কলকাতা, 22 জুন : ক্রমেই রহস্য বাড়ছে ছাত্রী কৃত্তিকা পালের মৃত্যু ঘিরে । নেহাতই আত্মহত্যা না এর পিছনে অন্য কোনও রহস্য, ঘটনার 24 ঘণ্টা পরেও সেই উত্তরই হাতড়ে বেড়াচ্ছেন তদন্তকারীরা । যদিও প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে, আত্মহত্যাই করেছে ক্লাস টেনের এই ছাত্রী ।
গতকাল দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শৌচালয় থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছিল কৃত্তিকাকে । কিন্তু, কেন এমন পরিণতি হাসিখুশি স্বভাবের মেয়েটির ? সেই প্রশ্নই খুঁজতে গিয়ে উঠে আসছে একাধিক তথ্য । কৃত্তিকার সহপাঠীরা জানাচ্ছে, ঘটনার দিন ক্লাসে কোনওরকম অস্বাভাবিকতা দেখা যায়নি তার মধ্যে । প্রথম পাঁচটি ক্লাসে বেশ চনমনেই দেখাচ্ছিল তাকে । কিন্তু, তারপরই হঠাৎই পরিবর্তন দেখা যায় তার চোখেমুখে । মাথাব্যথা করছে বলে ছয় নম্বর ক্লাসটি না করে সিক রুমে চলে যায় সে । সেসময়ের CCTV ফুটেজ খতিয়ে দেখতেই উঠে আসছে নানা প্রশ্ন ।
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, সেসময় শৌচালয়ের দিকে যাচ্ছিল কৃত্তিকা । কিন্তু, কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছিল সে । প্রাথমিকভাবে তদন্তকারীদের অনুমান, ব্লেড ও প্লাস্টিক জাতীয় কিছু । যদিও এখনও পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কিছুই জানাতে পারছেন না তাঁরা ।
এই সংক্রান্ত আরও খবর :কলকাতার নামী স্কুলের বাথরুমে রক্তাক্ত ছাত্রী, নার্সিংহোমে মৃত্যু
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, শৌচালয়ের দরজা ভিতর থেকেই বন্ধ ছিল । আর তাই আত্মহত্যার তত্ত্বটির উপরই গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তাঁরা । কিন্তু, এখানেই উঠে আসছে আর একটি প্রশ্ন ।
কৃত্তিকার মুখে প্লাস্টিক জড়াল কে ? নিজেই নিজের মুখে প্লাস্টিক জড়িয়ে শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করেছিল ? যদিও তা করার মতো ক্ষমতা কৃত্তিকার ছিল না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে আসছে । আর এখানেই তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতির প্রসঙ্গটি জোরালো হচ্ছে । সন্দেহ তৈরি হচ্ছে উদ্ধার হওয়া সুইসাইড নোটটি ঘিরে । কৃত্তিকা নিজেই সেই নোটটি লিখেছিল কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে । বিচার করা হচ্ছে হাতের লেখা ।
এপ্রসঙ্গেই উঠে আসছে, কৃত্তিকার পারিবারিক সম্পর্কের প্রসঙ্গ নিয়ে । বাবা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়র । হায়দরাবাদে কর্মরত । স্বাভাবিকভাবেই মেয়ের মৃত্যু সংবাদে আকস্মিকতা হারিয়েছেন বাবা-মা । গতকাল রাতেই তেলাঙ্গানা থেকে শহরে ফিরেছেন । তাঁরা জানাচ্ছেন, বেশ কিছুদিন ধরেই না কি ছিল মেধাবী ছাত্রীটি । ভালো স্কুলে ভরতি হওয়ার একটা চাপ তার মধ্যে কাজ করত । ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটে পড়তে চায় সে । মেধাবী কৃত্তিকার মনের উপর এটা বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছিল কি না সেই প্রশ্নই উঠে আসছে । কারণ প্রায়শই বাবা-মায়ের এই প্রসঙ্গই উত্থাপন করত কৃত্তিকা । এমনকী, স্বপ্ন সার্থক করার লড়াইয়ে রাতের পর রাত দু'চোখের পাতা এক করতে পারত না অনেকসময়ে ।
স্কুলশিক্ষিকা থেকে শুরু করে অনেকের ধারণা, পড়াশোনার একটা চাপ তৈরি হচ্ছিল কৃত্তিকার মধ্যে । বিশেষ করে ইদানিং ক্লাস টেনে ও টুয়েলেভের পরীক্ষায় প্রচুর নম্বর পেয়েও মনের মতো স্কুলে সুযোগ পায়নি অনেকে । ক্লাস টেনের ছাত্রী কৃত্তিকা । তার মনেও এর চাপ পড়েছিল কি না সেই বিষয়টিও ঘুরেফিরে আসছে । পডু়য়াদের উদ্বেগের বিষয়টি দিনদিন যে মানসিক যন্ত্রণার কারণে পরিণত হচ্ছে তা বারবার মেনে নিয়েছেন মনোবিদরা । কৃত্তিকার ক্ষেত্রে পড়াশোনায় ভালো ফল করার চাপ, ভালো স্কুলে ভরতি হওয়ার চাপ, উচ্চশিক্ষায় সাফল্য পাওয়ার চাপ কীভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল সেইদিকটাও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা ।
আবার বাবা-মায়ের সম্পর্ক নিয়েও উঠে আসছে প্রশ্ন । বাব দীর্ঘদিন হায়দরাবাদে থাকতেন । বাবা-মায়ের এই দূরত্ব, বা তৃতীয় সম্পর্কের উপস্থিতি ছিল কি না সেই বিষয়টিও উঠে আসছে । কৃত্তিকাকে কোনওভাবে একাকীত্ব গ্রাস করেছিল কি না সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা । বাবার অনুপস্থিতিতে মা'কে কৃত্তিকাকে ঠিকমতো পাশে পেত কি না সে বিষয়টি ভাবাচ্ছে তদন্তকারীদের ।
প্রশ্ন হাজারও । প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন কলকাতা পুলিশের তদন্তকারীরা । দেহ পাঠানো হয়েছে ময়নাতদন্তে । সুইসাইড নোটে হাতের লেখা খতিয়ে দেখছেন হ্যান্ড রাইটিং বিশেষজ্ঞরা । প্রয়োজনে মনোবিদদের পরামর্শও নেওয়া হতে পারে । কৃত্তিকার সহপাঠী থেকে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গেও আলাদা-আলাদা করে কথা বলতে চান তদন্তকারীরা ।
এক-একটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার পরই তদন্ত গোটাতে শুরু করবেন তাঁরা । তারপরই মেধাবী ছাত্রী কৃত্তিকার মৃত্যুর আসল রহস্য সামনে বলেই মনে করছেন তাঁরা ।