হায়দরাবাদ, 18 জুলাই : একটি ছেলে, গায়ের রং কালো ৷ দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ প্রদেশের ছোট্ট গ্রামের মাঠে গবাদি পশু চরাত, আশপাশের বাচ্চাদের সঙ্গে ৷ ছেলেটির নাম রোলিহালালা ৷ বাবা-মা লেখাপড়া জানেন না, কিন্তু মা তাকে একদিন কাছের একটি খ্রিশ্চান স্কুলে ভর্তি করে দেন ৷ ব্যাপটিজমের পর তার নাম বদলে হল নেলসন ম্যান্ডেলা ৷ হ্যাঁ, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রত্যন্ত গ্রামের ছোট ছেলেটি যে একদিন পৃথিবী বদলে দেবে, কে জানত ? আজ তাঁর জন্মদিন ৷ 1918 সালের 18 জুলাই জন্মগ্রহণ করেন তিনি ৷
স্কুলের পাঠ শেষ করে থেম্বুল্যান্ডে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকাবাসীদের জন্য সবচেয়ে বড় স্কুলে পড়তে আসেন ৷ সেখানে প্রধানশিক্ষক খালি ইউরোপীয় সংস্কৃতির উপর জোর দিতেন, এর ফল হল উল্টো ৷ আফ্রিকার নিজের ইতিহাস জানতে ইচ্ছে হল ম্যান্ডেলার ৷
এর পর উইটওয়াটারস্ট্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়তে ভর্তি হন ভবিষ্যতের কৃষ্ণাঙ্গ নেতা ৷ এখানে তিনিই একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র ছিলেন, স্বভাবতই বর্ণবৈষম্যের মুখোমুখি হন ৷ বন্ধুত্ব হয় লিবেরাল আর কমিউনিস্ট ইউরোপীয়, ইহুদি, ভারতীয় ছাত্রদের সঙ্গে ৷ ধীরে ধীরে রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন নেলসন ৷ 1943-র অগস্টে বাস ভাড়া কমানোর দাবিতে বাস বয়কটের মিছিলে হাঁটলেন কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রটি ৷ 1944-এর ইস্টারের রবিবারে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস ইউথ লিগ (ANCYL) প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সদস্য ছিলেন তরুণ ম্যান্ডেলা ৷ মনের গভীরে থাকা বিদ্রোহের বীজ যেন আলো, জল আর বাতাস পেল ৷
আরও পড়ুন : আগল ভেঙে পথের দিশারী কাদম্বিনী
1952 সালে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের আইনজীবী হিসেবে কাজের শুরু হয় ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে, এএনসি-র সদস্যদের নিয়ে ৷ প্রতিষ্ঠা হয় প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ল ফার্ম "ম্যান্ডেলা অ্যান্ড টাম্বো" ৷ তবে সে বছরের জুলাইতে তাঁকে জোহানসবার্গে গ্রেফতার করা হয় ৷ ততদিনে ম্যান্ডেলা বিদ্রোহী কৃষ্ণাঙ্গ নেতা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন ৷ তাঁর এএনসি-র দলের সদস্যসংখ্যা এক লক্ষ ছাড়িয়েছে ৷ এর পরেরটা ইতিহাস ৷
1964 থেকে 1982, দীর্ঘ 18 বছর কেপ টাউনের রবেন আইল্যান্ডের জেলে বন্দি ছিলেন ৷ তার পর তাঁর মুক্তি নিয়ে নানা টালবাহানা চলতে থাকে ৷ শেষে 1990-এর 11 ফেব্রুয়ারি তাঁকে পুরোপুরি মুক্তি দেয় দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ৷ জেলে বন্দি থাকাকালীন বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর আন্দোলনের জন্য তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা-সহ সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ৷
1994-99 দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হন ৷ 1999-তে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে গেলেও আন্তর্জাতিক শান্তি বজায় রাখার বিষয়ে বিভিন্ন ভাবে কাজ করে গিয়েছেন ৷ 1999-এ প্রতিষ্ঠা করেন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশনের ৷ 1993 সালে ডে ক্লার্কের সঙ্গে যৌথ ভাবে শান্তির জন্য নোবল পুরস্কার পান নেলসন ম্যান্ডেলা ৷ 2013 সালের 5 ডিসেম্বর প্রয়াত হন রোলিহালালা ৷
আজ তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস ৷ বিংশ শতকের একটা ছোট্ট ছেলে একুশ শতকের রূপকার হবে, স্বপ্নের মতো হলেও তা প্রমাণ করে গিয়েছেন তিনি ৷ 2009-এ রাষ্ট্রপুঞ্জ প্রথম এই দিনটি উদযাপনের কথা স্থির করে ৷ 2010 সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে ৷
নিজের জীবনের উপলব্ধি প্রকাশ করে ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, "বাঁধনগুলো আলগা করলেই স্বাধীন হওয়া যায় না, কিন্তু অন্যের স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা আর গুরুত্ব দিতে শেখাই স্বাধীন ভাবে বাঁচার উপায় ৷" তবে তাঁর লড়াইয়ের এত বছর পরও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বর্ণবিদ্বেষের ঘটনা ঘটে চলেছে ৷ কখনও কৃষ্ণাঙ্গ বলে পুলিশের মার ৷ কখন খেলার মাঠে খেলোয়াড়ের উদ্দেশে কটু মন্তব্য ৷ তাই, আজ তাঁর জন্মবার্ষিকীতে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর আন্দোলন সত্ত্বেও কি তা থেকে মুক্ত হয়েছে সমাজ, মানুষ, সভ্যতা ?