লখনউ, 7 ডিসেম্বর : সেই ছোটো বন্ধ ঘরটায় এক চিলতে আলোও ঢুকত না ৷ ছিল না আকাশ দেখার অনুমতি ৷ অন্ধকার কুঠুরিতেই দিনের পর দিন চলত ধর্ষণ৷ কথা না শুনলেই শারীরিক নির্যাতন করা হত ৷ রায়বারেলির সেই বন্ধ ঘর থেকে যে যন্ত্রণার শুরু হয়েছিল তার ইতি ঘটে শুক্রবার রাত 11 টা 40 মিনিটে ৷ দিল্লির সফদরগঞ্জ হাসপাতালে মৃত্যু হয় উন্নাওয়ের নির্যাতিতার ।
2018 সাল, ডিসেম্বর মাস ৷ আজ থেকে দুই বছর আগে প্রথমবার ধর্ষণের শিকার হন নির্যাতিতা ৷ মাথায় বন্দুক রেখে শিবম (ঘটনায় যে অভিযুক্তের নাম বারবার উঠে এসেছে ) ও তার ভাই ধর্ষণ করে তাঁকে ৷ এই ঘটনার অভিযোগ জানিয়ে 5 ও 6 মার্চ দুটি FIR করেন নির্যাতিতা ৷ সেই বয়ানে রয়েছে তাঁর দীর্ঘমেয়াদি যন্ত্রণা ও অত্যাচার ৷ রায়বারেলির একটি ঘরে তাঁকে 'যৌনদাসী' বানিয়ে রাখা হয়েছিল ৷ প্রতিদিন চলত গণধর্ষণ ৷ আকাশ দেখার অনুমতি ছিল না তাঁর ৷ রায়বারেলির ওই ঘর থেকে বাইরে তাকালেই মারধর করা হত ৷ পাশাপাশি চলত অন্যান্য শারীরিক অত্যাচার ৷ তারপর গণধর্ষণ ৷ ধর্ষণের ভিডিয়ো বানিয়ে রেখেছিল শিবম ৷ সেই ভিডিয়োর হুমকি দিয়ে আবার ধর্ষণ করা হত তাঁকে ৷ বলা হয়েছিল, পুলিশে খবর দিলে আবার ধর্ষণ করা হবে ৷ সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হবে সেইসব ভিডিয়ো ৷ বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দিনের পর দিন তাঁর উপর নির্যাতন চালিয়ে গেছে শিবম ৷ রায়বারেলির লালগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন যুবতি ৷ ঘটনায় 2 অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ ৷
সম্প্রতি তারা জেল থেকে ছাড়া পায় ৷ রায়বারেলির আদালতে ধর্ষণ মামলার শুনানি ছিল৷ 5 ডিসেম্বর সাক্ষ্য দিতেই যাচ্ছিলেন নির্যাতিতা ৷ আদালতে যাওয়ার পথে তার উপর হামলা হয় ৷ শিবম ও আরও চারজন আঘাত আনে তার উপর ৷ রাস্তাতেই মারধর শুরু করা হয় তাকে ৷ শুরু হয় কোপানো ৷ চাকু দিয়ে প্রথমে তাঁর গলায় আঘাত করা হয় ৷ তারপর শরীরের অন্যান্য অংশেও ৷ তারপরই চূড়ান্ত আঘাত ৷ গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় ৷ অভিযুক্তরা পালিয়ে যায় ঘটনাস্থান থেকে ৷ শরীরের উপরের অধিকাংশই পুড়ে যায় ৷ সেই সময়ে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি কেউ ৷ দগ্ধ শরীর নিয়ে ছুটতে থাকেন তিনি ৷ শেষ পর্যন্ত এক পথচারীর থেকে ফোন নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে সাহায্য চান নির্যাতিতা ৷ স্থানীয় এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে ৷ সেখানে অবস্থার অবনতি ঘটলে সেদিনই দিল্লির সফদরগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় তাঁকে ৷ ভেন্টিলেটশনে রাখা হয়েছিল তাঁকে ৷ গতরাতে 11টা 40 মিনিটে শেষ হয় লড়াই, ইতি হয় এক যন্ত্রণাদগ্ধ জীবনের ৷
শনিবার দুপুরে দিল্লির সফদরগঞ্জ হাসপাতাল থেকে তাঁর দেহ নিয়ে উন্নাওয়ের উদ্দেশে রওনা হয়েছে তাঁর পরিবারের সদস্যরা ৷ নির্যাতিতার বাবা বলেছেন, "হায়দরাবাদের মত তাঁর মেয়ের হত্যাকারীদেরও গুলি করে মারা উচিত " ৷ কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা ভঢড়া গান্ধি নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে উন্নাও পৌঁছান ৷ তিনি উত্তরপ্রদেশ সরকারের অক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ৷ টুইট করে লেখেন , 'গণধর্ষণের পরও তাঁকে কেন সুরক্ষা দিল না উত্তরপ্রদেশ সরকার ? যে পুলিশ আধিকারিকরা FIR নিতে অস্বীকার করেছিল তাদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ করা হবে? উত্তরপ্রদেশে প্রতিদিন মহিলাদের উপর যে অত্যাচার হচ্ছে তার বিরুদ্ধে সরকার কেন কোনও পদক্ষেপ করে না?' উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব বিধানসভার সামনে অবস্থান বিক্ষোভ শুরু করেছেন৷ দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে যোগী সরকার ৷ নির্যাতিতার মৃত্যুর কয়েকঘণ্টার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ বলেন, "নির্যাতিতার মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক ৷ এই মামলার বিচার ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে হবে ৷ " কিন্তু বিরোধীদের প্রশ্ন, এখন মুখ্যমন্ত্রী ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচারের কথা বলছেন, তাহলে এতদিন কেন চুপ ছিলেন তিনি ৷ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উন্নাও প্রসঙ্গে টুইট করেন , 'নিষ্ঠুরতার শেষ নেই' ৷ হায়দরাবাদে এনকাউন্টারে চার অভিযুক্তের মৃত্যু গতকাল থেকে সাড়া ফেলেছে দেশে ৷ নিহত পশু চিকিৎসকের বাবা বলেছিলেন, "তাঁর মেয়ের আত্মা শান্তি পেল ৷" নির্ভয়ার মা বলেন, "অন্তত একটি মেয়ে তো সুবিচার পেল ৷" উন্নাওয়ের নির্যাতিতার মৃত্যু রাষ্ট্রে নৃশংসতার আর এক উদাহরণ তৈরি করেছে ৷ নারীসুরক্ষা নিয়ে ও বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে আরও একবার প্রশ্নের মুখোমুখি রাষ্ট্রব্যবস্থা ৷