রানিবাঁধ, 10 মে : বাংলার রাজনীতি নিয়ে যখনই চর্চা হয় তখনই বারবার ঘুরে ফিরে আসে জঙ্গলমহলের নাম ৷ বাঁকুড়ার রানিবাঁধ, রাইপুর থেকে শুরু করে ঝাড়গ্রাম, লালগড়, বেলপাহাড়ি ... একটা সময় ছিল যখন এসব জায়গার নাম শুনলে গায়ে কাঁটা দিত ৷ মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চল ছিল এইসব এলাকা ৷ গামছা দিয়ে মুখ ঢাকা, কাঁধে বন্দুকধারী লোকগুলোর ভয়ে ঘর থেকে বেরোনো যেত না ৷ বন্দুকের নলই একসময় শেষ কথা বলত এখানে ৷
বন্দুকের নলের সেই সন্ত্রাস আজ আর নেই এখানে ৷ পাল্টেছে সরকারও ৷ বাম শাসনের অবসান হয়েছে ৷ জঙ্গলমহল আজ তাদের হয়ে কথা বলার জন্য প্রতিনিধি পাচ্ছে মমতার মন্ত্রিসভায় ৷ দিদির মন্ত্রিসভায় এক-দু'জন নয়... তিনজন মন্ত্রী জঙ্গলমহল থেকে ৷ সন্ধ্যারানি টুডু, জ্যোৎস্না মান্ডি ও বীরবাহা হাঁসদা ।
মানচিত্রে জঙ্গলমহল বলে কোনও জায়গার অস্তিত্ব নেই ৷ সাধারণভাবে রাজনীতির পরিভাষায় বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর -- এই চার জেলার 12 টি আসনকে মিলিয়ে জঙ্গলমহল বলা হয়ে থাকে ৷ এবারের ভোটে জঙ্গলমহলের উপর দিয়ে সবুজ কালবৈশাখী বয়ে গিয়েছে ৷ 10 টি আসনেই তৃণমূলের জয়জয়াকার ৷ 2 টি আসন জিতেছে বিজেপি ৷
কিন্তু বছর দু'য়েক আগেও সমীকরণ এতটা সহজ ছিল না ৷ ইউক্যালিপটাস, শাল, শিমুলে ঘেরা পশ্চিমের এই প্রান্তিক এলাকাগুলি জোড়া ফুল ছেড়ে পদ্মকে আঁকড়ে ধরেছিল উনিশের লোকসভা ভোটে । ভরাডুবি হয়েছিল তৃণমূলের ৷ জঙ্গলমহল মূলত আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা ৷ কুড়মি, মাহাত জনজাতির ভোটার সংখ্যা সবথেকে বেশি ৷ বলতে গেলে তাঁদের ভোটেই ভরাডুবি হয়েছিল তৃণমূলের ৷ এবার একুশের বিধানসভা নির্বাচনে এই জনজাতিগুলির ভোট পদ্ম ছেড়ে পড়েছে ঘাসফুলে ৷ তাও মাত্র দু'বছরের ব্যবধানে ৷ এমনকি জঙ্গলমহলে দিলীপ ঘোষের নিজের গ্রামেও পিছিয়ে পড়েছে বিজেপি ৷
এখন আর ফাঁকা রাস্তায় বেরোতে ভয় নেই জঙ্গলমহলের মানুষের আরও পড়ুন : জেল থেকে গণতন্ত্রের পূজারি, অন্য এক ছত্রধরের উত্থান
মমতার কোন জাদুকাঠির স্পর্শ লাগল জঙ্গলমহলে ?
উন্নয়ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকার যে কথা অনুব্রত মণ্ডল বলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় জঙ্গলমহলে ঢুকলে ৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেকেই এমনটা বলে থাকেন ৷ বদলে গিয়েছে হালচাল ৷ রাস্তাঘাট বদলেছে ৷ পিচের রাস্তা হয়েছে ৷ তাঁদের উপাস্য দেবতার থানও সংরক্ষণ হয়েছে ৷
এখন আর জঙ্গলমহলে বন্দুকের গুলির আওয়াজে ঘুম ভাঙে না ৷ রাত-বিরেতে বেরোতে ভয় নেই ৷ পিঁপড়ের ডিম আর বুনো শাকপাতা সেদ্ধ করে খাওয়া মানুষগুলোর পেটে আজ ভাত জুটছে ৷ মাথার উপরে চাল হয়েছে ৷ শান্তি ফিরেছে জীবনে ৷ এটাই হয়ত চেয়েছিলেন জঙ্গলমহলের মানুষ ৷
মাওবাদীদের থেকেও একেবারে মুখ ফিরিয়ে নেননি মমতা ৷ তাঁদের অনেককেই সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনেছেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ যাঁরা আত্মসমর্পণ করেছেন, বন্দুক নামিয়ে রেখেছেন; তাঁদের চাকরি দিয়েছেন মমতা ৷ মাওবাদী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছেন ৷
এখন আর গামছায় মুখ ঢাকা লোকেরা বন্দুক হাতে আসে না ভয় দেখাতে জঙ্গলমহলের খেলাধুলোকে প্রাধান্য দিয়েছে রাজ্য সরকার ৷ তৈরি হয়েছে স্টেডিয়াম ৷ তৈরি হয়েছে তফসিলি উপজাতি উন্নয়ন পরিষদ থেকে একলব্য মডেল স্কুল ৷ যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে তথ্যপ্রযুক্তি সবেতেই এখন অনেকটাই কুশল এই প্রান্তরে । তফসিলি উপজাতিদের জন্য উন্নয়ন পরিষদ এই মহলের লোক আগে কখনও ভাবতে পারেননি ।
জনসাধারণের কমিটির নেতা ছত্রধর মাহাত সাজা কাটিয়ে ছাড়া পাওয়ার পর তৃণমূলে জায়গা পেয়েছেন ৷ জঙ্গলমহলে তৃণমূলের গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁর উপর ৷ সেটাও জঙ্গলমহল জয়ের একটা বড় কারণ হিসেবে মনে করছেন অনেকে ৷
আরও পড়ুন : রুক্ষ জঙ্গলমহল আবাদে মুক্তির পথ দেখাচ্ছে "ঊষর মুক্তি"
তাছাড়া আবার যদি গামছার আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুখ-মুখোশের খেলা শুরু হয়, আবার যদি শুরু হয় গভীর অরণ্যে নিয়ে গিয়ে চোখ রাঙানি... না, সেইসব অশান্তি চান না এখানকার মানুষজন ৷ তাই হয়ত মমতাতেই ভরসা এবারেও ।
তবে উনিশের লোকসভা নির্বাচনে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণ জানতে চাওয়ায় এলাকাবাসীরা বলছেন, অন্য সরকার আসলে আরও বেশি উন্নয়ন হবে বলে আশা করেছিলেন তাঁরা ৷ কিন্তু দুই বছরেই তাঁরা বুঝে গিয়েছেন, তা ভুল ধারণা ছিল ৷ এমনই বলছেন জঙ্গল মহলের এক বাসিন্দা রবীন রায় ।
পিঁপড়ের ডিমের বদলে এখন জঙ্গলমহলের গ্রামে চড়ছে ভাতের হাঁড়ি যেহেতু এখানকার একটি বড় অংশের মানুষ তফসিলি উপজাতিভুক্ত, সেই কারণে এনআরসি-ভীতিও একটি বড় ফ্যাক্টর হয়েছে বলে জানাচ্ছেন অনেকে ৷ জঙ্গলমহলের বাসিন্দা সঞ্জয় মান্ডি বলছেন, "বিজেপির এনআরসি এখানকার মানুষের কাছে হয়ত বিভীষিকা হয়ে উঠতে পারত ৷ তাই তাঁরা সোজাসুজি আস্থা রেখেছেন তৃণমূল শিবিরেই ।"
আরও একটি যুক্তি উঠে আসছে ৷ টাকার লোভ ৷ জঙ্গলমহলেরই একাংশ বলছে, মানুষ টাকার লোভে পরিবর্তন চেয়েছিল ৷
বাঁকুড়ার রানিবাঁধ বিধানসভা কেন্দ্রের 33 শতাংশ আদিবাসী ভোটের 20 শতাংশই গিয়েছে তৃণমূলে । মানুষ আরও একবার আস্থা রাখল সবুজ শিবিরে ৷ মমতাও তিনজন মন্ত্রী দিলেন জঙ্গলমহলকে ৷ স্থানীয়দের আশা, এবার আরও বেশি উন্নয়ন হবে ৷
আরও পড়ুন : কেমন আছে জঙ্গলমহল ?
জঙ্গলমহলের রাজনীতিকে যাঁরা খুব কাছে থেকে দেখেছেন, তাঁরা বলছেন জঙ্গলমহলের মানুষের মধ্যে যে রক্ত রাগ জমেছিল, তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে নয় ৷ স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে । কারণ 2011 সালে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার আসার পর ওই অঞ্চলগুলিতে ব্যাপকভাবে উন্নয়নের কাজ হয়ে থাকলেও মানুষের ক্ষোভ ছিল স্থানীয় নেতাদের ঔদ্ধত্য এবং সরকারের তরফে যে প্রকল্পগুলি আসছে তাতে নেতাদের অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ । উন্নয়নের কাজে মানুষ খুশি হলেও স্থানীয় নেতাদের ঔদ্ধত্যে সেখানকার মানুষ ক্ষুব্ধ ছিলেন ।
তৃণমূলকে ওই অঞ্চলে এগিয়ে থাকতে সাহায্য করেছে, তা হল সেখানকার আদিবাসী সংগঠনগুলি ৷ ওই অঞ্চলে তৃণমূল সারনা ধর্মকে একটি আলাদা ধর্মের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে । অন্যদিকে বিজেপি আদিবাসীদের হিন্দু হিসেবে রেজিস্টার করাতে চেয়েছে । এই বিষয়টি ভীষণভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল ওখানের আদিবাসী ভোট ব্যাঙ্কের মধ্যে ।
এরপর উনিশের ভোটে তৃণমূল কংগ্রেস এক্কেবারে মুখ থুবড়ে পড়ার পর নিজেদের ভুল বুঝে ব্যাপক সাংগঠনিক উন্নতি করে । প্রতিটি ব্লকে যে স্থানীয় মুখগুলির বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল সেই মুখগুলিকে সরিয়ে দেওয়া হয় । ব্লক নেতৃত্ব পরিবর্তন করা হয় । নতুন মুখ সামনে আনা হয় । ফলে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে যে ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল সেগুলি আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকে ।
এই বিষয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, "মানুষকে সাময়িকভাবে ভুল বোঝানো যায় ৷ চিরকালের জন্য তাঁকে ভুল বোঝানো যায় না । মানুষ দেখেছে বাম জমানায় আমলাশোলে মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছেন । জঙ্গলমহলের চূড়ান্ত দুর্দশা ও সন্ত্রাস । যেমন কোনও উন্নয়ন হয়নি ৷ তেমনি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সন্ত্রাস । অন্যদিকে সেখানে তৃণমূল সরকার দুটো কাজ করেছে । তারা প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে উন্নয়নের কাজ করেছে । পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নতি ঘটিয়েছে । সন্ত্রাসের অবসান ঘটেছে । জঙ্গলমহলের পর্যটকদের ভিড় বেড়েছে । মহিলারা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর বিরাট ভাবে উপকৃত হয়েছেন । একসময় মাওবাদীরা বলেছিল সশস্ত্র বিপ্লব; এবার তৃণমূল উন্নয়নের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে নিঃশব্দ বিপ্লব । পাশাপাশি ওখানকার মানুষ দেখেছেন মোদি সরকার তাঁদের জন্য কিছু করেনি । তাঁদের কোনও উন্নয়ন করেনি । তাই এবার তাঁরা মুক্ত হস্তে তৃণমূলকে আবার ভোট দিয়েছেন ।"