বর্ধমান, 8 মার্চ : সালটা ছিল 2014 ৷ আজ থেকে প্রায় 9 বছর আগে আর পাঁচটা সাধারণ বধূর মতোই ছিলেন পূর্ব বর্ধমানের হাটশিমূল গ্রামের রাসমণি মালিক ৷ একটি রাতের ঘটনা রাসমনির মালিকের জীবনকে টলমল করে দিয়েছিল ৷ ভেঙে দিয়েছিল সাজানো সংসার ৷ আজ সেই রাসমণি মালিকের হাত ধরে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করছেন গ্রামবাসীরা। পাশাপাশি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের শিক্ষাদানও করছেন ।
এক রাতে 'ডাইনি' অপবাদে তাঁকে গ্রাম ছাড়া ও পুড়িয়ে মারার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছিল গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে । এমনকি কেরোসিন তেল গায়ে ঢেলে তাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা হয় ৷ সেদিন কোনওরকমে পালিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন ৷ পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় যে লজ্জায় রাসমণি মালিক আত্মহত্যা করার কথাও ভেবে ফেলে। কিন্তু ছেলেমেয়েদের কথা শুরু ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই ।
জেলা প্রশাসন, পুলিশ, মহিলা কমিশন তাঁকে সেই সময়ে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও নানা দিক থেকে চাপ আসতে শুরু করে। এমনকী বর্ধমানের যে নার্সিংহোমে তিনি কাজ করতেন, সেখানের কর্মীদের কাছেও তাঁকে ডাইনি অপবাদ শুনতে হয়েছিল বলে অভিযোগ। কার্যত একপ্রকার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি । এই সময় তাঁর পাশে দাঁড়ায় দেবশিশু ওয়েলফেয়ার সোসাইটি নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ৷ ওই সংস্থার সম্পাদক সবিতাব্রত হাটি তাকে নতুন করে বাঁচার রসদ যোগায়। সেই শুরু রাসমণির জীবনে নতুন অধ্যায়।
ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে খেলনা তৈরির প্রশিক্ষণ নেয় ৷ নিজে স্ব-নির্ভর হন ৷ সেইসঙ্গে সমাজের পিছিয়ে পড়া মেয়েদের স্বনির্ভর করতে উদ্যোগী হয়েছেন ৷ হাওড়ার সালকিয়া এলাকার একটি সংস্থা এখন তাদের খেলনা তৈরির বরাত দেয়। সেই খেলনা পৌঁছে যায় বিভিন্ন মেলায়। আশেপাশের গ্রামের মেয়েরা রাসমণির কাছে কাজ শিখে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করছেন। সেইলসঙ্গে বিশেষভাবে চাহিদা সম্পন্ন শিশুদেরও পড়োশোনা শেখাচ্ছেন তিনি ৷
এই প্রসঙ্গেই রাসমণি মালিক বলেন, "একদিন যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তাতে ওরা আমাকে পুড়িয়েই মেরে ফেলতো। কোনরকমে প্রাণে বেঁচে যাই । এখন সাত জনের সংসারের দায়িত্ব আমার কাঁধে। এছাড়া সমাজের পিছিয়ে পড়া মেয়েরাও যাতে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সংসারের কাজে আসে সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া দেবশিশু ওয়েলফেয়ার সোসাইটিতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হয়। একদিকে নিজের বাঁচার লড়াই অন্যদিকে পিছিয়ে পড়া মেয়েদের স্বনির্ভর করে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনাই জীবনের লক্ষ্য। '
রাসমণির কাছে প্রশিক্ষণ নিতে আসা স্থানীয় রত্না দাস, শকুন্তলা হাঁসদা-সহ একাধিক মহিলা ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে খেলনা তৈরি করা হয়। রাসমনির কাছে প্রশিক্ষণ নিতে আসে গ্রামবাসী রত্না দাস বলেন, "সংসারে স্বামী ও তিন মেয়ে আছে। সংসার সামলে এখানে সকাল থেকে কাজ করি। রাসমণিদির হাত ধরেই কাজ শিখেছি। তিনি বুঝিয়েছেন সংসার সামলে কিভাবে পরিবারকে সাহায্য করা যায়।"
দেবশিশু ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সম্পাদক সবিতাব্রত হাটি বলেন, "স্থানীয় বিডিওর মাধ্যমে রাসমণি মালিকের কথা জানতে পারি। প্রশাসনের সহযোগিতায় তাকে উদ্ধার করে নিয়ে এসে নতুন করে লড়াই করা শুরু করি। আজ তার সহযোগিতায় সমাজের পিছিয়ে পড়া মেয়েরাও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সংসারের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছে।"
আরও পড়ুন: