একটি প্রগতিশীল অর্থনীতি এবং এক শক্তিধর রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে তা সবসময়ই আগ্রহের বিষয়। বিশেষ করে সেই শক্তিধর দেশ যখন একাধিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তখন স্বভাবতই পরিস্থিতি অনেক বেশি জটিল। ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে সদ্য শেষ হওয়া সামিট হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সাহায্য করবে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমেরিকা সফরের আগেও নানা ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছিল। আমেরিকার 47তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। উপস্থিত ছিলেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও। সেই অনুষ্ঠানে গিয়ে নয়া মার্কিন প্রশাসনের বেশ কয়েকজন শীর্ষকর্তার সঙ্গেও আলোচনা সেরেছেন তিনি। দু'দেশের সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত চর্চা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদিও সেই কাজ করেছেন। আমেরিকায় গিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করার আগে তিনিও মার্কিন প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

তালিকায় ছিলেন, মার্কিন গোয়েন্দা অধিকর্তা তুলসি গ্যাবার্ড থেকে শুরু করে ইলন মাস্ক, বিবেক রামাস্বামী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ওয়ালটজ-সহ আরও কয়েকজন । এঁদের সঙ্গে বিস্তারিত চর্চার পর ট্রাম্প-মোদি বৈঠক হয়। ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হচ্ছে। এই সুযোগকে অবশ্যই কাজে লাগাতে চাইবে দিল্লি। আমেরিকা যাতে ভারতের স্বার্থের দিকে খেয়াল রাখে সেটা নীরবে নিশ্চিত করতে চাইবে ভারত । অভিবাসন থেকে শুরু করে আমদানি কর সংক্রান্ত সংঘাতের অংশ অবশ্য হতে চাইবে না ভারত।
চার বছর পর জো বাইডেনের দলকে পরাজিত করে ক্ষমতায় এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্বিতীয়বার আমেরিকার প্রথম নাগরিক হওয়া ট্রাম্প এবং তাঁর দলের কাছে এবারের ইনিংস সববিচারেই তাৎপর্যপূর্ণ। তাছাড়া প্রশাসন কীভাবে চালাবে তার সুস্পষ্ট রূপরেখা তৈরি করে রেখেছে টিম ট্রাম্প। কী করবে আর কী করবে না তা তাদের কাছে স্পষ্ট। শপথ নেওয়ার পর থেকে নিজের আগের থেকে ঠিক করে রাখা লক্ষ্যের দিকে দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছেন ট্রাম্প।
গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ট্রাম্প বিদেশ নীতিতে বদল এনেছেন । বদল এনেছেন দেশ পরিচালনের নানা নীতিতেও। তাঁর মনে হয়েছে, বিশ্বায়ন আমেরিকার উৎপাদন শিল্পকে ধ্বংস করে দিয়েছে। পাশাপাশি আমেরিকায় অবাধে বিভিন্ন দেশের মানুষের যাতায়াত সেদেশের নিজস্বতার ক্ষতি করেছে। সেদিক থেকে মার্কিন অর্থনীতিকে গতি দিতে অভিবাসন নীতির বদল প্রয়োজন ছিল বলে তিনি মনে করেন। একইভাবে বিভিন্ন দেশের উপর অতিরিক্ত পরিমাণে আমদানি কর চাপিয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। ভারত এ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দিতে চায়নি। আমেরিকা সফরের সময়ও আমদানি কর বৃদ্ধি নিয়ে মন্তব্য বা প্রতিবাদ কোনওটাই করেননি ভারতের শীর্ষনেতারা। তার একটাই কারণ, আমেরিকার বিদেশ নীতি বা অন্য কোনও নীতি কি হবে সেটা ঠিক করে দেওয়া ভারত বা অন্য কোনও দেশের কাজ নয় ।

