ব্যারাকপুর, 14 মে: হাইভোল্টেজ ব্যারাকপুর কেন্দ্রে এ বার যুযুধান দুই প্রতিপক্ষের সমানে সমানে লড়াই ! একজন পার্থ ভৌমিক । যিনি বরাবরের তৃণমূল । অন্যজন অর্জুন সিং। যিনি আবার গতকালের তৃণমূল, তবে আজকের বিজেপি । ভোটযুদ্ধের আবহে পার্থ-অর্জুনের এই নির্বাচনী লড়াই মনে করিয়ে দেয় 'মহাভারতের' যুদ্ধের কথা । ফারাকটা একটাই, মহাভারতের যুদ্ধে ধনুর্বীর অর্জুনেরই আরেক নাম ছিল পার্থ ৷ আর ব্যারাকপুরে ভোটের কুরুক্ষেত্রে সম্মুখসমরে পার্থ ও অর্জুন ৷ কেউ কাউকে এতটুকু জায়গা ছাড়তে নারাজ ! তবে তাঁদের প্রেস্টিজ ফাইটে যুদ্ধংদেহী মেজাজে রয়েছেন এই কেন্দ্রে সিপিআইএমের তারকা প্রার্থী দেবদূত ঘোষ ৷ তবে শেষ হাসি কে হাসবেন, তা নিয়ে ধন্ধ রয়েছে ৷
কলকাতা লাগোয়া উত্তর 24 পরগনার অন্তর্গত ব্যারাকপুর । ব্রিটিশ আমলে সেনা বারাকগুলি গড়ে উঠেছিল গঙ্গা তীরবর্তী এই ছোট্ট জনপদে । স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই ব্যারাকপুর । সিপাহী বিদ্রোহের সলতে পাকানো থেকে জীবন সায়াহ্নে মহাত্মা গান্ধির কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র, সবই এখানে । এ সব ঐতিহাসিক গুরুত্বের পাশাপাশিই নির্দিষ্ট ছন্দে আবর্তিত হয়েছে ব্যারাকপুরের নিজস্ব রাজনীতি ।
এখানকার মানুষ বরাবর রাজনৈতিকভাবে সচেতন । সবচেয়ে বড় কথা, একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে এখানকার রাজনৈতিক আবহ । গত দেড় দশক ধরে সেই হাওয়া ঘুরপাক খাচ্ছে মূলত আইনশৃঙ্খলা, অস্বস্তিকর পরিস্থিতিকে ঘিরে । প্রতি নির্বাচনের আগেই রাজনৈতিক অস্থিরতা এখানকার সঙ্গী । চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না । সমানে সমানে টক্কর দেওয়া শাসক-বিরোধী প্রার্থীদের মধ্যে কে ব্যারাকপুরের কুর্সি দখল করেন, তা নিয়েই চুলচেরা বিশ্লেষণ করল ইটিভি ভারত ৷
ইতিহাস: 1952 সালে আত্মপ্রকাশ করা ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রটিতে আশি সালের পর বিন্যাস বদল অথবা ডিলিমিটেশনের ফলে বেশকিছু কেন্দ্রের সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে । প্রথমদিকে কংগ্রেসের দখলে থাকা ব্যারাকপুর ধীরে ধীরে লাল দুর্গে পরিণত হয় । তা দীর্ঘদিন ধরেই সিপিএমের অন্যতম বড় গড় ছিল । 2011 সালে রাজ্যে বাম শাসনের অবসানের পর রাজনৈতিক রং বদল হলেও এখনও সেখানে সিপিআইএমের নির্দিষ্ট জনসমর্থন রয়েছে । বিশেষত, শিল্পাঞ্চল হওয়ায় শ্রমিক সংগঠনগুলোর এখনও ভরসা কাস্তে-হাতুড়ি-তারা।
জনবিন্যাস: শিল্পাঞ্চল হওয়ায় এখানকার জনবিন্যাস সম্পূর্ণ মিশ্র । টিটাগড়, ভাটপাড়া এলাকা মূলত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত । এছাড়া টিটাগড়ে বহু দক্ষিণ ভারতীয় এবং শিখদের বাস । তাঁরা সকলে এখানকার ভোটার । ব্যারাকপুর, নৈহাটি, জগদ্দল এবং নোয়াপাড়ায় হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের বাস ।
বিধানসভা এলাকা: ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র । ব্যারাকপুর, আমডাঙা, জগদ্দল, নৈহাটি, বীজপুর, ভাটপাড়া এবং নোয়াপাড়া ।
অতীতের নির্বাচনী ফলাফল: 1952 সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের রামানন্দ দাস জয়ী হন এই কেন্দ্র থেকে । তার পরেরবার, অর্থাৎ 1957 সালে তৎকালীন প্রজা সোশালিস্ট পার্টির বিমল ঘোষ জয়ী হন । তার পরের বার থেকে প্রায় একচেটিয়া সিপিআইএমের গড়ে পরিণত হয় ব্যারাকপুর । 1962 সালে রেণু চক্রবর্তী থেকে 2009 সাল পর্যন্ত তড়িৎবরণ তোপদার ব্যারাকপুরের সাংসদ নির্বাচিত হন। মাঝে অবশ্য দু'বার কংগ্রেসের তরফে সৌগত রায় (তখনও তিনি তৃণমূলে যোগ দেননি) ও দেবী ঘোষাল লোকসভার টিকিটে জিতেছিলেন । সকলেই অবশ্য দুঁদে রাজনীতিক ।
ব্যারাকপুরের রাজনীতিতে সবচেয়ে হেভিওয়েট হিসেবে উচ্চারিত হয় তড়িৎবরণ তোপদারের নাম । দাপট ও জনপ্রিয়তায় একসময়ে তিনি ছিলেন পয়লা নম্বরে । এমনকি, বামেরা ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর তাঁর সক্রিয়তা কমতে থাকলেও এখনও সভা-মিছিলে তাঁর বক্তব্যের ধার, ফিকে হওয়া লাল শিবিরকে নতুন করে উজ্জীবিত করে তোলার টনিক হিসেবে কাজ করে ।
2009 সাল থেকে তৃণমূলের দখলে চলে যায় শিল্পাঞ্চল ব্যারাকপুর । সেবার লোকসভা ভোটে সিপিআইএম প্রার্থী তড়িৎবরণ তোপদারকে হারিয়ে সাংসদ হন তৃণমূলের দীনেশ ত্রিবেদী । 2014 সালে ফের সিপিআইএমের পরাজয় । 'বহিরাগত' সুহাসিনী আলিকে পরাজিত করে ফের সংসদে পা রাখেন দীনেশ । কিন্তু, 2019 সালের নির্বাচনে আচমকা শিবির বদল করে 'বাহুবলী' অর্জুন সিং বিজেপির প্রার্থী হন। দীনেশ ত্রিবেদীর বিরুদ্ধে প্রায় 15 হাজার ভোটে জয়ী হন অর্জুন । ব্যারাকপুর চলে যায় বিজেপির দখলে । সেবার 7টি বিধানসভার মধ্যে আমডাঙা বাদে বাকি 6টি বিধানসভা কেন্দ্রেই এগিয়ে ছিলেন বিজেপি প্রার্থী । তবে, 2021 বিধানসভা নির্বাচনে হারানো জমি অনেকটা পুনরুদ্ধার করে তৃণমূল । সাতটি'র মধ্যে 6টিতেই ঘাসফুল ফোটে । ভাটপাড়া অর্থাৎ অর্জুনের-গড়ে অবশ্য পদ্মই ফুটেছিল।
চব্বিশের লড়াই-সমীকরণ:
চব্বিশের লড়াইয়ে যুযুধান দু'জন- বিজেপির অর্জুন সিং ও তৃণমূলের পার্থ ভৌমিক । এ প্রসঙ্গে মহাভারতের কথা মনে পড়তে বাধ্য । পার্থ আর অর্জুন একই অঙ্গে যেন একে-অপরের প্রতিপক্ষ । আর এখানেই ব্যারাকপুরের ভোটযুদ্ধ ভিন্ন মাত্রায় আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে । নৈহাটির বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ । ভরসাযোগ্য সৈনিক । একুশের বিধানসভা ভোটে গেরুয়া বলয় থেকে দলকে পুনরুদ্ধারে তাঁর বড় ভূমিকা ছিল ।
অন্যদিকে, অর্জুন সিং ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে একেবারে ঘরের ছেলে। জন্ম-কর্মসূত্রে ব্যারাকপুরই তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র । বাহুবলী 'ইমেজ' গড়ে তোলা অর্জুনকে চেনেন না এমন মানুষ বোধহয় ব্যারাকপুরে নেই । এখানকার রাজনীতি এখনও বকলমে অর্জুনের নিয়ন্ত্রণে । সে অর্থে এখানকার অশান্তির নেপথ্যে তাঁকে দায়ী করে নির্বাচনী প্রচারে বারবার আক্রমণ শানাতে দেখা গিয়েছে একসময়ের তাঁর সতীর্থ, তৃণমূল প্রার্থী পার্থ ভৌমিককে । ব্যারাকপুরে 'গুন্ডারাজ' খতম করে শান্তির পরিবেশ ফেরানোর দাওয়াই-ও দিচ্ছেন অর্জুনের প্রতিপক্ষ পার্থ । পালটা তৃণমূল প্রার্থীকে কখনও 'অসুর'-এর সঙ্গে তুলনা টেনে আক্রমণ শানাচ্ছেেন পদ্মপ্রার্থী । আবার কখনও সন্দেশখালির প্রসঙ্গ টেনে পার্থ ভৌমিককে 'দুর্নীতিবাজ' বলে নিশানা করছেন অর্জুন সিং । জয়ের বিষয়ে একশো শতাংশ আত্মবিশ্বাসী দু'জনেই ।
এ দিকে, তৃণমূল-বিজেপিকে মানুষ এবার প্রত্যাখ্যান করে বামেদেরই সংসদে পাঠাবেন বলে মনে করছেন এই কেন্দ্রের সিপিআইএম তারকা প্রার্থী দেবদূত ঘোষ । ফলে, ব্যারাকপুরে 'কুরুক্ষেত্র'-র লড়াইয়ের কুর্সি কার দখলে যায়, তা জানতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছেন সাধারণ মানুষ ৷
আরও পড়ুন: