কলকাতা, 8 নভেম্বর: ইডেন গার্ডেন্সে বিশ্বকাপে ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের পর উচ্ছ্বসিত জনতার ফাটানো সেল বা শব্দবাজির জেরে প্রাণ হারিয়েছে কলকাতা মাউন্টেড পুলিশের 'ভয়েস অফ রিজনস' নামে একটি ঘোড়া ৷ সেই ঘটনার দিন সেখানে থাকা বাকি ঘোড়াগুলিও খুব একটা ভালো নেই ৷ কলকাতা পুলিশ সূত্রে খবর, ঘটনার তিনদিন পর, মাউন্টেড শাখার আস্তাবলের অন্যান্য ঘোড়াগুলির আচরণে আশ্চর্যজনক বদল দেখা গিয়েছে ৷
গোটা ঘটনা তদন্ত এখনও ঠিকভাবে শুরু না-হলেও, এ প্রসঙ্গে মুখে কুলুপ এঁটেছেন কলকাতা পুলিশের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা ৷ এমনকী নিচুতলার পুলিশকর্মীদেরও এই বিষয়ে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে ৷ গত রবিবার ভয়েস অফ রিজেনস-এর মৃত্যুর পর শান্ত হয়ে গিয়েছে সংশ্লিষ্ট পুলিশ আস্তাবলে থাকা অন্যান্য ঘোড়াগুলি ৷ এ বিষয়ে নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মী বলেন, ‘‘অন্যান্য দিন যেভাবে পুলিশ কর্মীরা ঘোড়াগুলির সামনে গেলেই তারা উঠে দাঁড়িয়ে পড়ত এবং ময়দানে যাওয়ার জন্য এক প্রকার প্রস্তুত থাকত, সোমবারের সকাল থেকে সেই চিত্রটা অনেকটা আলাদা ৷ ওই আস্তাবলে ভয়েস অফ রিজেন্সের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কলকাতা পুলিশে কর্মরত 'হিস্টোরিয়ান', 'তিস্তা', 'ক্রেডিট সোয়াপ' এবং 'অলওয়েজ ওয়েলকাম' নামে বাকি ঘোড়াগুলি একপ্রকার খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে বললেই চলে ৷
কলকাতা পুলিশ সূত্রে খবর, মূলত মাউন্টেড পুলিশের দিনে দু’বার ডিউটি থাকে ৷ প্রথমে সকাল বেলা, আর দ্বিতীয়বার ঠিক বিকেল সাড়ে চারটে থেকে ছ’টা-সাড়ে ছটা পর্যন্ত ৷ মাউন্টেড পুলিশের ঘোড়াগুলি ময়দানে নিরাপত্তার বিষয়টি দেখাশোনা করে ৷ ইডেন গার্ডেন্স কিংবা ময়দান চত্বরে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার আগে এবং খেলারদিন তাদের বিশেষ ডিউটি পড়ে ৷
নিয়ম করে পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে ঘোড়াগুলি দিনে দু’বার ময়দানে টহল দেয় ৷ কিন্তু রবিবার তাদের দীর্ঘদিনের সঙ্গী ভয়েস অফ রিজনসের মৃত্যুর পর আস্তাবলের বাকি ঘোড়াগুলি ডিউটিতেই যেতে চাইছে না বলে জানা গিয়েছে ৷ এছাড়াও সোমবার রাত থেকে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করা এবং দৈনন্দিন আচরণের মধ্যেও অনেকটা পরিবর্তন এসেছে বলে সূত্রের খবর ৷
আরও পড়ুন:কোহলির জন্মদিন ও ভারতের জয়ের সেলিব্রেশনে ইডেনে দেদার শব্দবাজি, প্রাণ গেল কলকাতা পুলিশের ঘোড়ার
এই বিষয়ে কলকাতার মাউন্টেড পুলিশের অন্যান্য কর্মীরাও হতাশ ৷ সেই সঙ্গে এই বিষয়ে লালবাজারের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের একাংশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে ৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছু কলকাতা পুলিশের এক পুলিশ কর্মী বলেন, ‘‘ঘোড়াদের সঙ্গে আমরা দিনের অধিকাংশ সময় কাটাই ৷ ওদের সঙ্গে বছরের পর বছর মিলেমিশে কাজ করি ৷ ওরা আমাদের একপ্রকার সন্তান তুল্য হয়ে উঠেছে ৷ আর ইডেন গার্ডেন্সের পার্কিং সামনে এই প্রকারের শব্দবাজি ও সেল ফাটানো হল ও তার ফলে মৃত্যু হল কলকাতা পুলিশের একটি ঘোড়ার ৷ তা নিয়ে কোনও পদক্ষেপ তো দূরের কথা, বরং কোনও অভিযোগ পর্যন্ত দায়ের হল না কেন ?’’ বর্তমানে এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে কলকাতার মাউন্টেড পুলিশের অন্দরে ৷
কলকাতা মাউন্টেড পুলিশের প্রথম ঠিকানা 138 এসএন ব্যানার্জি রোড ও দ্বিতীয় আলিপুর বডিগার্ড লাইন্স ৷ এছাড়াও, ঘোড়াদের প্রশিক্ষণের জন্য 2006 সালে কলকাতা ময়দানে একটি হর্স রাইডিং স্কুলও তৈরি হয়েছে ৷ লালবাজারের ইতিহাস বলে যে, কলকাতা পুলিশ কমিশনারেটের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল 1856 সালে ৷ তবে, তারও 16 বছর আগে থেকে, 1740 সালে তৈরি হয়েছিল কলকাতা পুলিশের মাউন্টেড পুলিশ বাহিনী ৷ আগে শহরের রাস্তায় মারপিট-দাঙ্গাহাঙ্গামা থামাতে ঘোড়ায় চড়ে টহল দিত পুলিশ ৷ কোমরে থাকত খাপে ভরা পিস্তল ও দশ রাউন্ড গুলিভরতি পাউচ ৷ এই বাহিনীর পোশাকি নাম মাউন্টেড পুলিশ ৷
আরও পড়ুন:ধনকড়কে পশ্চাদদেশ দেখানোর খেসারত ? সাধারণতন্ত্র দিবসে বাদ শতাব্দী প্রাচীন ঘোড়া পুলিশ
লালবাজারের অন্য একটি ইতিহাস বলে, 1842 সাল নাগাদ ময়দান এলাকা জুড়ে হঠাৎই মাথাচারা দিয়ে উঠেছিল ঠগ, চোর, ও ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বদমেজাজি সৈন্যদের উপদ্রব ৷ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল প্রশাসন ৷ সেই বছর থেকেই ময়দানে টহলদারির দায়িত্ব পড়েছিল ঘোড়সওয়ার বাহিনীর উপর ৷ দায়িত্বের পাশাপাশি, বহরেও বেড়েছিল বাহিনী ৷ তিন থেকে এক ধাক্কায় সংখ্যা বেড়ে 12 হয়েছিল ৷ নেতৃত্বে একজন জমাদার আর একজন দফাদার ছিলেন ৷ তাঁদের পরনে গাঢ় সবুজ রঙের চাপকান, সাদা পায়জামা, বুট ও মাথায় লাল পাগড়ি থাকত ৷