অধ্যাপক দুর্গেশ রাইয়ের পর্যবেক্ষণ, ভারতের যে দশটি দেশের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি টাকার ব্যবাসা করে তার মধ্যে একমাত্র আমেরিকার সঙ্গেই লেনদেন এখনও ইতিবাচক । অর্থাৎ ভারতের কোনও টাকা আমেরিকা আটকে রাখেনি। এই প্রবণতায় ছেদ পড়ুক তা কখনও চাইবে না দিল্লি । আমদানি কর সংক্রান্ত সমস্যা মোটেই নুতন নয়। নির্বাচনে জেতার পর থেকেই ট্রাম্প দাবি করছেন ভারত-সহ কয়েকটি দেশ আমেরিকার সংস্থাগুলিকে নিজেদেরে দেশে ব্যবসা করতে দিতে অতিরিক্ত কর নেয় । এবার থেকে আমেরিকাও কর বাড়িয়ে দেবে। ট্রাম্প-মোদি সাক্ষাতে এই বিষয়টি বাধা হিসেবে দেখা দিতে পারে কিনা তাও চর্চায় এসেছিল।
ভারতের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসন কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে তা অবশ্যই নয়। তবে তিনি তাঁর প্রশাসনের আধিকারিকদের কয়েকটি বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন। তা থেকে স্পষ্ট তিনি চান তাঁর প্রশাসন এমন একটা রাস্তা অবশ্যই খুঁজে বের করুক যেখানে ভারত যে হারে মার্কিন সংস্থাগুলির থেকে কর নেয় সেই হারেই ভারতে কর দিতে হবে। সফরের সময় ভারতের প্রতিনিধিরা অবশ্য এ নিয়ে প্রতিবাদের রাস্তায় হাঁটেননি। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। তবে এটা ঠিক যে দু'পক্ষের মধ্যে ব্যবসার ক্ষেত্রে থাকা বিভিন্ন বাধা নিয়ে যে বিস্তারিত চর্চা হয়েছে তা দেখা গিয়েছে দু'দেশের যৌথ বিবৃতিতে। দু'দেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে নয়া বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করে ফেলবে। সেই চুক্তির মধ্যে একাধিক ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। দুটি দেশের স্বার্থই যাতে রক্ষিত হয় তা দেখা হবে। তাছাড়া আগামী 5 বছরের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ 500 বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।

500 বিলিয়ন ডলার সংখ্যাটা অবশ্যই বিরাট। এই লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করা যে চ্যালেঞ্জিং তাও সর্বজনবিদিত। ভারত আমেরিকার থেকে আরও বেশি পরিমাণে অসংশোধিত তেল আমদানি করতে চায়। পাশাপাশি তরল গ্যাসও আমদানি করতে চায় দিল্লি । ছোট ছোট নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের সাহায্যে আরও বেশি পরিমাণে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করার লক্ষ্যও রয়েছে দুটি দেশের। যৌথ বিবৃতিতেই ঘোষণা করা হয়েছে, কর নিয়ে তৈরি হওয়া জটিলতা নিরসনের চেষ্টা হচ্ছে।
আমেরিকায় থাকা অবৈধ অভিবাসীদের দেশে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে ভারত। বেশ কিছু অভিবাসী ইতিমধ্য়ে মার্কিন বিমানে চেপে ভারতে এসে পৌঁছেছেন। তাঁদের শিকল পরা ছবি দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। মোদি সরকার এই আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করেছে-এমনটা নয়। অন্যদিকে, অবৈধ উপায়ে ভারতীয়রা যাতে উচ্চশিক্ষা নিতে বা অন্য কোনও কারণে আমেরিকায় যেতে না পারেন সেই ব্যবস্থা করছে দিল্লি।
মোদি-ট্রাম্পের বৈঠক থেকে আরও একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে । তার নাম ট্রাস্ট (ট্রান্সফর্মিং রিলেশনশিপ ইউটিলাইজিং স্ট্র্যাটেজিক টেকনলজি । সেমিকন্ডাক্টার থেকে শুরু করে কোয়ানটাম প্রযুক্তি, শক্তির উৎপাদন এবং মহাকাশ সংক্রান্ত বিষয়ে একে অপরকে সাহায্য করবে ভারত ও আমেরিকা। পাশাপাশি খনিজ সম্পদ সংক্রান্ত গবেষণা যাতে চালানো যায় তার জন্য এক দেশ অন্য দেশকে সর্বদা সাহায্য করবে বলে ঠিক করেছে। বিশেষ করে কাঁচামাল পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে।
প্রতিরক্ষার ব্যাপারে দু'দেশের মধ্যে বিস্তারিত চর্চা হয়েছে। প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনে একে অন্য়কে সাহায্য করবে ভারত ও আমেরিকা। এই সমঝোতা অবশ্য অস্ত্র উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। প্রতিরক্ষা শিল্পের বিস্তারে একে অপরের পাশে থাকবে দুই দেশ । সমুদ্রের উপর নজরদারি রাখতে ব্যবহৃত বিমান উৎপাদন করবে ভারত । আরও 6টি এই ধরনের পি 81 বিমানের উৎপাদন হতে চলেছে। সেগুলি আমেরিকা কিনবে। অন্যদিকে, ট্রাম্প জানিয়েছেন, ভারতে এফ 35 যুদ্ধ বিমান পাঠাবে আমেরিকা।
দুটো দেশই অটোনোমাস সিস্টেমস ইন্ড্রাস্ট্রি অ্য়ালায়েন্সের অংশ হয়েছে। 2008 সালের আগে আমেরিকা খুব কম পরিমাণে প্রতিরক্ষা সামগ্রী ভারতে পাঠাত। এখন তা আগের থেকে অনেকটাই বেড়েছে। একইভাবে আমেরিকায় পাঠানো ভারতের প্রতিরক্ষা সামগ্রীর পরিমাণ টাকার অঙ্কের বিচারে 20 বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছে। ভারত এবং আমেরিকার বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে চুক্তি হওয়ায় প্রতিরক্ষার প্রশ্নে আমেরিকা এখন ভারতের অন্যতম প্রধান গন্তব্য। এখান থেকেই স্পষ্ট দু'দেশের মধ্য প্রতিরক্ষা বিষয়ক আদান-প্রদান আগামিদিনে আরও বাড়বে।
একটা সময় মনে করা হয়েছিল ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প আমেরিকার সঙ্গী দেশগুলির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের সঙ্কট সমলাতে সময় খরচ করবেন। তবে কার্যক্ষেত্রে সেটা হয়নি। ট্রাম্প শপথ নেওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কোয়াড গোষ্ঠিতে থাকা বিভিন্ন দেশের বিদেশমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাছাড়া শপথ নেওয়ার মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে ভারত ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী-সহ মোট চারজন রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে দেখা করেছেন।
একইসঙ্গে ভারত-মার্কিন যৌথ বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, অবিলম্বে কোয়াডের মধ্যে থাকা দেশের প্রধানরা মিলিত হবেন। এবং সেখান থেকে কিছু বিশেষ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এখন থেকে কোনও একটি দেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আটকে পড়া বাসিন্দাদের আকাশপথে উদ্ধার করতে সাহায্য করবে অন্য দেশ। পাশাপাশি সমুদ্রে নজরদারির ক্ষেত্রেও একে অপরকে সাহায্য করবে সদস্য দেশগুলি।
মোদি-ট্রাম্প বৈঠকের পর প্রাথমিকভাবে মনে করা যায়, পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই দুটি দেশ আরও বেশি সঙ্ঘবদ্ধ হবে। দুয়ের বেশি দেশ জড়িত এমন ক্ষেত্রেও সাহায্যের বাতাবরণে বড় পরিবর্তন আসবে বলে ভেবে নেওয়ার বিশেষ কোনও কারণ নেই। তবে আমেরিকার রাজনীতিতে বদল সর্বদা আচমকাই আসে । এ কথা মাথায় রেখে ভারত নিজের স্বার্থ নিয়ে ভাবিত হবে। কিন্তু অভিবাসন নীতি বা আমাদানি কর নিয়ে সরব প্রতিবাদে সামিল হবে না। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলির দিক থেকে ভারতের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোনও ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে কি না সেটাও আমেরিকা গুরুত্ব দিয়ে দেখবে। বিভিন্ন দেশে ক্ষমতার হস্তান্তর এমনিতেই বিশ্ব রাজনীতিকে জটিল করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে ভারত ও আমেরিকার মতো গণতান্ত্রিক দেশের এক হওয়া সমস্ত দিক থেকে জরুরি।
(ডিসক্লেইমার: এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব । এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং বিশ্লেষণ ইটিভি ভারতের মতামতকে প্রতিফলিত করে না)