কলকাতা, 19 নভেম্বর: বাংলাদেশের সরকার বদলের পরেই বন্ধ হয়েছে ভারতীয় ভিসা । দু'দেশে যাতায়াত করতে পারছেন না এপার-ওপার বাংলার সাধারণ মানুষেরা । যার প্রভাব মারাত্মকভাবে পড়েছে কলকাতার 'মিনি বাংলাদেশে' । ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা ।
কলকাতার কোথায় রয়েছে এই 'মিনি বাংলাদেশ' ?
কলকাতার মারক্যুইস স্ট্রিট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, নিউমার্কেট-সহ ওই বিস্তীর্ণ এলাকা 'মিনি বাংলাদেশ' নামে পরিচিত ৷ এর কারণ, মূলত বাংলাদেশ থেকে মানুষজন যখন কলকাতায় আসেন, তারা এখানকার হোটেলেগুলিতেই বেশিরভাগ থাকেন ৷ এমনকি বাস থেকে গাড়ি বুকিংও করে এই এলাকাগুলি থেকেই ৷
যার ফলে কলকাতার 'মিনি বাংলাদেশে' ব্যবসা বেশিরভাগটাই নির্ভর করে ওপার বাংলার মানুষের উপর ৷ ভিসা জটিলতার কারণে পড়শি দেশের বাসিন্দারা এখন এপার বাংলায় আসতে পারছে না ৷ তাই কমেছে কলকাতা থেকে ঢাকা, খুলনা কিংবা চট্টগ্রামে যাওয়া বাসের যাত্রী সংখ্যাও । সেক্ষেত্রে মন্দার মুখ দেখছেন পরিবহণ ব্যবসায়ীরা ৷
একইভাবে ওপার বাংলা থেকে কলকাতায় এসে নাগরিকরা যে সমস্ত হোটেলগুলোতে তারা থাকেন, সেগুলোর অবস্থাও খুব একটা ভালো নয় । বাস যাত্রী সংখ্যা যেমন প্রায় 40 শতাংশ নেমে এসেছে, ঠিক তেমনই হোটেলগুলোতেও ভাড়াটিয়া কমেছে । এমনকি দু'দেশের মুদ্রা এক্সচেঞ্জের অফিসগুলোও আর্থিকভাবে সংকটে পড়েছে । স্বাভাবিকভাবেই এই 'ট্যুরিজম' ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা প্রত্যেকেই চাইছেন দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক, মন্দার প্রভাব কাটুক ।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি
সরকার বিরোধী আন্দোলনের জেরে গত 5 অগস্ট বাংলাদেশ ছাড়েন সেদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৷ এখন বাংলাদেশের দায়িত্বভার সামলাচ্ছেন মহম্মদ ইউনুস ৷ তাঁর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে আর ভারতের ভিসা দেওয়া হচ্ছে না বাংলাদেশের নাগরিকদের । শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পরই সেদেশের আন্দোলনের ঝাঁঝ কলকাতায় পড়েছিল ৷ এবার ভিসা বন্ধের প্রভাবে সমস্যা আরও বাড়তে শুরু করেছে ।
বাংলাদেশে সরকার বদলে তিন মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত নতুন করে ভিসা দেওয়া শুরু হয়নি সেদেশে । বাংলাদেশিদের একাংশের বক্তব্য, বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবাস বন্ধ রাখা হয়েছে । নতুন করে সেখানে কেউ ভিসার আবেদন করতেই পারছেন না । মূলত যারা 5 অগস্টের আগে ভিসা পেয়েছিলেন, তারাই এখন কলকাতায় বা এদেশে আসার সুযোগ পাচ্ছেন । যদিও সংখ্যাটা ক্রমশ কমছে ।
ভিসা সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশিরা
মূলত, বাংলাদেশ থেকে কলকাতা বা এ দেশে আসার মানুষেরা অধিকাংশই চিকিৎসা, ব্যবসায়িক কারণে বা ঘুরতে আসেন । বাংলাদেশিদের মধ্যে এদেশে ঘুরতে আসার বিষয়টি গুরুত্ব না দিলেও ব্যবসায়িক এবং চিকিৎসা পরিষেবা নিতে আসা মানুষেরাই সবথেকে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন ।
বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় আসা একাংশের বাংলাদেশিদের বক্তব্য, "ক্যানসার বা এই জাতীয় মারাত্মক মারণব্যাধি বা সংকটজনক রোগে আক্রান্ত হলে, মানবিকতার কারণে দুই একজনকে নতুন করে ভিসা দেওয়া হচ্ছে ।"
সোমবার বাংলাদেশের ঢাকা থেকে কলকাতায় পৌঁছেছেন মহম্মদ শাহনাওয়াজ । এ দেশে আসার ভিসা তাঁর 5 অগস্টের আগেই নেওয়া ছিল । টুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় আসা এই ব্যক্তির দাবি, সরকারের উত্থান পতনে দেশে বা যেকোনও রাজ্যে কিছু সমস্যা ও পরিবর্তন ঘটে । পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগে । কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ভাবে ভিসা বন্ধ রাখা কোনও সমস্যার সামাধান না বলে তিনি মনে করেন ।
শাহনাওয়াজ বলেন, "নতুন করে ভিসা পাওয়ার আবেদনই করা যাচ্ছে না । এরপরে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন বাংলাদেশিরা । বিশেষ করে যারা চিকিৎসা পরিষেবা নিতে এদেশে এসে থাকেন । অনেকে আবার ব্যবসায়িক কারণে আসেন । ফলে নতুন করে ভিসা না পাওয়ায় যেমন এখানকার চিকিৎসা পরিষেবা সে দেশের মানুষ নিতে পারছে না, ঠিক তেমনই ব্যবসার ক্ষেত্রেও দুই বাংলার মানুষ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ।"
বাংলাদেশের ডেমরা যাত্রাবাড়ী বাসিন্দা কাজী ইব্রাহিম অলিউল্লাহ আবার বাংলাদেশের প্রশাসনের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন । তাঁর বক্তব্য, এমনিতেই ভিসা বন্ধ থাকায় বহু গরীব মানুষ চিকিৎসা পরিষেবা নিতে এ দেশে আসতে পারছেন না । আর যারা আগে থেকে ভিসা নিয়ে রেখেছিলেন, সেরকম বেশ কিছু মানুষের থেকে সেখানকার প্রশাসন অবৈধভাবে নানা অছিলায় টাকা নিচ্ছে । যা দ্রুত বন্ধ হওয়া দরকার বলেই তিনি মনে করেন ।
কাজী ইব্রাহিম অলিউল্লাহ বলেন, "বর্তমান যে পরিস্থিতি চলছে তাতে সীমান্ত পেরনোর সময় বহু গরিব মানুষের থেকে নানারকমভাবে ভুল বুঝিয়ে, যেমন-পাসপোর্টে ভুল আছে, ভিসা পাবেন না, এই ভিসা নিয়ে যাওয়া যাবে না, এ সমস্ত বলে টাকা নিচ্ছেন বাংলাদেশে প্রশাসনের বহু আধিকারিক । এই পরিস্থিতি যেমন স্বাভাবিক হওয়া দরকার, ঠিক তেমনই 5 অগস্টের পর থেকে যে ভিসা দেওয়া বন্ধ রয়েছে, তা দ্রুত চালু করা দরকার । না হলে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা যেমন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, পাশাপাশি চিকিৎসা পরিষেবা নিতে পারছেন না বহু মানুষ ।"
মন্দায় 'মিনি বাংলাদেশে'র ব্যবসায়ীরা
মারক্যুইস স্ট্রিট ও ফ্রি স্কুল স্ট্রিট এলাকায় এক থেকে দেড়শো স্কোয়ার ফুটের ছোট্ট ঘর বা দোকানের ভাড়া প্রায় এক-দেড় লক্ষ টাকা । একইরকমভাবে বড় বড় হোটেলের ও ভাড়া বিপুল টাকা । স্বাভাবিক সময়ে এই সমস্ত এলাকায় হোটেল ভাড়া আড়াই কিংবা তিন হাজার হয়ে থাকে । কিন্তু, ওপার বাংলার মানুষের সংখ্যা কলকাতার 'মিনি বাংলাদেশে' কমতে থাকায় খুব সংকটে রয়েছেন এই সমস্ত ব্যবসায়ীরা । 1000-1200 টাকা কিংবা 800 টাকায় ঘর ভাড়া দেওয়ার জন্য লোক খুঁজতে অনেক হোটেল মালিকই রাস্তায় নামছেন ।
এই সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি হলে ব্যবসা যে কার্যত লাটে উঠবে, তা একপ্রকার স্বীকার করে নিয়েছেন মারক্যুইস স্ট্রিট ও ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ওয়েলফেয়ার সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ জাফর খান । তিনি বলেন, "গত 4-5 মাস ধরেই ব্যবসায় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি আমরা । আমরা আশায় আছি, খুব দ্রুত এই সমস্যার সমাধান ঘটবে ।"
অন্যদিকে শ্যামলী পরিবহণের সেলস ম্যানেজার বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর কথায়, "নতুন করে কোনোভাবেই ভিসা পাচ্ছে না-বাংলাদেশিরা । যারা 5 অগস্টের আগে ভিসা পেয়েছিলেন, তারাই আসছেন এ দেশে । বাস প্রতিদিনই কলকাতা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম কিংবা বেনাপোল পর্যন্ত যাচ্ছে । আগে প্রতি বাসে 40-45 জন করে যাতায়াত করত । এখন সংখ্যাটা অর্ধেকে এসে ঠেকেছে । বহু বাংলাদেশি ফিরে যাওয়ার সময় আক্ষেপ করছেন আর দেখা করতে পারবেন কি না ! আমরা আশায় আছি, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে । দুই বাংলার মানুষ আবার স্বাচ্ছন্দে যাতায়াত করতে পারবেন ।"