ব্যারাকপুর, 4 অক্টোবর: কখনও ছয় ইঞ্চি । কখনও আট ইঞ্চি ! আবার কখনও তার থেকেও কম ! উমার মর্ত্যে আগমনের আগে প্রতিবছরই নিত্য নতুন মিনিয়েচারের মাতৃ প্রতিমা তৈরি করে চমক দেন তিনি ! এবছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি । কচুরিপানার আঁশ দিয়ে মাত্র এক ইঞ্চির দুর্গা প্রতিমা বানিয়ে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন উত্তর 24 পরগনার পলতার যুবক দেবপ্রসাদ মালাকার ।
তবে, তাঁর হাতের নিখুঁত কারুকার্যে গড়ে ওঠা এই মাতৃ প্রতিমা কোনও পুজো কমিটির কাছ থেকে বরাত পাওয়ার পর তৈরি করেননি তিনি । নেহাতই শখের বশে তৈরি করা মিনিয়েচারের এই মাতৃ প্রতিমা আদপে শিল্পী কাজে লাগাতে চান পুজো মণ্ডপ অথবা কোনও প্রদর্শনীতে রাখার জন্য । যেখানে দেবপ্রসাদ তাঁর শিল্পী সত্ত্বাকে তুলে ধরতে পারবেন সাধারণ মানুষের সামনে ।
পলতার শান্তিনগরের বাসিন্দা দেবপ্রসাদের ছোটবেলা থেকেই ছিল মাটির প্রতি অগাধ টান । সেই কারণে মাটি দিয়ে যেকোনও জিনিস অনায়াসেই তৈরি করে ফেলতেন তিনি । তাঁর এই আগ্রহ দেখে পরিবারের লোকজন আর্ট স্কুলে ভরতি করিয়ে দেন । আঁকা শেখার পাশাপাশি মাটির প্রতিকৃতি তৈরি ক্রমশ শখে পরিণত হয় এই যুবকের ।
পরবর্তীতে আর্ট কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর মাটির সেই শখ ঝোঁকে মিনিয়েচারের প্রতি । বছর চব্বিশ আগে মাটির মিনিয়েচারের প্রতিমা তৈরি করে তাতে হাতেখড়ি হয় দেবপ্রসাদের । তারপর থেকে প্রতিবছরই মায়ের মর্তে আগমনের আগে কিছু না কিছু জিনিস দিয়ে অভিনব দুর্গা প্রতিমা তৈরি করে আসছেন এই শিল্পী ।
যেমনটা এবছর তিনি কচুরিপানার আঁশ দিয়ে এক ইঞ্চির দুর্গা প্রতিমা তৈরি করে নজর কেড়েছেন পলতাবাসীর । কিন্তু, এমন ভাবনা কীভাবে এল তাঁর মাথাতে ? জানা গিয়েছে, একদিন ইন্টারনেট থেকে দেবপ্রসাদ জানতে পারেন কচুরিপানা শুকিয়ে আঁশ বের করে তৈরি হচ্ছে শাড়ি । তখনই তিনি ভাবতে শুরু করেন যদি এই পদ্ধতিতে শাড়ি তৈরি হতে পারে !তাহলে দুর্গা প্রতিমা গড়া যাবে না কেন ?
যেমন ভাবনা, তেমনই কাজ । এরপরই দেরি না করে কচুরিপানা জোগাড় করে তা শুকাতে থাকেন এই যুবক । পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে, তা থেকে আঁশ বের করে মাতৃ প্রতিমা তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি । তবে, সুক্ষ্ম কাজ হওয়ায় খুবই ধৈর্য্য এবং মনোযোগ সহকারে গোটা কাজটি একা হাতেই সম্পন্ন করতে হয় দেবপ্রসাদ মালাকারকে ।
এর আগে ছয় ইঞ্চি, আট ইঞ্চি অথবা দু-মিলিমিটার মিনিয়েচারের দুর্গা প্রতিমা তৈরি করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন পলতার এই যুবক । মূলত, বিদেশ থেকে এই ধরনের মাতৃ প্রতিমা গড়ার অর্ডার আসে তাঁর কাছে । সেগুলি তিনি তৈরি করে পাঠিয়েও দেন নির্দিষ্ট স্থানে । এছাড়া সর্বজনীন পুজোর জন্য বড় প্রতিমা, মণ্ডপ তৈরিতে ব্যবহৃত ফাইবারের নানা শিল্পও তৈরি করে থাকেন তিনি । মূলত, ফ্রিল্যান্সে অ্যানিমেশনের কাজ করা এবং ছবি আঁকা ও শেখানো পেশা দেবপ্রসাদের ।
তবে যত ব্যস্ততাই থাক না কেন ! প্রতিবছর দুর্গাপুজোর আগে রকমারি বিভিন্ন জিনিস দিয়ে মিনিয়েচারের অভিনব প্রতিমা গড়ে তোলা চাই-ই তাঁর । সেটাই যেন এখন নেশায় পরিণত করে ফেলেছেন শিল্পী দেবপ্রসাদ মালাকার । তিনি বলেন, "শুরুটা হয়েছিল দু'হাজার সালে । সেবছর মাটির তৈরি মিনিয়েচারের দুর্গা প্রতিমা তৈরি করেছিলাম । এরপর কখনও মশলার ধনে । আবার কখনও কুমড়োর বীজের খোসা অথবা সুপারির খোল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে দুর্গা প্রতিমা ।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘তবে সবচেয়ে ছোট মাতৃ প্রতিমা বানিয়েছিলাম 2003-04 সালে । সেটা ছিল দু-মিলিমিটারের মতো । আমার কাজ দেখে অনেকেই প্রশংসা করেন । তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার আগ্রহ দেখিয়ে জানতে চান, পরের বছর নতুন কী প্রতিমা গড়তে চলেছি আমি ! এটা দেখে নিজেরও খুব ভালো লাগে । ইচ্ছা রয়েছে ভবিষ্যতে একটি আর্ট গ্যালারি করার । যেখানে মানুষের আকর্ষণ আরও বাড়বে মিনিয়েচারের প্রতি ।"
এদিকে, মসুরের ডালের উপর সরস্বতী মূর্তি তৈরি করে অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছিলেন দেবপ্রসাদ মালাকার । সেই কারণে 2014 সালে রাজ্য সরকার তাঁকে পুরস্কৃতও করেছিল ।