কলকাতা, 30 ডিসেম্বর: আপনার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে...৷ ফোনে কথাগুলো শুনে স্থবির হয়ে গিয়েছিলেন চিকিৎসক ছাত্রীর বাবা ৷ স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ছুটে যান আরজি কর হাসপাতালে ৷ কী হয়েছে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না ৷ দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পর তাঁরা দেখতে পেলেন একমাত্র সন্তানের নিথর দেহ ৷ 9 অগস্ট আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সেমিনার হল থেকে মেলে পিজিটির ছাত্রীর অর্ধনগ্ন ক্ষতবিক্ষত দেহ ৷ সেদিনের পর সেই ভয়াবহ ঘটনা বছরের বাকি সময়টায় আর একদিনের জন্যও খবরের শিরোনাম থেকে সরেনি ৷ আরজি কর-কাণ্ড 2024 সালে নয়া ইতিহাস সৃষ্টি করেছে ৷ প্রায় পাঁচ মাস পেরিয়ে বছর ঘুরতে চললেও, আজও দগদগে ঘায়ের মতো তাজা সেই ঘটনা ৷
আরজি করে বর্বরতায় দেশজুড়ে হাড়হিম
সেদিন সবে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রয়াত হয়েছেন ৷ শোকের আবহ কাটতে না-কাটতে সেই রাতেই বর্বরতার এক বেনজির ঘটনার সাক্ষী থাকল রাজ্য ৷ আট অগস্ট রাতে আরজি কর হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ের চারতলার সেমিনার রুম থেকে মিলল তরুণী চিকিৎসকের দেহ ৷ তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে মৃতার পরিবারের কাছে প্রথমে দাবি করেছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৷ তবে ক্রমে একে একে সামনে আসে নানা গরমিল ৷
একে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা বলে অভিযোগ তুলে বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন জুনিয়র চিকিৎসকরা ৷ স্লোগান ওঠে, 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস'৷ হাসপাতালে এভাবে একজন চিকিৎসক ছাত্রীর মৃত্যুর প্রতিবাদে তাঁরা কর্মবিরতিতে চলে যান ৷ মৃতার পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে 9 তারিখ হাসপাতালে গিয়ে তদন্ত শুরু করেন তৎকালীন নগরপাল বিনীত গোয়েল ৷ তার 24 ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেফতার করা হয় ঘটনায় মূল অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে ৷ কলকাতা পুলিশ জানায়, ছেঁড়া ব্লুটুথ হেড ফোনের তার আর সিসিটিভি ফুটেজই ধরিয়ে দিয়েছে ধর্ষণ ও খুনের মূল অভিযুক্তকে ।
ছিল রুমাল হয়ে গেল বিড়াল
ধর্ষণ ও খুন হয়েছেন চিকিৎসক ছাত্রী ৷ তবে আরজি করের এই ঘটনা খুঁজে বের করে দীর্ঘদিন ধরে সর্ষের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকা ভূতকে ৷ বেরিয়ে আসে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দাঁত-নখ ৷ ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় সঞ্জয় রায় গ্রেফতার হলেও উঠে আসে আর্থিক দুর্নীতি, মেডিক্যাল বর্জ্য বিদেশে পাচার করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, থ্রেট কালচার-সহ একাধিক গুরুতর অভিযোগ ৷
আরজি করের প্রাক্তন ডেপুটি সুপার আখতার আলি আগেও দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছিলেন, তবে তা ধোপে টেকেনি ৷ এবার ধর্ষণ ও খুনের আবহে তিনি ফের বিস্ফোরক অভিযোগ আনলে আদালতের নির্দেশে দুর্নীতির তদন্ত শুরু করে সিবিআইয়ের দুর্নীতি দমন শাখা ৷ ততদিনে আদালত রাজ্য পুলিশের থেকে ধর্ষণ-খুনের তদন্তও সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছে ৷
শুধু আরজি কর নয়, সেখানকার ঘটনাকে কেন্দ্র করে একে একে সরব হতে শুরু করে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ-সহ রাজ্যের অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালগুলি ৷ অভিযোগ ওঠে ছাত্রদের পাশ করাতেও টাকা নেওয়ার চল রয়েছে ৷ এমনকি মৃতদেহ নিয়েও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে ৷
কেঁচো খুঁড়তে কেউটে
আরজি করের চিকিৎসক ছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের তদন্তে একে একে উঠে আসে বিস্ফোরক তথ্য ৷ রাজ্যে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অরাজকতার সাতকাহন উন্মোচিত হয় ৷ তদন্তকারীদের স্ক্যানারে চলে আসেন আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ, টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডল, বিরূপাক্ষ বিশ্বাস, অভীক দে, সুশান্ত কুমার রায়ের মতো তাবড় সব চিকিৎসকদের নাম ৷
আরজি করের সেমিনার হলের ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ার পর একে একে ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে আসে ৷ যাঁদের দিকে সন্দেহের তির, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদও করেন সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা ৷ স্বাস্থ্যভবনের তরফেও সাসপেনশন-সহ বেশকিছু কড়া পদক্ষেপ করা হয় ৷ চলে তদন্ত ৷ মেডিক্যাল কলেজগুলিতে থ্রেট কালচারের যে গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল, তারও তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় ৷ যদিও সেই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দায়ের হওয়া মামলা বিচারাধীন ৷ এককথায় স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রকৃত রূপটাকে রাজ্যবাসীর সামনে তুলে ধরে আরজি করের 8 অগস্টের ঘটনা ৷
আন্দোলনের নয়া ইতিহাস
আরজি কর কাণ্ড পশ্চিমবঙ্গের আন্দোলনের ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে বাধ্য করেছে ৷ ন্যায় বিচারের দাবিতে গণ-আন্দোলন মনে করিয়ে দিয়েছে স্বাধীনতার আন্দোলনকে ৷ সরকারি হাসপাতালে তরুণীর চিকিৎসকের মর্মান্তিক মৃত্যুর বিচারের দাবিতে আন্দোলনটা শুরু করেছিলেন জুনিয়র চিকিৎসকরা ৷ তাঁরা কর্মবিরতি শুরু করলেও রোগীদের স্বার্থে পাশাপাশি চালিয়েছেন অভয়া ক্লিনিক ৷ তবে সন্দীপ ঘোষকে আরজি করের অধ্যক্ষ পদ থেকে সরিয়ে ন্যাশনাল মেডিক্যালের দায়িত্ব দেওয়া (যাকে শাস্তির বদলে পুরস্কার হিসেবে দেখেছে মানুষ), তদন্তের গতিপ্রকৃতি ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি উঠে আসা একের পর এক অভিযোগ বিক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালে ৷
এরই মধ্যে 14 অগস্ট স্বাধীনতা দিবসের ঠিক আগের দিন রাত দখলের কর্মসূচি চলাকালীন আরজি কর হাসপাতালে তাণ্ডব মানুষের রাগ আরও বাড়িয়ে দেয় ৷ তথ্যপ্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যেই এই কাজ করা হয়েছে বলে দাবি করে নগরপাল বিনীত গোয়েল ও স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগমের অপসারণের দাবিতে শুরু হয় জোরদার আন্দোলন ৷
18 অগস্ট কলেজ স্ট্রিট থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত প্রথম মিছিল করেন জুনিয়র চিকিৎসকরা ৷ এরপর সন্দীপ ঘোষের পদত্যাগের দাবিতে 20 তারিখ চলে প্রথম স্বাস্থ্যভবন অভিযান ৷ ছাত্র সমাজ নামে একটি সংগঠন নবান্ন অভিযান করে 27 তারিখ ৷ যদিও এই আন্দোলনে সামিল হননি জুনিয়র চিকিৎসকরা ৷
এরপর সেপ্টেম্বরের শুরুতেই আন্দোলনের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে বিনীত গোয়েলের পদত্যাগের দাবিতে লালবাজার অভিযান করা হয় ৷ সেদিনই সিবিআইয়ের হাতে দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হন সন্দীপ ঘোষ ৷ তবে তাতে ক্ষোভের আগুন এতটুকুও দমেনি ৷ ফিয়ার্স লেনে বাধা পেয়ে সেখানেই সারারাত শান্তিপূর্ণ অবস্থান চলে ৷ পরদিন লৌহকপাট খুলে লালবাজারে গিয়ে বিনীত গোয়েলকে প্রতীকী শিরদাঁড়া দেওয়া হয় ৷
ঘটনার এক মাস পূর্তিতে ফের রাত জাগে শহর ৷ একে একে চলে স্বাস্থ্য ভবন সাফাই অভিযান, দ্রোহের কার্নিভাল, চিৎকার সমাবেশ, দ্রোহের গ্যালারি, ন্যায় বিচার যাত্রা, মোমবাতি মিছিল, মানববন্ধন-সহ একাধিক কর্মসূচি ৷ জুনিয়র ডাক্তারদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনের ঢেউয়ে গা ভাসান সিনিয়র চিকিৎসক থেকে শুরু করে তারকা ও আম জনতা ৷ নবান্ন, স্বাস্থ্য ভবন, লালবাজার থেকে সিজিও কমপ্লেক্স সর্বত্র তোলপাড় চলে আরজি কর-কাণ্ডে ৷
মুখ্যসচিবের সঙ্গে চিঠি চালাচালির মধ্যেই তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের বিচার-সহ 10 তফা দাবিকে সামনে রেখে সরকারকে সময় বেঁধে দেন জুনিয়র চিকিৎসকরা ৷ তবে তা পূরণ না হওয়ায় শুরু হয় মরণপণ আন্দোলন ৷ 5 অক্টোবর রাত 10টা থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তাররা ৷ যত দিন যায় একে একে অনশনকারীরা অসুস্থ হতে থাকেন ৷ অনিকেত মাহাতো-সহ বেশ কয়েকজনকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় ৷ এরই মাঝে দফায় দফায় চলে আলোচনা ৷
20 অক্টোবর জুনিয়র চিকিৎসকদের অনশন মঞ্চে যান মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ । তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলান চিকিৎসকদের । তারপর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে নবান্নে বৈঠক করেন তাঁরা । সেই বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিং করা হয় । কিন্তু সেখানেও সব দাবি পূরণ হয়নি জুনিয়র চিকিৎসকদের । ওইদিন রাতেই তাঁদের ধর্মতলার ধরনা মঞ্চে উপস্থিত হন তরুণী চিকিৎসকের বাবা-মা । তাঁদের আবেদনে অনশন প্রত্যাহার করলেও আন্দোলন থেকে সরে আসেননি জুনিয়র চিকিৎসকরা ।
রাজনীতি অরাজনীতি
আরজি কর-কাণ্ডকে হাতিয়ার করে সক্রিয় হয়েছেন রাজনীতির কারবারিরা ৷ আবার রাজনীতি ভুলে সুখেন্দুশেখর রায়ের মতো অনেক রাজনীতিককেই বিচারের দাবিতে গণ-আন্দোলনে সামিল হতে দেখা গিয়েছে ৷ এই ইস্যুতে সাংসদ পদ ছেড়েছেন জহর সরকারের মতো বিদগ্ধ ব্যক্তি ৷ আরজি করের ঘটনার পর রাজ্য পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় বিরোধীরা একের পর এক তোপ দেগেছে ৷ আবার এ ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতা তুলে ধরার চেষ্টা চলেছে প্রতিনিয়ত ৷
আন্দোলনকারীদের অধিকাংশই সবক্ষেত্রে সচেতন ভাবে তাঁদের আন্দোলনকে কোনও রঙ লাগতে দেওয়া থেকে দূরে রাখার চেষ্টা চালিয়েছেন ৷ সে কারণেই ছাত্রসমাজ নামে সংগঠনের ডাকে নবান্ন অভিযানে রাজনীতির গন্ধ পেয়ে তাতে সামিল হননি আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকরা ৷ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে গিয়ে তাঁরা চা-ও মুখে তোলেননি ৷ শুরু থেকে শেষ, সরকার ও প্রশাসনিক প্রধানের প্রতি বিনীত ও নম্র মনোভাব দেখালেও দাবি আদায়ের আন্দোলনে কোনও মতেই পিছপা হননি তরুণ তুর্কি ডাক্তারের দল ৷ তাঁদের আন্দোলনে অনেকে বাম রাজনীতির আঁচ খুঁজে পেয়েছেন এই ঘটনায় মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এসএফআই তথা বামেদের সক্রিয়তায় ৷
তবে বিভিন্ন কর্মসূচিতে জুনিয়র চিকিৎসকদের সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট বারবার পাশে পেতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষকে ৷ তবে এরই মাঝে মাথা তুলেছে তৃণমূল সমর্থিত জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠন ও থ্রেট কালচারে অভিযুক্তদের নিয়ে গঠিত জুনিয়র ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন ৷ আরজি করকে হাতিয়ার করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ ও বিনীত গোয়েলের গ্রেফতারির দাবিতে গলা চড়িয়েছে বিজেপি ৷ মুখ্যমন্ত্রী আবার ধর্ষণ রুখতে অপরাজিতা বিল এনে, তা কার্যকর করতে বিলম্ব করার দায় চাপিয়েছেন রাজ্যপালের উপর ৷ পকসোর ট্রায়াল কোর্ট নিয়েও কেন্দ্রকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন মমতা ৷ রাজনীতির পরিসরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরজি কর নিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা চলেছে ৷ তবে আম আদমির কাছে সবার উপরে গুরুত্ব পেয়েছে নির্যাতিতার ন্যায়বিচারের দাবি ৷
উৎ-শবে আর্জি নয়, দাবি কর
আরজি কর-কাণ্ডের পর দ্রোহের আগুনে জ্বলেছে বাংলা ৷ উত্তর 24 পরগনার তরুণী হয়ে উঠেছে প্রত্যেক নাগরিকের ঘরের মেয়ে ৷ ডাক্তারি পড়তে গিয়ে সরকারি হাসপাতালে তাঁর এমন পরিণতি মেনে নিতে পারেননি কেউ ৷ বাংলার প্রতিটা ঘরে শোকের আবহ ৷ সেই ঘটনার পর থেকে এসেছে নানা উৎসব ৷ তবে সেই উৎসবেও বারে বারে ফিরে এসেছে আরজি কর ৷ ন্যায়বিচারের দাবিতে রাখিবন্ধন উৎসবে পুলিশকে অভয়া রাখি পরিয়েছেন জুনিয়র চিকিৎসকরা ৷
দুর্গাপুজোর আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আন্দোলনকারীদের উৎসবে ফেরার আহ্বান জানালেও তাতে সাড়া না-দিয়ে পালটা চলেছে দ্রোহের কার্নিভাল ৷ একদিকে যখন রেড রোডে শ্রীভূমি, সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার-সহ বিভিন্ন দুর্গাপুজো উদ্যোক্তাদের প্রতিমা নিয়ে কার্নিভালে ব্যস্ত রাজ্য প্রশাসন, তখনই ধর্মতলা সংলগ্ন রানি রাসমণি রোডে আরজি কর-কাণ্ডের বিচারের দাবিতে চলে উলুধ্বনি, শঙ্খনাদ, ঢাকের তাল, প্রতিবাদী গান, কালো বেলুন ওড়ানো ৷ উৎসব নয়, প্রতীকী অর্থে একে 'উৎ-শব' বলে কটাক্ষ করেছেন আন্দোলনকারীরা ৷
দীপাবলিতেও অভয়া ফানুস উড়িয়ে ও ঘরে অভয়ার নামে প্রদীপ জ্বালিয়ে এবং রঙ্গোলি করে প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ডাক দেওয়া হয় ৷ সম্প্রতি বড়দিনের উৎসবেও সিনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান চলেছে ৷ দাবি উঠেছে উৎ-শবে আর্জি নয়, দাবি কর ৷
তদন্তের গতিপ্রকৃতি
আরজি করের ঘটনার তদন্ত শুরুতে কলকাতা পুলিশের হাতেই ছিল ৷ তবে প্রথমে এই ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা, সেমিনার রুমে অযাচিত লোকেদের ভিড়, তথ্যপ্রমাণ লোপাটের চেষ্টা, পুলিশের সাহায্যে তড়িঘড়ি দেহ শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ (যেজন্য দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত সম্ভব হয়নি), এমন নানা ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তোলে নির্যাতিতার পরিবার ৷ দায়ের হয় ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ ৷
তদন্ত শুরু হওয়ার কয়ের ঘণ্টার মধ্যেই কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের হাতে গ্রেফতার হয় সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায় । তবে এই কাজ একজন ব্যক্তির নয় এবং এর পেছনে অন্য কোনও মাথা রয়েছে, এই দাবিতে আন্দোলন জোরদার হয় ৷ এরপর হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তভার যায় সিবিআইয়ের হাতে ৷ আন্দোলনকারীদের চাপের মুখে বিনীত গোয়েলকে নগপালের পদ থেকে সরিয়ে আনা হয় মনোজ ভার্মাকে ৷ সরিয়ে দেওয়া হয় কলকাতা পুলিশের তৎকালীন ডিসি নর্থ অভিষেক গুপ্তাকেও ।
ধর্ষণ ও খুনের পাশাপাশি একইসঙ্গে চলতে থাকে দুর্নীতির তদন্ত ৷ দুর্নীতির অভিযোগে আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং ঘটনাস্থল থেকে তথ্যপ্রমাণ লোপাট ও কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগে স্থানীয় টালা থানার প্রাক্তন অফিসার ইনচার্জ অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেফতার করে সিবিআই । যদিও তিন মাস পরেও অন্তর্বর্তী চার্জশিট পেশ না-হওয়ায় তাঁরা আপাতত জামিনে মুক্ত ৷
মামলা সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন ৷ শীর্ষ আদালতের শুনানির দিনগুলির আগে রাত দখলের মতো একাধিক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে ৷ ন্যায়বিচারের আশায় সুপ্রিম কোর্টের দিকে তাকিয়ে থেকেছে মানুষ ৷ তবে সেখানেও নির্যাতিতার মা-বাবার পক্ষে চারমাসে দু'বার আইনজীবী বদল হয়েছে ৷ নানা কারণে পিছিয়েছে শুনানি ৷ পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে নতুন বছর অর্থাৎ 2025 সালের মার্চ মাসে । এই বিলম্বে হতাশা দেখা দিয়েছে আন্দোলনকারীদের মনে ৷
ধর্ষণ-খুনে একমাত্র অভিযুক্তের বিস্ফোরক জবানি
এসবের মাঝেই ধর্ষণ-খুনের মামলায় শিয়ালদা আদালতে শুরু হয়েছে সঞ্জয় রায়ের ট্রায়াল ৷ সেখানে একাধিক সময় রাজ্য সরকার ও কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন নগরপাল বিনীত গোয়েল এবং গোয়েন্দা আধিকারিকদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ এনেছেন অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার । সরকার ও তার বিভাগ ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি । ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার সঙ্গে তিনি কোনওভাবেই যুক্ত নন বলে দাবি সঞ্জয়ের । আদালতে প্রবেশ ও বেরনোর সময় সাংবাদিকদের উদ্দেশে তাঁর এই বক্তব্য যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলে পুলিশ ও প্রশাসনকে ৷ সেই কারণে পরবর্তী সময়ে তাঁকে আদালতে পেশের সময় বেনজিরভাবে প্রিজন ভ্যানের দরজা বাজিয়ে, হাততালি দিয়ে, চিৎকার করে সঞ্জয়ের কথা আটকানোর চেষ্টা করে পুলিশ ৷
পরবর্তী সময়ে সিবিআই হাসপাতালে ঘটনাস্থলে গিয়ে উন্নত মানের যন্ত্রপাতি দিয়ে ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বেশকিছু নমুনা সংগ্রহ করে এবং সেগুলি সেন্ট্রাল ফরেনসিক ল্যাবে পাঠায় । সেই ল্যাবের রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যাচ্ছে, আরজি কর হাসপাতালে যেখানে ওই তরুণীর দেহ পাওয়া গিয়েছিল সেটি ঘটনাস্থল নাও হতে পারে । এছাড়াও রিপোর্টে স্পষ্ট হতে থাকে যে, আততায়ী বা ধর্ষণকারী একাধিকজন নাও হতে পারে । ধর্ষণকারী একাও হতে পারে ।
বিচারের আশায় সর্বহারার পরিবার
মেধাবী মেয়েকে ডাক্তার করতে পাঠিয়েছিল মফঃস্বলের ছাপোষা পরিবার ৷ সেই প্রাণভোমরাকে এভাবে হারিয়ে আজ বাবা-মা যেন জীবন্ত লাশ ৷ তাঁদের মেয়ে আজ গোটা রাজ্যবাসীর কন্যা ৷ তাঁকে পাকাপাকিভাবে হৃদয়ে জায়গা দিয়েছে আট থেকে আশি ৷ তবে সেই মেয়েকে চিরতরে হারিয়ে আজ সর্বহারা বাবা-মা ৷ মেয়ের ন্যায়বিচারের দাবিতে হাজারো ছেলেমেয়ের আন্দোলনে তাঁরাও সামিল হয়েছেন ৷ ছুটেছেন নেতা-মন্ত্রী-আদালতের ঘরে ৷
তবে এখনও পর্যন্ত প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্য ৷ সন্দীপ ঘোষের মুক্তিতে তাঁদের হতাশা চরমে পৌঁছেছে ৷ শীর্ষ আদালতে শুনানির অপেক্ষায় ধীরে ধীরে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে ৷ তবু তাঁরা হাল ছাড়ছেন না ৷ কারণ তাঁদের পাশে আজ হাজার-লক্ষ সন্তান ৷ কবির কথায়, "আমার মা গো, কে বলে তুই সন্তানহারা...৷ দেখ আজ তোরে মা বলে ডাকে হাজার সন্তান ৷" সেই সন্তানেরাই আজ নির্যাতিতার বাবা-মায়ের চালিকাশক্তি, বাঁচার রসদ, বিচারের আশাকে জিইয়ে রাখার জ্বলন্ত প্রদীপশিখা ৷