কলকাতা, 10 ডিসেম্বর: এতদিন রাজ্যের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলত বেসরকারিকরণের । এবার রাজ্য বিধানসভায় রামকৃষ্ণ পরমহংস বিশ্ববিদ্যালয় বিল ও রবীন্দ্রনাথ টেগর বিশ্ববিদ্যালয় বিল পাশ করতে গিয়ে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সেই বেসরকারিকরণের অভিযোগই উঠল । কীভাবে এই সরকারের আমলে পরিকাঠামোর উন্নয়ন না ঘটিয়ে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে, একের পর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, এই প্রশ্ন তুলে এদিন সরব হলেন বিজেপি এবং আইএসএফ বিধায়করা ।
এদিন পরিকাঠামো তৈরি না করে তড়িঘড়ি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন কমবেশি সমস্ত বিরোধী বিধায়ক । শংকর ঘোষ থেকে শুরু করে শান্তনু প্রামাণিক, আনন্দময় বর্মন, অম্বিকা রায়ের মতো বিধায়কেরা এই নিয়ে সরব হন । অন্যদিকে, ভাঙড়ের বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকীও এদিন সরাসরি রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বেসরকারিকরণের অভিযোগ তোলেন । জবাবী ভাষণে বেসরকারিকরণকে বাস্তবতা বললেও রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, পশ্চিমবঙ্গে এখনও সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাই বেশি ।
এদিন বেসরকারিকরণ নিয়ে বলতে গিয়ে 1991 সালের বিনিয়ন্ত্রণের হাত ধরে কীভাবে ভারতীয় অর্থনীতি এবং সমাজনীতিতে বেসরকারিকরণ প্রবেশ করেছিল তা তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু । তিনি বলেন, "1991 সালে লাইসেন্সরাজ ছাড়িয়ে যেভাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং বাণিজ্যমন্ত্রী বিনিয়ন্ত্রণ এনেছিলেন, তার ফলে সবকিছু বদলে গেল । আগে সরকারি চ্যানেলই ছিল, তবে 2001 থেকে 2005 এর মধ্যে তার সংখ্যা দাঁড়িয়ে গেল 90 । আগে যেখানে একটা সরকারি রেডিয়ো স্টেশন ছিল, পরবর্তীতে দেখা গেল এফএম রেডিয়ো স্টেশনে ভরে গেল । সব ক্ষেত্রেই এই রূপান্তর দেখা গিয়েছে । এখন বিধায়করা বেরিয়ে যখন ফোন করতে যান, তখন আর ইন্ডিয়ান টেলিকমের ফোনে ফোন করেন না ৷ বেসরকারি ফোনেই ফোন করেন । এটাই বাস্তব ।"
ব্রাত্য বসু বলেন, "যদি এখন কোনও বিধায়ক মনে করেন 30 বছর আগের মতো বিবিধ ভারতী শুনতে শুনতে বা অনুরোধের আসর শুনতে শুনতে দুপুরে আরাম করবেন তা আজ আর সম্ভব নয় । এখন 50টা টেলিভিশন এফএম চ্যানেল চলে এসেছে । এখন আপনি সরকারি যে তিন-চারটে চ্যানেল আছে সেগুলি দেখেন না । এটাই বাস্তবতা । একানববইয়ের বিনিয়ন্ত্রণ আমাদের এই বাস্তবতার সামনে এনে ফেলেছে । একে উপেক্ষা করার জায়গা নেই ।"
রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা বেসরকারিকরণের অভিযোগ খারিজ করে দিয়ে ব্রাত্য বসু বলেন, "এই সরকার আসার আগে বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল 11টা । কিন্তু এই সরকার আসার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে 46 । আজ দুটি এবং আগামিকাল আরও একটি মোট তিনটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল এখানে পাশ হওয়ার কথা । এগুলি যদি ধরে নিই তাহলে আমাদের রাজ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা হবে 15টি । অতএব সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয় এখনও আমাদের রাজ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে বেশি । গোটা দেশে সবচেয়ে বেশি সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে । এক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের অভিযোগ ভ্রান্ত ।"
তিনি বলেন, "উত্তরপ্রদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি, মধ্যপ্রদেশ এবং গুজরাতেও বেশি । আমাদের রাজ্যে কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি নয় । যাতে গরিব নিম্নবিত্ত মানুষ পড়াশোনা করতে পারে, তার জন্য সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয় এখানে বেশি । এটা প্রথম থেকেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যবস্থা করেছেন । গরিব নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা যাতে পড়াশোনার সুযোগ পায়, তারা যাতে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারে, সেজন্য মুখ্যমন্ত্রী প্রথম দিন থেকেই সতর্ক ।"
প্রসঙ্গত, এদিন যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় বিল পাশ হল রাজ্য বিধানসভায়, তার একটি তৈরি হবে হুগলির ধনেখালিতে, অপর বিশ্ববিদ্যালয়টি তৈরি হবে উত্তর 24 পরগনার আগরপাড়াতে । এদিন এই বিল পাশ করতে গিয়ে অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল, বিজেপি বিধায়ক প্রায় 60টির কাছাকাছি সংশোধনী এনেছেন । এর মধ্যে দুটি সংশোধনী গৃহীত হয়েছে । অতীতে কোনও বিধায়ক কোনও নির্দিষ্ট বিলে আলোচনায় এত সংশোধনী দিয়েছেন মনে করতে পারছেন না অনেকেই ।
যদিও রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী এ দিন একটি সংশোধনী, যেটি ঠিকানা নিয়ে ছিল তা মেনে নিয়েছেন । অন্যদিকে, বিলের নাম নিয়ে একটি সংশোধনী ছিল, সেটির ক্ষেত্রেও শিক্ষামন্ত্রী তাতে সমর্থন জানিয়েছেন ৷ তবে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় যাঁরা তৈরি করছেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন । যদিও দিনের শেষে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় বিল ধ্বনি ভোটে রাজ্য বিধানসভায় পাশ হয়েছে ।