ভারতের নগর শাসন নীতি এবং এর বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে একটি স্পষ্ট ব্যবধান রয়েছে । ভারতীয় শহরগুলি 'বিশ্বমানের' হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করে ৷ যদিও, তাদের নগর উন্নয়নের পরিকল্পনা করার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থার অভাব রয়েছে । আন্তর্জাতিক মেট্রো শহরগুলি, যেগুলির নগর প্রশাসন পরিচালনা করেন মেয়ররা, সেখানে তাঁদের প্রশাসনিক কাজ এবং অর্থ খরচের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে ৷ এখানকার ছবিটা অবশ্য সম্পূর্ণ বিপরীত ৷ উপস্থিত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাগুলি শহরের প্রশাসকদের নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধ করে, যার ফলে শহরগুলিকে সর্বব্যাপী ও প্রাণবন্ত করে তোলে ।
প্রজা ফাউন্ডেশনের তরফে সম্প্রতি আরবান গভর্নেন্স ইনডেক্স (ইউজিআই) 2024 প্রকাশ করা হয়েছে ৷ সেখানে ভারতের বিকল নগর প্রশাসনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে ৷ ‘এমপাওয়ারড সিটি ইলেক্টেড রিপ্রেজেন্টেটিভ এবং লেজিসলেটিভ স্ট্রাকচার’-এর সাব-থিমের অধীনে 30 পয়েন্টের স্কেলে রাজ্যগুলির (মেঘালয় ও নাগাল্যান্ড বাদে) মূল্যায়ন করা হয় ৷ সেখানে সর্বনিম্ন পেয়েছে পঞ্জাব, 6.79৷ সবচেয়ে বেশি পেয়েছে কেরালা, 18.63 ।
ভারতে শহরের ক্ষমতায়নের জন্য নীতিগত মনোযোগ দেওয়া হয় ৷ 74তম সাংবিধানিক সংশোধনী আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এটা শুরু হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে প্রধান নগর উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে তহবিল দেওয়ার সময় এগুলিকে সংস্কার শর্ত হিসাবে যুক্ত করা হয় ৷ তার পরও ইউজিআই-এর মতে, ভারতীয় শহরগুলি বিভিন্ন উপায়ে ব্যাপক পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ক্ষমতাহীন ।
অনিয়মিত পুরসভা নির্বাচন
পুরসভার নির্বাচন হল নগর প্রশাসনের নির্বাচিত সদস্যদের জবাবদিহি করার সরাসরি মাধ্যম । 74তম সংবিধান সংশোধন পাঁচ বছরের মেয়াদ-সহ নগর প্রশাসনের সমস্ত আসন পূরণের জন্য সরাসরি নির্বাচন বাধ্যতামূলক করে । রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে পুরসভা নির্বাচনের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ৷ এর মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া জড়িত, সেগুলি হল - ভোটার তালিকা তৈরি ও আপডেট করা, ডিলিমিটেশন ও সংরক্ষণ তালিকা প্রস্তুত করা এবং নির্বাচন পরিচালনা ।
বাস্তবে এই কাজগুলি একাধিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হয়, যার ফলে পুরসভা নির্বাচনে অত্যধিক বিলম্ব হয় । মাত্র চারটি রাজ্যের নির্বাচন কমিশনকে ওয়ার্ডের ডিলিমিটেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ৷ অন্যান্য রাজ্যে এই কাজ রাজ্য সরকারের বিবেচনার উপর নির্ভর করে ৷ গ্রেটার হায়দরাবাদ মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের নির্বাচন প্রায় পাঁচ বছর বিলম্বিত হয়েছিল ৷ কারণ, রাজ্য সরকার রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে আপডেট করা সীমানা ও সংরক্ষণ তালিকা সরবরাহ করতে পারেনি ।
সংরক্ষণ তালিকার জটিলতা ও অস্বচ্ছতা, প্রায়ই মামলার দিকে নিয়ে যায় পুরো বিষয়টিকে । অনেক ক্ষেত্রে, মহিলাদের জন্য বা মেয়র পদের জন্য ওয়ার্ড সংরক্ষণ করা ছাড়াও, মহিলা সংরক্ষণের মধ্যে তফশিলি জাতি এবং তফশিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষণের প্রয়োজন হয় ৷ কর্ণাটকে 2018 সালের অগস্ট 2020 সালের জানুয়ারির মধ্যে মেয়র এবং ডেপুটি মেয়র পদের জন্য সরকার কর্তৃক রিজার্ভেশনের বাধ্যতামূলক রোটেশন সংক্রান্ত মামলার কারণে 280টি ইউএলবি-এর মধ্যে 187টিতে মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিল গঠন করা যায়নি ৷
ব্রুহত বেঙ্গালুরু মহানগর পালিকে 2020 সালের সেপ্টেম্বর থেকে একটি নির্বাচিত নগর প্রশাসন ছাড়াই কাজ করছে । এর জন্য ব্রুহত বেঙ্গালুরু মহানগর পালিকে (বিবিএমপি) পরিচালনা করতে 2020 সালে নতুন বিবিএমপি আইন এবং 2023 সালে গ্রেটার বেঙ্গালুরু গভর্ন্যান্স বিল প্রবর্তন করা হয় ৷ তাই পুরসভা নির্বাচনের জন্য রাজ্য সরকারের অনিচ্ছাকেই দায়ী করা হয়েছে ৷
সাধারণভাবে, রাজ্য সরকারগুলি প্রায়ই অসম বিলম্বের কৌশল অবলম্বন করে ৷ কারণ, রাজ্যস্তরের রাজনীতিবিদ ও আমলারা নির্বাচিত কাউন্সিলরদের প্রভাবকে এবং নির্বাচনী এলাকার জন্য সরাসরি হুমকি হিসাবে দেখেন ৷ এর ফলে রাজ্য সরকারের কর্তৃত্বও কমে যায় বলে মনে করা হয় । নগর প্রশাসনগুলিকে রাজ্য সরকারগুলির করুণার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়, যা যেকোনও উদ্দেশ্যে পুরনো বোর্ডের মেয়াদে ইতি টানতে পারে ৷ এটা অযৌক্তিক, এমনকি বিরক্তিকরও । পুরসভা নির্বাচনে এই ধরনের অনিয়ম এবং নির্বাচিত পুর পরিষদের অনুপস্থিতি 74তম সংবিধান সংশোধনে পরিকল্পিত গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জবাবদিহি চাওয়ার সুযোগকে দুর্বল করে ।
মেয়র - আনুষ্ঠানিক প্রধান
74তম সংবিধান সংশোধন অনুসরণ করে, রাজ্য সরকারগুলি মেয়র নির্বাচনের পদ্ধতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয় । নির্বাচিত নগর প্রশাসনের পাঁচ বছরের মেয়াদ থাকলেও আমাদের শহরে মেয়র পদে নির্বাচনের পদ্ধতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে । প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় মডেলের নির্বাচনের বিধান রয়েছে, যার মেয়াদ এক থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে পরিবর্তিত হয় ।
এমনকি, কিছু রাজ্যে রাজ্যস্তরে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের পরিবর্তনের সঙ্গে নির্বাচনের ধরন পরিবর্তিত হয় । মুম্বই, পুনে, সুরাত এবং আমেদাবাদের মতো শহরগুলিতে মেয়রের মেয়াদ আড়াই বছরের । অন্যদিকে, বেঙ্গালুরু ও দিল্লির মতো কিছু বড় শহরের মেয়রের মেয়াদ মাত্র এক বছরের । নেতৃত্বের অগ্রাধিকার পরিবর্তনের সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে এই ধরনের সংক্ষিপ্ত মেয়াদের ক্ষেত্রে সংস্কার নীতি রূপায়নের সুযোগ কমে যেতে পারে ৷
তাছাড়া, মেয়রের ভূমিকা ও কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে, যা প্রশাসনিক কাজে গুরুতর ঘাটতি তৈরি করে । নির্বাচিত কাউন্সিলরদের নগর প্রশাসন পরিচালনা ও পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব রয়েছে । ইউজিআই 2024 রিপোর্ট অনুসারে, নির্বাচিত কাউন্সিলরদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের জন্য কোনও রাজ্যের বিধান নেই ।
খণ্ডিত শাসন
সাধারণত রাজ্য সরকারগুলি শহর পরিচালনার জন্য প্রশাসক নিয়োগ করে । এটা প্রায় প্রতিটি রাজ্য সরকারের একটি নিয়মিত বিধিবদ্ধ অনুশীলনে পরিণত হয়েছে । রাজ্য নিযুক্ত মিউনিসিপ্যাল কমিশনার পুরসভা সংক্রান্ত বিষয়গুলির উপর নির্বাহী কর্তৃত্ব ভোগ করেন । যাই হোক, নির্বাচিত নগর প্রশাসনেক পুর কমিশনারদের কাজের উপর খুব বেশি কর্তৃত্ব নেই ।
বিষয়টিকে আরও খারাপ করার জন্য, নির্বাচিত নগর প্রশাসনগুলি মৌলিক নগর পরিষেবা সম্পর্কিত সমস্যাগুলি ঠিক করতে অক্ষম ৷ কারণ, এর বেশিরভাগই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্যারাস্টেটাল সংস্থাগুলির আওতাভুক্ত, যা নগর প্রশাসনগুলির কাছে দায়বদ্ধ নয় ৷ নগর পরিকল্পনা নির্বাচিত নগর প্রশাসন দ্বারা প্রস্তুত করা হয় না । রাজ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতারা শহরগুলির জন্য পরিকল্পনা করেন । তবে কিছু ব্যতিক্রম আছে । কলকাতার কমিশনার, প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে মেয়র-ইন-কাউন্সিলের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন ।
ভোপালে এমআইসি সিস্টেম রয়েছে, যেখানে সরাসরি নির্বাচিত মেয়র 5 কোটি টাকা পর্যন্ত প্রকল্প অনুমোদনের আর্থিক ক্ষমতা উপভোগ করেন । কেরালায় মেয়র কমিশনারের কাজের বার্ষিক মূল্যায়ন করতে পারেন । কিছু রাজ্য সরকার (যেমন, গুজরাত, কর্ণাটক) পুর সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য স্থায়ী কমিটির ব্যবস্থা করে । যাই হোক, সমস্ত রাজ্য সরকার এই কমিটির চেয়ারপার্সনদের নিয়োগের জন্য মেয়রের কাছে কর্তৃত্ব হস্তান্তর করে না ।
ইউজিআই 2024-এর রিপোর্ট অনুসারে, 31টি শহরের মধ্যে 15টিরও বেশিতে মেয়র স্থায়ী কমিটির চেয়ারপার্সন নন । নির্বাচিত মেয়রের চেয়ে স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান বেশি ক্ষমতাবান । নির্বাচিত কাউন্সিলররা কমিটি দ্বারা গৃহীত সিদ্ধান্তগুলিকে খুব কমই প্রভাবিত করতে পারে । নগর শাসনের জন্য এর দু’টি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে । প্রথমত, প্রশাসকরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ না-হওয়ায় নগর প্রশাসনের জবাবদিহি করার বিষয়টি দুর্বল হয়ে পড়ে । দ্বিতীয়ত, একাধিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ কেন্দ্রের অস্তিত্ব শহরের স্তরে রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে খণ্ডিত করে ।
তা সত্ত্বেও, শহর স্তরে ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে, রাজ্য-প্যারাস্ট্যাটাল এবং নগর বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেওয়া বাস্তবসম্মত । তবে এটা নগর প্রশাসন এবং তাদের নির্বাচিত কাউন্সিলরদের প্রান্তিকতার দিকে নিয়ে যাবে না, এখন যেমন হয় । এখানে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হল, সেই কাজগুলি চিহ্নিত করা, যার জন্য শহরগুলি এককভাবে দায়ী ৷ রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির সঙ্গে কাজ অনুযায়ী ভাগ, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের একটি পরিষ্কার বিভাজন এবং সমন্বয় প্রয়োজন ।
আগামীর পথ
ভারতীয় শহরগুলো বিশ্বমানের হয়ে ওঠার স্বপ্ন সত্যি হবে না যতক্ষণ তাদের এই ধরনের শাসন ব্যবস্থা থাকবে । সুতরাং, শহরগুলিকে তাদের উন্নয়নের গতিপথ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য সংস্কার প্রয়োজন । নিয়মিত পুরসভা নির্বাচন এবং ভারতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত নগর প্রশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সক্ষমতা বৃদ্ধি-সহ বেশ কয়েকটি অন্যান্য পদক্ষেপের সঙ্গে এর পরিপূরক হওয়া দরকার ।
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের ৷ এখানে প্রকাশিত তথ্য ও মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)