কলকাতা, 18 ডিসেম্বর: বিকেলের অস্তরাগে ব্যস্ত রাজপথে হাজার গাড়ীর ভিড়ে হলুদ বিন্দুর নিরবিচ্ছিন্ন দৌড় । ওরা আধুনিকতার আলোয় উদ্ভাসিত নয়, ঐতিহ্যের গর্বে রাঙানো তিলোত্তমার শান । বয়সের ভারে নুব্জ তবুও অক্লান্ত দৌড় ওদের চার চাকায় । ওরা কলকাতা শহরের হলুদ ট্যাক্সি । কালো-হলুদ থেকে শুধু হলুদ রঙের ট্যাক্সি,বিবর্তন কবে হল তার সাল তারিখ বলা মুশকিল। তবে শহরের ট্যাক্সি কালচারে হলুদ ট্যাক্সি এখন “জলসাঘরের বিশ্বম্ভর রায়”। পুরানো কলকাতার মানুষরা বলেন শহর কলকাতায় চলাচলের জন্য আমজনতার ট্যাক্সির রং ছিল কালো হলুদ। কিন্তু শহর ছাড়িয়ে দূরে যেতে হলে ডাক পড়ত হলুদ ট্যাক্সির।
কালো-হলুদ দু’রঙা ট্যাক্সি আর রাস্তায় নেই । এবার বিসর্জনের বাজনা হলুদ ট্যাক্সিকে ঘিরে । স্বাভাবিকভাবেই গেল গেল রব উঠেছে । কলকাতা শহরের অভিজ্ঞান যেসব জিনিস, তার অনেক কিছুই পাটে যেতে বসেছে । বিশেষ করে চলমান ঐতিহ্য সত্যিই অস্তিত্বের সংকটে । বিদ্বজনেরা বলছেন, আসলে আমরা স্মৃতি লালন করতে ভালোবাসি, কিন্ত তা রক্ষণাবেক্ষণ করে যুগোপযোগী করে তুলতে যত্নবান নই । তাই ‘স্মৃতিটুকু থাক’ এই ভাবনার বশবর্তী হয়ে ট্রাম থেকে হলুদ ট্যাক্সি, শুধুমাত্র রেখে দেওয়ার জন্য রেখে দিতে চাইছি ।
অনেকে আবার বলছেন, “ডেভলপমেন্ট মানেই তো ডিসপ্লেসমেন্ট ।’’ কালের নিয়মে বদল তো অনিবার্য । ট্রাম, হলুদ ট্যাক্সি বা ডাবল ডেকার বাস, ব্যস্ত শহরের রাজপথে গতিমন্থরতা বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে । তাই বিসর্জনই ভবিতব্য । আধুনিকীকরণের কথা মাথায় রেখে 15 বছরের বেশি পুরনো প্রায় 2,500 ট্যাক্সিকে রাস্তায় নামার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে সরকারি তরফে । ফলত উদ্বেগের মুখে হলুদ ট্যাক্সি চালক, ইউনিয়ন এবং নাগরিকরা । এ কেবল আর্থিক সংকটই নয়, বরং সাংস্কৃতিক প্রতীক হারানোর সম্ভাবনা সম্পর্কেও সতর্ক করেছেন সচেতন শহরবাসী ।
পটভূমি:
• কলকাতার রাস্তায় প্রথম হলুদ ট্যাক্সি চলাচল শুরু হয় 1908 সালে, খরচ ছিল প্রতি মাইলে 8 আনা (50 পয়সা) ।
• 1962 সালে, কলকাতা ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশন অ্যাম্বাসাডরকে স্ট্যান্ডার্ড ট্যাক্সি মডেল হিসেবে গ্রহণ করে ৷ ভারতের রাস্তার জন্য টেকসই প্রভাব উল্লেখ করা হয় । হলুদ রঙটি যেহেতু রাতের বেলাও ভীষণভাবে দৃশ্যমান, সেই কারণেই এই রঙটি নির্বাচিত হয় ।
• সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতার প্রথম হলুদ ট্যাক্সি চালক, যিনি 1932 সালে পারমিট পান ।
• 2009 সালে শেফালি রায় কলকাতার প্রথম মহিলা হলুদ ট্যাক্সি চালক হিসেবে পথে নামেন ।
• গবেষণায় দেখা গিয়েছে, হলুদ ট্যাক্সির সংখ্যা 2020 সালে 18 হাজার থেকে বর্তমানে 6 হাজারে নেমে এসেছে ।
বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট এবং মোহনবাগান ক্লাবের সচিব দেবাশিস দত্ত বলছেন, “ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে চেঞ্জ আসবেই । বাঙালি মানেই আগে ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত মানুষ । এখন অফিস যাওয়ার সময় প্যান্ট-শার্ট পড়তে হচ্ছে । বদলের সঙ্গে এগোতে হবে মানুষকে । বদল একটা ধর্ম । বদল ছাড়া মানুষ এগোয় না । সুতরাং হলুদ ট্যাক্সি যদি আজকের দিনের মতো, আজকের চাহিদা মতো না-হতে পারে তাহলে অবলুপ্তির পথে চলে যেতে হবে । কিছু করার নেই । এখন সার্ভিসের যুগ ।”
- বাণিজ্যিক সভার একটি অংশের প্রেসিডেন্টের মনোভাব কি শহরের কথা ? সত্যি কি মুছে দেওয়া হবে হলুদ ছোঁয়া । ‘ইয়েলো ইয়েলো, ডার্টি ফেলো’ বলে হলুদ ট্যাক্সিকে কি আধুনিকতা সর্বস্ব চার চাকার দল ব্রাত্য করবে ?
1908 সালে শহর কলকাতায় প্রথম ট্যাক্সি দৌড়য় চৌরঙ্গী রোডের উপর দিয়ে । ফরাসি কোম্পানি শেভিজাঁ প্রথম ট্যাক্সি নিয়ে আসে শহরে । তারপর ইন্ডিয়াান মোটর ট্যাক্সি ক্যাব এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ট্যাক্সি নিয়ে আসে । এরপর ইংরেজরা দেশ ছেড়ে চলে গেলে বন্ধ হয়ে যায় এই কোম্পানি । 1957 সালে হিন্দুস্তান মোটরস কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসে অ্যাম্বাসাডর । এই গাড়িগুলি তখন ব্যাক্তিগত ব্যবহারের পাশাপাশি ট্যাক্সি হিসেবে বাণিজিকভাবে চালানো শুরু হয় । তখন শহরের মধ্যে চলাচলের জন্য ট্যাক্সির রং ছিল কালো-হলুদ । যেগুলি শহরের বাইরে যেত সেগুলি ছিল হলুদ । কালের নিয়মে কালো-হলুদ ট্যাক্সি সরে গিয়ে রয়ে গেল শুধুই হলুদ ট্যাক্সি । তারপর এই কোম্পানিও অ্যাম্বাসাডর তৈরি বন্ধ করে দেয় ।
সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে শহরে এসেছে অ্যাপ ক্যাব । গণপরিবহন এখন অনেক বেশি স্মার্ট । শহরবাসী এখন অনেক বেশি নির্ভর করে মেট্রো এবং অ্যাপ ক্যাবের উপর । হিন্দুস্থান মোটরস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে অ্যাম্বাসাডর গাড়ির নির্মাণও । বিড়লার কারখানাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে । পথে যেই ট্যাক্সিগুলি চলছে, সেগুলিরও অচিরেই বয়সের ভারে স্বাভাবিক নিয়মে চলা বন্ধ হয়ে যাবে ।
তাই অ্যাম্বাসাডর হলুদ ট্যাক্সি বন্ধ হয়ে গেলেও যাতে আবেগ যাতে শেষ হয়ে না-যায়, নতুন রূপে আবারও আত্মপ্রকাশ করছে ইয়েলো ট্যাক্সি ।
পরিবহন দফতর সূত্রে খবর, ঝাঁ-চকচকে আধুনিক কলেবরে পথে নামবে আরও 2000 হলুদ ট্যাক্সি । এক বেসরকারি সংস্থা নতুন রূপের হলুদ ট্যাক্সি নামাতে চলেছে । শুধু তাই নয়, পরিবহন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, পুরনো অ্যাম্বাসাডরের পারমিটেই পাওয়া যাবে নতুন ট্যাক্সি নামানোর পারমিট । এক আধিকারিক বলেন, ‘‘আমরা চাই ট্যাক্সি সংগঠন, চালক-মালিক এসে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করুক ৷ কারণ দফতরও হলুদ ট্যাক্সির নস্টালজিয়াকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় । তাই কেউ যদি বাণিজ্যিক নম্বর প্লেটে ট্যাক্সি নামাতে চান এবং সেই গাড়িকে হলুদ রং দিতে চান, পরিবহন দফতরের অনুমোদন সাপেক্ষে সেটাও করা যাবে ।’’
- শঙ্কার মেঘ হলুদ ট্যাক্সি চালকদের মনে । কলকাতা শহরে একসময় সিংহভাগ ট্যাক্সি ড্রাইভার ছিলেন পঞ্জাবের । বিহার-ওড়িশা থেকেও অনেকে আসতেন ট্যাক্সি চালানোকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে । পরবর্তী সময়ে বাঙালিরা স্টিয়ারিং ধরেছেন হলুদ ট্যাক্সির। এই পরিস্থিতিতে তারাও দ্বিধায় ।
বর্তমানে আকাশ ছোঁয়া জ্বালানির দামের সঙ্গে গত 2018 সাল ভাড়া বাড়েনি ট্যাক্সির । অ্যাপ ক্যাবের দৌরাত্ম্যর উপর রাশ টানতেই রাজ্যে পরিবহন দপ্তরের উদ্যোগে মিটার ট্যাক্সিকে ‘যাত্রী সাথী’ অ্যাপে যুক্ত করা হয় । ট্রাফিক ও পরিবহন দফতর সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুসারে, তিন বছরের মাথায় ‘যাত্রী সাথী’ অ্যাপের মাধ্যমে হলুদ ট্যাক্সি 7086 চালক এই অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ৷ চালকদের আয় হয়েছে প্রায় 166 কোটি টাকা, 60.98 লক্ষ ট্রিপ সম্পূর্ণ হয়েছে । 3.19 কোটি বার অ্যাপটি সার্চ করা হয়েছে ।
আবেগ, ঐতিহ্য, জীবিকা হারানোর ভয় নিয়ে হলুদ ট্যাক্সি ছুটে চলছে কখনও গন্তব্যে, কখনও সওয়ারির খোঁজে । গতিরুদ্ধ হওয়ার আওয়াজ তাকে আরও গতিহারা করে তোলে । ‘যাত্রী সাথী’ হয়ে কি রাজপথে সে দৌড়বে ? উত্তর খুঁজে চলেছে কলকাতা ।