জলপাইগুড়ি, 25 জুলাই: সিনেমায় যেমন দেখায় ! দুষ্কৃতীদের হাতে আক্রান্ত বাবা ৷ দৌড়ে থানায় গিয়ে সাহায্যের আর্জি জানাচ্ছে নাবালক সন্তান ৷ বুধবার রাতে বাস্তবেও তেমন ঘটনা ঘটল ৷ ঘটনাস্থল জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ির খাগড়াবাড়ির হঠাৎ কলোনি ৷
সেখানেই বাড়ি মানিক রায়ের ৷ বুধবার রাতে বছর পঁয়তাল্লিশের ওই ব্যক্তিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে প্রতিবেশীরা লাঠি-রড দিয়ে বেধড়ক মারধর করে বলে অভিযোগ ৷ সেই সময় বাবাকে বাঁচানোর আর কোনও উপায় না পেয়ে সোজা ময়নাগুড়ি থানার দিকে দৌড় দেয় নাবালক ছেলে ভক্ত ৷ প্রায় আধঘণ্টা দৌড়ে গিয়ে পুলিশের কাছে সে বলে, ‘‘বাবাকে বাঁচাও ৷’’
রাত ন’টা নাগাদ বছর 13 এক কিশোরের মুখে এমন কথা শুনে হতচকিত হয়ে যান পুলিশকর্মীরা ৷ আর এখানেই বাস্তবের দুনিয়ার সঙ্গে সেলুলয়েডের পার্থক্য প্রকট হয়ে ওঠে ৷ সিনেমায় সাধারণত এই ধরনের ক্ষেত্রে পুলিশকে খারাপ হিসেবেই দেখানো হয় ৷ কিন্তু বাস্তবে ময়নাগুড়ি থানার পুলিশ কর্মীরা তেমনটা নন ৷ তাই ছেলেটির থেকে প্রথমে তাঁরা পুরো ঘটনা শোনেন ৷ তার পর বেরিয়ে পড়েন মানিককে বাঁচানোর জন্য ৷
ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশকে মানিককে উদ্ধারও করে ৷ তাঁকে জলপাইগুড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভর্তিও করা হয় ৷ কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি ৷ মারা গিয়েছেন মানিক ৷ এই ঘটনায় মোট 11 জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে ৷ তাঁদের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার উমেশ খাণ্ডবাহালে ৷
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ময়নাগুড়ির খাগড়াবাড়ির হঠাৎ কলোনির বাসিন্দা মানিক রায়ের সঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় প্রতিবেশীদের গন্ডগোল চলছে । পারিবারিক বিবাদ নিয়ে মামলা চলছিল । একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পালটা অভিযোগও চলছিল । কয়েক বছর আগে মানিকের বাড়িতে প্রতিবেশীরা চড়াও হয়ে বাড়ি ভাঙচুর করে ভিটেমাটি ছাড়া করে মানিকের পরিবারকে ।
এর পর মানিকের পরিবার শিলিগুড়ি গিয়ে থাকতে শুরু করে । এরপর দীর্ঘ কয়েক বছর পর গত রবিবার ফের মানিক পরিবার নিয়ে ময়নাগুড়ির বসতভিটেতে ফিরে আসেন । তাঁর প্রাণ সংশয় আছে বলে পুলিশ-প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন মানিক । গত রবিবার পরিবার নিয়ে হঠাৎ কলোনির ভিটেতে ফিরে আসে ।
মানিকের স্ত্রী স্বপ্না রায়ের অভিযোগ, ‘‘আমরা কয়েকদিন আগেই বাড়িতে ফিরি । কয়েকদিন থেকেই আমাদের ভয় দেখানো হচ্ছিল । আমরা ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলাম । সেই অভিযোগ প্রত্যাহার করতে বলে । কিন্তু প্রত্যাহার করিনি । এরপর আমাদের বাড়ি থেকে আমরা থানাতেই জানিয়েছি ।’’
তাঁর আরও অভিযোগ, ‘‘গতকাল রাতে মানিককে ডাকে । আমরা বলি দিনের বেলায় কথা হবে । রাতে কোনও আলোচনা করব না । এরপর মানিককে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যায় । জমির কাগজপত্র ছিঁড়ে ফেলে । এরপর আমার ছেলে থানায় গিয়ে খবর দেয় । এরপর পুলিশ রাতে খুঁজে মানিককে বের করে হাসপাতালে নিয়ে যায় । এরপর রাতেই মানিক মারা যায় ।’’
মানিকের আত্মীয় বিজয় রায় অভিযোগ করে বলেন, ‘‘পাঁচ বছর আগে মানিককে ভিটেমাটি ছাড়া করা হয় । গত রবিবার ফের মানিক আসে । গতকাল তাঁকে বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা হয় । তৃণমূল ও বিজেপির কর্মীরা মিলে এই কাজ করল । বাড়িতে আগে ভাঙচুরের ঘটনায় মানিক অভিযোগ করার পর থেকে এরা মানিককে দেখতে পারত না । আমরা দোষীদের শাস্তি চাই ।’’
এদিকে ময়নাগুড়ি ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের ব্লক সভাপতি মনোজ রায় বলেন, ‘‘এটা রাজনৈতিক বিষয় নয় । তৃণমূল কংগ্রেস কাউকে পিটিয়ে মারার পক্ষে নয় । পুলিশকে জানিয়েছি দোষীদের গ্রেফতার করা হোক । আমরা ঘটনায় তীব্র নিন্দা করছি ।’’ অন্যদিকে কংগ্রেস নেতা অমিতাভ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘কংগ্রেসের কর্মী মানিক রায়কে পিটিয়ে মারা হয়েছে । তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে মারা যায় সে মারা যায় । আমরা জেলা থেকে খোঁজ নিচ্ছি কিভাবে হল । জলপাইগুড়িতে এটা ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটল । অন্য দল করে বলে পিটিয়ে মারা হবে ৷ এটা মেনে নেওয়া যায় না ।’’ তবে জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার উমেশ খাণ্ডবাহালে জানিয়েছেন যে এই ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই ৷
যদিও এই ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির যোগ আছে কি না, তা তো তদন্তের শেষে উঠে আসবেই ৷ তার আগে এখন আলোচনার কেন্দ্রে নিহত মানিক রায়ের ছেলে ভক্ত ৷ বছর তেরোর এই কিশোর যেভাবে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে বাড়ি থেকে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে, হাইওয়ে পার করে দৌড়ে থানায় পৌঁছে বাবাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে, তা নিয়ে তার প্রশংসা অনেকেই করছেন ৷ শুধু একটাই আক্ষেপ, এত চেষ্টা করেও ছেলেটা শেষরক্ষা করতে পারল না... ৷