বনগাঁ, 18 মে: সীমান্ত শহর বনগাঁ বরাবরই অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । একদা সেখানে লালের আধিক্য থাকলেও আজ সে সব অতীত । এ বার লোকসভা নির্বাচনে খাতায় কলমে কংগ্রেস প্রার্থী একজন আছে ঠিকই, তবে এ বার বনগাঁর লড়াইটা মূলত দ্বিমুখী ৷ একদিকে আছেন তৃণমূল কংগ্রেসের বিশ্বজিৎ দাস আর অন্যদিকে রয়েছেন বিজেপির শান্তনু ঠাকুর । দু'জনেই একে-অপরকে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়তে নারাজ ৷ কার দখলে যাবে বনগাঁর কুর্সি, তারই তত্ত্বতালাশ করল ইটিভি ভারত ৷
শুরু থেকেই এই আসনে নির্বাচনে মতুয়ারাই ফ্যাক্টর ৷ মতুয়া ভোট যেদিকে, নির্বাচনের ফলও যায় সেদিকেই । একদা এই এলাকায় মতুয়া ভোটের সমর্থন বামেদের দিক থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন এই মুহূর্তে জেলবন্দি থাকা রাজের প্রাক্তন মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক । তাঁর হাত ধরেই ধীরে ধীরে 2001 বা তার পরবর্তী সময়ে বনগাঁর বিভিন্ন প্রান্তে ঘাসফুল ফোটা শুরু হয় । পরবর্তী সময়ে দেখা যায় 2009, 2014, এমনকি 2015 সালের উপনির্বাচনেও এই আসনে ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের জয়জয়কার ।
তবে হাওয়া ঘুরতে শুরু করে 2018 সালের পর থেকেই ৷ প্রধানমন্ত্রী ঠাকুরনগরে এসে সেখানে মতুয়া নাগরিকদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর থেকেই বনগাঁর উদ্বাস্তু মাটিতে পদ্মের চাষের জমি তৈরি হয়েছিল । 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে তার ফলও হাতেনাতে পায় বিজেপি ৷ দেখা যায়, এই আসনে ঠাকুরবাড়ির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শান্তনু ঠাকুর জয়ী হন তাঁরই জেঠিমা মমতাবালা ঠাকুরকে হারিয়ে । সে সময় তাঁর জয়ের ব্যবধান ছিল এক লক্ষ 11 হাজার 994 ভোটের । পরবর্তীতে তাঁকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পর্যন্ত করা হয় । সে বার শান্তনু ঠাকুরের প্রাপ্ত ভোট ছিল 6,87,622, মমতাবালা ঠাকুরের পান 5,76,028 ভোট ৷ আর সিপিআই(এম)-এর অলকেশ দাস পান 90,122টি ভোট ৷
এরপর যত সময় গিয়েছে, বনগাঁয় নিজের জমি হারিয়েছেন একদা উত্তর চব্বিশ পরগনায় তৃণমূল কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ নাম জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক । তিনি নিজের হার নিশ্চিত বুঝতে পেরে একুশে গাইঘাটা কেন্দ্র থেকে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি । বরং তিনি প্রার্থী হন হাবরায় । বনগাঁর ভোটচিত্রে ক্রমেই কমেছে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের প্রভাব । তাৎপর্যপূর্ণভাবেই সেখানে জায়গা করে নিচ্ছেন বিশ্বজিৎ দাসের মতো নেতারা ।
এরপর গত বিধানসভা নির্বাচন পর্যালোচনা করলেও দেখা যায়, বনগাঁর ভেতরে থাকা সাত বিধানসভায় ভালো ফল করেছে বিজেপি । দেখা যায়, এই লোকসভার ভেতরে থাকা কল্যাণী, বাগদা, হরিণঘাটা, বনগাঁ উত্তর, বনগাঁ দক্ষিণ ও গাইঘাটা- এই 6টি আসনেই জয়ী হন বিজেপি প্রার্থীরা। 2021 সালে তৃণমূল কংগ্রেস জিতেছিল একমাত্র স্বরূপনগর বিধানসভা কেন্দ্রে ।
এ বার লোকসভা নির্বাচনের আগে বাগদা থেকে জয়ী হওয়া বিজেপির বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাসকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল কংগ্রেস । বিধানসভা ফল ধরলে দেখা যাবে, কল্যাণীতে বিজেপি বিধায়ক অম্বিকা রায় এগিয়ে ছিলেন 2206 ভোটে, হরিণঘাটায় বিজেপি বিধায়ক অসীম সরকার এগিয়ে ছিলেন 15,200 ভোটে, বাগদায় তৎকালীন বিজেপি বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস এগিয়ে ছিলেন 9792 ভোটে, বনগাঁ উত্তরে অশোক কীর্তনীয়া 10,400 ভোটে এগিয়ে ছিলেন, বনগাঁ দক্ষিণে বিজেপি বিধায়ক স্বপন মজুমদার এগিয়ে ছিলেন 2004 ভোটে এবং গাইঘাটায় সুব্রত ঠাকুর এগিয়ে ছিলেন 9578 ভোটে ।
একুশের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে এখানে একমাত্র তৃণমূল কংগ্রেসের তরফ থেকে এগিয়ে ছিলেন স্বরূপ নগরের বিধায়ক বীণা মণ্ডল । তাঁর জয়ের ব্যবধান ছিল 34 হাজার ভোট। তাৎপর্যপূর্ণ হল, বিধানসভা নির্বাচনের পরই দলবদল করে বিজেপি থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে চলে আসেন বিশ্বজিৎ দাস ৷ এই মুহূর্তে তিনি বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি। একইসঙ্গে প্রার্থীও তিনি । নির্বাচনী লড়াইয়ে নামার আগে তাঁর হাতিয়ার হল, পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসকদলের ভালো ফল করা । দেখা গিয়েছে যে, পঞ্চায়েত এবং পৌরসভা ধরলে সিংহভাগই রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে। তথ্য বলছে, এই মুহূর্তে বনগাঁ লোকসভার মধ্যে থাকা 70টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে মাত্র ছ'টি রয়েছে বিরোধীদের দখলে ৷ বাকি সব ক'টিতেই জয় পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। আর সেখান থেকে তৃণমূল কংগ্রেস মনে করছে, এ বার লোকসভা নির্বাচনে ফল ঘুরবে।
এ দিকে, লোকসভা নির্বাচনের আগেই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বাস্তবায়ন এই সব এলাকার ভোটব্যাংকের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের মাস্টারস্ট্রোক ৷ শুধু মতুয়া নয়, এই অংশে থাকা বাংলাদেশিদেরও দীর্ঘদিনের দাবি নাগরিকত্ব । এতদিন যেটা প্রতিশ্রুতির পর্যায়ে ছিল, তাকে আইনি রূপ দিয়ে এই এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করেছে বিজেপি । তাই তারা দাবি করছে, এই মুহূর্তে মানুষের সমর্থন থাকবে তাদের দিকেই ।
এ দিকে তৃণমূল কংগ্রেস প্রথম দিন থেকেই সরাসরি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতা করে আসছে । দেখা গিয়েছে, এই জায়গায় ঠাকুরবাড়ির অন্দরেও ভিন্নমত রয়েছে । আর সেখান থেকেই এখানে ভোট ভাগের একটা সম্ভাবনা থাকছে । মতুয়া মানুষের কাছে নাগরিকত্ব বড় ইস্যু বলে তারা যেমন শান্তনুর মাধ্যমে অধিকার প্রাপ্তির কথা বলছেন কেউ কেউ । আবার একাংশের মধ্যে উন্নয়নের প্রশ্নে শান্তনুর বিরোধিতাও শোনা যাচ্ছে । শান্তনুকে তাঁর নির্বাচনী ক্ষেত্রে দেখতে না পাওয়া, উন্নয়নের কাজ না-করা, এমনই বিভিন্ন বিষয় সাধারণ মানুষের মুখে শোনা যাচ্ছে ৷ তাকে কি শেষ পর্যন্ত ভোটবাক্সে কাজে লাগাতে পারবে তৃণমূল ?
তবে তৃণমূল এবং বিজেপির দড়ি-টানাটানির ভাগীদার হতে চান না বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী প্রদীপ বিশ্বাস । নাগরিকত্ব নিয়ে প্রধান দুই প্রতিপক্ষের দ্বন্দ্বে নিজের অস্তিত্ব খুঁজছেন জোটপ্রার্থী । তাঁরা মনে করছেন, ধর্মীয় কারণে ভোট ভাগাভাগি মানুষ বুঝে গিয়েছে । এ বার বনগাঁর মানুষ তাঁদেরই সমর্থন করবে । তাঁদের আশা, জয়ী হবেন তাঁরাই। কিন্তু বাস্তবে কুর্সি কার দখলে যাবে, তার উত্তর দেবে সময় ।
আরও পড়ুন: