রাজনীতির আঙিনায় সত্যাগ্রহ মহত্মা গান্ধির এক অনন্য অবদান । কোনও রক্তপাত ছাড়া আন্দোলন এর আগে খুব কমই দেখেছে বিশ্ব । মূলত অহিংসার পথ অনুসরণ করেই ভারত ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে । এই সত্যাগ্রহের মাধ্যমেই কয়েক কোটি ভারতবাসী ইংরেজদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল । তবে তাতে কোনও হিংসা ছিল না । সত্যাগ্রহ ভারতবাসীর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করেছিল । সাহস যুগিয়েছিল "ভারত ছাড়ো" স্লোগান তোলার ।
ডারবান ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ইউরোপিয়ান ম্যাজিস্ট্রেট গান্ধিকে দেখে তাঁর পাগড়ি খুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন । কিন্তু গান্ধি সে নির্দেশ মানলেন না । বরং এর প্রতিবাদ জানিয়ে একটা কড়া চিঠি পাঠালেন সংবাদপত্রে । এর পরের ঘটনা এক ট্রেনযাত্রাকে কেন্দ্র করে । তরুণ আইনজীবী গান্ধি ডারবান থেকে প্রিটোরিয়া যাচ্ছিলেন ট্রেনে করে । ফার্স্ট ক্লাসে টিকিট । ট্রেনটি পিটারম্যারিটসবার্গ স্টেশনে পৌঁছালে সেই কামরায় উঠলেন এক শ্বেতাঙ্গ । শ্বেতাঙ্গ লোকটা এক 'কালা আদমির ঔদ্ধত্য' দেখে রীতিমত থ ! কনস্টেবল ডেকে বের করে দেওয়া হলো গান্ধিকে । ট্রেন থেকে তাঁকে নামিয়ে দেওয়া হল । কালো বর্ণের কারণে মানুষ লাঞ্ছিত হবে - এটা মেনে নিতে পারেননি তিনি । এই ঘটনাগুলো পরবর্তীতে গান্ধির সামাজিক কার্যকলাপের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার পেছনে মুখ্য ভূমিকা রাখে ।
দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধি প্রথম সত্যাগ্রহ শুরু করেন 1907 সালে । ট্রান্সভাল কর্তৃপক্ষের এশিয়াটিক রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের প্রতিবাদ জানাতে তিনি প্রথমে প্রার্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন । সরকারের কাছে এই আইন রদ করার আবেদন জানান । কিন্তু পরে তিনি বুঝতে পারলেন শুধু প্রার্থনা দিয়ে কাজ হবে না কারণ সরকার একে পাত্তাই দিচ্ছে না । তাই তিনি শুরু করলেন আন্দোলনের সম্পূর্ণ এক নতুন অধ্যায় । দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের কাছে তিনি আহ্বান জানালেন, সরকারের 'এশিয়াটিক রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট' অমান্য করার এবং সরকারি দপ্তরগুলোর সামনে ধরনা ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করার । তবে তাঁর আবেদন ছিল, সেই বিক্ষোভ যেন কোনও ভাবেই সহিংস না হয় । সরকার গ্রেপ্তার করলে করবে, তাই বলে হিংসা-মারামারির মতো কোনও পন্থা গ্রহণ করা যাবে না । এভাবেই শুরু হল মহাত্মা গান্ধির প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন । গান্ধির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভারতীয়রা অভূতপূর্ব বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করল । শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের দাবি জানাতে থাকল আন্দোলনকারীরা । ফলে গান্ধির সত্যাগ্রহ নতুন মাত্রা পেল দক্ষিণ আফ্রিকায় ।
দীর্ঘ 22 বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় কাটিয়ে 1915 সালে ভারতে ফিরে আসেন গান্ধি । দক্ষিণ আফ্রিকায় অহিংস আন্দোলন সফল হওয়ায় পরবর্তীতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনও হয় এই পথ অনুসরণ করে । সত্যাগ্রহে আকৃষ্ট হয়ে অনেক ইংরেজও মহাত্মা গান্ধির বন্ধু ও অনুগামী হয়ে ওঠেন ।
ইতিহাসের সেই স্বর্ণালী পথ অনুসরণ করে পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন নেলসন ম্যান্ডেলা । অ্যামেরিকাতেও একই ভাবে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের মতো নেতারা । সত্যাগ্রহের মাধ্যমে গান্ধি শুধু ভারতের নয়, বরং সমগ্র পৃথীবির মানচিত্রে এভাবে নিজের ছাপ রেখে গেছেন ।