়ে ইতিমধ্যেই রাজ্যে প্রাণ হারিয়েছেন 223 জন । আক্রান্তের সংখ্যা 4,536 । আবার ভিনরাজ্যে আটকে থাকা শ্রমিকদের ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার । প্রতিদিনই বাস এবং ট্রেনে করে ফিরছেন বহু পরিযায়ী শ্রমিক । এমন পদক্ষেপ রাজ্যে কোরোনা সংক্রমণের মাত্রা যে বৃদ্ধি করতে পারে, সেই সম্ভাবনা কোনওভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না ।
পরিসংখ্যান বলছে, রুজিরুটির তাগিদে দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে কাজ করেন বাংলার কয়েক হাজার শ্রমিক । বছরে নানা রাজ্য থেকে যে পরিমাণ শ্রমিক ভিন রাজ্যে কাজ করতে যান, সেই সংখ্যাটি আর পাঁচটা রাজ্যের থেকে অনেকটাই বেশি বাংলায় । লকডাউনের জেরে কাজ হারিয়েছেন, এই সব হাজার হাজার শ্রমিক । যাঁরা কেউ ট্রেনে-বাসে কেউ বা হেঁটে বাড়ি ফিরছেন । রাজ্য প্রশাসন এই সব শ্রমিকদের পৃথক রাখার জন্য (14 দিনের কোয়ারানটিন) চিন্তাভাবনাও করছিল, যাতে কোনওভাবেই কোরোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে না পড়ে ।
যদিও, কোরোনা মোকাবিলায় নবান্নের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল বার বার । প্রশিক্ষিত নার্স, চিকিৎসক যেমন কম, তেমনই PPE কিটের অভাব রাজ্যের জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর খামতি আরও প্রকট করে তুলছিল । এই দুর্বলতা নিয়ে সরকারকে নিশানা করতে পিছপা হচ্ছিল না বাম-ডান কোনও পক্ষই । দেওয়ালে পিঠ ঠেকেই ছিল । ঠিক সেই সময় আছড়ে পড়ল ঘূর্ণিঝড় আমফান ।
পূর্ব মেদিনীপুরের দিঘা-শংকরপুর-তাজপুর । উপকূলবর্তী এলাকায় বইতে শুরু করেছে ঝোড়ো হাওয়া । নবান্নের কন্ট্রোল রুমে তখন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । উদ্দেশ্য, গোটা পরিস্থিতির উপর নজরদারি । কিন্তু, ঘূর্ণিঝড়ের মতিগতি ছিল অন্য । 20 মে, দুপুর । ঘড়ির কাঁটা সবে 2 টা 30 টপকেছে । তীব্র গতিতে আছড়ে পড়ল আমফান । মূহূর্তে সুন্দরবন সংলগ্ন গোটা এলাকা পরিণত হল ধ্বংসস্তূপে । যেন তাসের ঘরের চেহারা নিয়েছে গোটা দক্ষিণ 24 পরগনা । ঝড়ের গতি তখন ঘণ্টায় 190 কিলোমিটার ছাড়িয়েছে । বাঁধের পর বাঁধ, বাড়ির পর বাড়ি ভেঙে পড়ছে । মুহূর্তে মনে করিয়ে দিল আয়লা, বুলবুল এবং ফণীর তাণ্ডবের কথাগুলো । 2009 এবং 2019 সালে তো এমনই ছবি দেখেছিলেন সেখানকার বাসিন্দারা । গতি সামান্য কমিয়ে আমফানের অভিমুখ তখন কলকাতার দিকে । গতিবেগ ঘণ্টায় 130 কিলোমিটার । দমদম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শুরু করে হুগলি নদী বয়ে শহর কলকাতায় শুরু হল আমফানের আস্ফালন । গোটা শহর তখন গৃহবন্দী । প্রার্থনা একটাই, প্রলয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার । মুখ্যমন্ত্রী ঠায় বসে কন্ট্রোল রুমে । প্রত্যক্ষ করছেন প্রকৃতির তাণ্ডবলীলা ।
আনন্দের শহরে তখন শুধুই হাহাকার । রাত যত বেড়েছে বিদ্যুৎহীন শহরের অন্ধকার হয়েছে ততই গাঢ় । বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি আর গোঁ গোঁ করে ফুঁসে চলা আমফান । দিনটার উপর যেন ভেঙে পড়েছিল ভয়ঙ্কর হতাশা । সুন্দরবনের গ্রামীণ জনপদ থেকে কলকাতা শহর- এক লহমায় যেন ভুতুড়ে বাড়ির চেহারা নিয়েছিল । মুখ্যমন্ত্রী আগে জানিয়েছিলেন মৃতের সংখ্যা 72, যা ক্রমে বেড়ে 86 ছুঁয়েছে । দুই 24 পরগনা হারিয়েছে তার পরিচিত রূপ ।