পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / state

কী কারণে পাঁচিলের প্রয়োজন, স্পষ্ট করল বিশ্বভারতী

গতকাল একটি প্রেস বিবৃতি জারি করে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ ৷ সেখানে বিস্তারিতভাবে জানানো হয় কেন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বিভিন্ন এলাকাসহ পৌষ মেলার মাঠে পাঁচিল নির্মাণ জরুরি ৷ পড়ুয়াদের নিরাপত্তার পাশাপাশি চন্দন কাঠ চুরি, সংগ্রহশালা থেকে মূল্যবান সামগ্রী চুরি ও বহিরাগতদের অনুপ্রবেশের বিষয়টি তুলে ধরা হয় ৷

By

Published : Aug 25, 2020, 4:14 PM IST

Updated : Aug 25, 2020, 4:36 PM IST

visva bharati wall incident
বিশ্বভারতীতে পাঁচিল নিয়ে বিবাদ

শান্তিনিকেতন, 25 অগাস্ট : ঐতিহ্যবাহী পৌষমেলার মাঠ পাঁচিল দিয়ে ঘেরাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি উত্তাল রাজ্য রাজনীতি ৷ অভিযোগ উঠেছে, চতুর্দিক পাঁচিল দিয়ে ঘিরে গুরুদেবের বিশ্বভারতীকে অচলায়তনে পরিণত করা হচ্ছে ৷ এটা রবীন্দ্র আদর্শের পরিপন্থী বলে মনে করছেন আশ্রমিক থেকে পড়ুয়া, অধ্যাপক-অধ্যাপিকা থেকে শুরু করে স্থানীয়দের একাংশ ৷ কিন্তু, কেন পৌষমেলার মাঠ বা বিশ্বভারতীর একাধিক এলাকাকে বিভিন্ন সময় পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কর্তৃপক্ষের তরফে ৷

একনজরে বিশ্বভারতীতে পাঁচিল নিয়ে বিবাদ
একনজরে বিশ্বভারতীতে পাঁচিল নিয়ে বিবাদ

উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের পর গতকাল একটি বিবৃতি জারি করা হয় বিশ্বভারতীর তরফে ৷ যেখানে স্পষ্ট করা হয়, পাঁচিল দেওয়ার কারণ ৷ সেখানে বলা হয়,

  • সাম্প্রতিক অতীতে মেয়েদের হস্টেলে ঢুকে বহিরাগত দুষ্কৃতীরা একজনকে খুন করে ৷ এক দম্পতি আশ্রম চত্বরে আত্মঘাতী হন ৷ যাতে বহিরাগতদের দ্বারা আশ্রমের আর কেউ আক্রান্ত না হন, তাই পড়ুয়াদের সুরক্ষার খাতিরে পাঁচিল দেওয়া জরুরি ৷
  • অপ্রীতিকর ঘটনা যার জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট হতে পারে, তা এড়াতে পাঁচিল দেওয়া প্রয়োজন ৷
  • বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে চন্দন কাঠ চুরি রুখতে পাঁচিল দেওয়া দরকার ৷
  • সংগ্রহশালা থেকে মূল্যবান সামগ্রীর চুরি রুখতে, সেগুলি সুরক্ষিত রাখতে পাঁচিল দেওয়া জরুরি ৷
  • যবে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একটি রেস্তরাঁ তৈরি হয়েছে, তখন থেকে বহিরাগতরা সেখানে আসতে শুরু করেছে ৷ সেখানে প্রতিমা হস্টেলের আবাসিক এবং সংগীত ভবনের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয় বলে একাধিকবার অভিযোগ এসেছে ৷ এইসব রুখতে পাঁচিল দেওয়া প্রয়োজন ৷
  • নিজেদের ইচ্ছায় পাঁচিল নির্মাণ করছে না বিশ্বভারতী ৷ বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে একাধিক উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে ৷ সেই সব কমিটির সুপারিশ ও নির্দেশে পাঁচিল নির্মাণের কাজ করা হচ্ছে ৷
পৌষ মেলার মাঠে অস্থায়ী ক্যাম্পে ভাঙচুর

বিবৃতিতে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় পুরো ঘটনার জন্য দায়ী করা হচ্ছে উপাচার্য এবং কর্তৃপক্ষকে ৷ কর্তৃপক্ষের তরফে সতর্কতা জারি করার পরও এই ঘটনা ঘটে ৷ আশ্রমিক এবং অন্য যাঁরা রবীন্দ্র আদর্শের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে ভাবলে আমরা বাধিত হব ৷

উপাচার্যের বাসভবনের সামনে পড়ুয়াদের অবস্থান বিক্ষোভ

উপরে উল্লেখিত বিবৃতির সঙ্গে একটি রিপোর্টও জুড়ে দেয় কর্তৃপক্ষ ৷ 2004 থেকে বিশ্বভারতীর বিভিন্ন এলাকায় কেন পাঁচিল বা ব্যরিকেড দেওয়া হয়েছে সেই সংক্রান্ত তথ্য এই রিপোর্টে রয়েছে ৷ সেখানে উল্লেখ -

1. নিম্নলিখিত কারণে বিশ্বভারতীর বিভিন্ন এলাকায় পাঁচিল বা বেড়া দেওয়ার বিষয়টি সামনে আনা বা তা নিয়ে বিশেষ একটা আলোচনা করা হয়নি ৷

2. বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ 22 কিলোমিটারের বেশি এলাকা এবং মূল মূল এলাকাগুলিকে প্রায় ঘিরে ফেলা হয়েছে ৷ এই মুহূর্তে 3 কিলোমিটার পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলার কাজ করছে ৷ আরও 5 কিলোমিটার পাঁচিল দিয়ে ঘেরার পরিকল্পনা রয়েছে ৷

3. 2004 সাল পর্যন্ত কয়েকটি বিশেষ ভবন ও এলাকা যেমন রবীন্দ্রভবন, চিনা ভবন, মেয়েদের হস্টেলগুলি, 2-3 খেলার মাঠ ছাড়া বিশ্বভারতী চত্বরে আর কোথাও কোনও পাঁচিল ছিল না ৷

জেলাশাসকের সঙ্গে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের বৈঠক

4. 2004 সালের মার্চে নোবেল চুরির ঘটনা ঘটে ৷ এরপর একাধিক উচ্চ পর্যায়ের কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ও বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অনধিকার প্রবেশ রুখতে কাজ করে ৷ প্রথম এই সংক্রান্ত রিপোর্ট জমা করেছিল হাই পাওয়ার্ড এক্সপার্ট কমিটি অন সিকিউরিটি (2004) ৷ কমিটির মাথায় ছিলেন CBI-এর প্রাক্তন জয়েন্ট ডিরেক্টর ৷ এছাড়াও কমিটিতে ছিলেন রিটায়ার্ড IAS হরিপদ রায়, KoPT-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান, রিটায়ার্ড ব্রিগেডিয়ার এস কে ভট্টাচার্য এবং ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের প্রাক্তন ডিরেক্টর-সেক্রেটারি শ্যামলকান্তি চক্রবর্তী ৷ এরপর রিপোর্ট জমা করেছিল UGC কমিটি অন অগমেন্টেশন অফ সিকিউরিটি ইন বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস (2004) ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে এই প্রেক্ষিতে 2005 থেকে 2025 সাল পর্যন্ত 20 বছরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল ৷ এছাড়া 2006 সালের 26 ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগজ়িকিউটিভ কাউন্সিলের তরফে সংকল্প নেওয়া হয়েছিল ৷

5. এই সমস্ত রিপোর্টের প্রেক্ষিতে, জেলা প্রশাসনের সুপারিশে 2004-05 অর্থবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে পাঁচিল নির্মাণের কাজ শুরু হয় ৷ কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে 10 কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয় ৷ কিন্তু স্থানীয়দের বিরোধ ও অনধিকারপ্রবেশের জেরে 2008-09 অর্থবর্ষ পর্যন্ত ধীর গতিতে কাজ হয় ৷

6. 2008 সালের জানুযারি মাসে দিনের আলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আনন্দ সদন হস্টেলে সংগীত ভবনের ছাত্রী (শাশ্বতী পাল) খুনের পর পড়ুয়াদের নিরাপত্তার দাবি উঠতে শুরু করে ৷ তখন আবার পাঁচিল নির্মাণকাজে গতি আসে ৷

7. এই সবের পাশাপাশি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম তৎকালীন রাজ্যপাল তথা বিশ্বভারতীর রেক্টর গোপালকৃষ্ণ গান্ধির নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেন ৷ এই কমিটি 2006 সালে একটি রিপোর্ট জমা করে ৷ 2006 সালের 11 সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি নিজে একটি অ্যাডভাইজারি ইশু করেন ৷ 30 সেপ্টেম্বর CAG স্পেশাল পারফর্মেন্স অডিট অন সিকিউরিটি অফ অ্যাসেটস অফ বিশ্বভারতী তাদের রিপোর্ট জমা করে ৷

জনমত সংগ্রহ করতে বাড়ি বাড়ি যান পুলিশ সুপার

8. পাঁচিল, রাস্তা, বাস্তু, পরিবেশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ইত্যাদি একাধিক ইশুতে স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে আশ্রমিক, পড়ুয়া, স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধির নিজেদের মতামত দিয়েছেন ৷ দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকেও এই নিয়ে অনেক নামকরা ব্যক্তিত্বরাও তাঁদের মতামত দিয়েছেন ৷ রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধির নেতৃত্বাধীন কমিটিতেও অনেকে পক্ষে-বিপক্ষে নিজেদের মতামত দিয়েছিলেন ৷ পরবর্তীকালে 2010-11 সালে তৎকালীন রাজ্যপাল তথা বিশ্বভারতীর রেক্টর এম কে নারায়ণন নিজেও সেগুলি খতিয়ে দেখেছেন ৷

9. কিছুক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তরফেও পড়ুয়া, আশ্রমিক, জনসাধারণ, জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্য খতিয়ে দেখা হয়েছে ৷ 19 তারিখ বোলপুরে SDO অফিসে যে মিটিং হয়েছে সেখানেও বর্তমান আশ্রমিক ও বিক্ষোভকারীদের কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন ৷ তাঁদের বক্তব্যও শোনা হয়েছে ৷ মহকুমা আধিকারিক নিজে শুনেছেন ৷ এছাড়াও পাঁচিল ইশুতে পঞ্চায়েত সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পৌরসভার সঙ্গেও মিটিং করা হয়েছে ৷

10. 2011 সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র অতিথিগৃহে তৎকালীন রাজ্যপাল তথা বিশ্বভারতীর রেক্টর এম কে নারায়ণন নিজেও অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন ৷ যে সমস্ত জায়গায় পাঁচিল নির্মাণের কাজ চলছিল সে সব জায়গা ঘুরে দেখেছিলেন ৷ তৎকালীন বিক্ষোভকারী গোরা সর্বাধিকারী, নবকুমার মুখোপাধ্যায়, শুভদ্রা রায় এবং অন্যদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন ৷ তাঁর নির্দেশে সেসময় নির্মাণ কাজ কয়েকমাস বন্ধ রাখা হয়েছিল ৷

11. সবদিক খতিয়ে দেখে এবং বিশ্বভারতীর এগজ়িকিউটিভ কাউন্সিলের রেজোলিউশন অনুযায়ী তৎকালীন উপাচার্য একটি অ্যাডভাইজারি ইশু করেছিলেন ৷ তার পর থেকেই সেটাই অনুসরণ করা হচ্ছে ৷

12. পাঁচিল নির্মাণ নিয়ে নিজেদের মতামত লিখিতভাবে জমা দিতে পারেন বিক্ষোভাকারীরা ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে তাঁদের বক্তব্য খতিয়ে দেখা হবে ৷ অ্যাডভাইজ়ারি অনুযায়ী যদি সেগুলির মধ্যে কোনওটি গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত হয় তাহলে তা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করা হবে ৷ কিন্তু নিরাপত্তা বা পড়ুয়াদের সুরক্ষার বিষয়ে কোনও আপোষ করা হবে না ৷ কারণ আমরা চাই না বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আর কোনও ছাত্রী খুন হোক বা ক্যাম্পাসে চুরির ঘটনা ঘটুক ৷

এছাড়াও সংশ্লিষ্ট প্রেস বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়েছে, এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের পরিস্থিতি ভালো নয় ৷ কর্মী, অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে ৷ মহিলা কর্মীদের উদ্দেশ্যে কটূকথা বলা হচ্ছে ৷ এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে অফিস এসে কাজ করা তাঁদের জন্য ঠিক হবে না ৷ তাই এই মুহূর্তে তাঁরা বাড়ি থেকে কাজ করবেন ৷ বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য 31 তারিখ রিভিউ মিটিং করা হবে ৷

Last Updated : Aug 25, 2020, 4:36 PM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details