হায়দরাবাদ, 26 সেপ্টেম্বর: রাজস্থানের একটা ছোট্ট গ্রাম ৷ চারিদিকে ফাঁকা মাঠ ৷ দূর দুরান্তে জনমানসের দেখা নেই ৷ দিনের আলোয় এবড়ো খেবড়ো মেঠো পথ ধরে হাঁটার সময় দূরে নজরে আসে এক মহিলা ৷ পেট পর্যন্ত ঘোমটা টানা এক মহিলা হেঁটে চলেছেন ৷ চারিদিকে কেউ নেই অথচ সেই মহিলা মাথার ঘোমটা তোলেননি ৷
উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান সহ বিভিন্ন জায়গায় এমন অনেক অজানা গ্রাম আছে যেখানে ফুল আর পুষ্পার মতো মেয়েদের সঙ্গে কোনও একসময়ে দেখা হয়েছিল লেখক, চিত্রনাট্যকার, পরিচালক বিপ্লব গোস্বামীর সঙ্গে ৷ যিনি সাধারণ দুই মেয়ের অসাধারণ গল্প তুলে ধরেন লাপাতা লেডিজ ছবির হাত ধরে ৷ কেমন ছিল সেই জার্নি, শুরুইবা হল কীভাবে, জনপ্রিয় চিত্রনাট্যকার, পরিচালক বিপ্লবের 'রূপকথা' মাখা গল্প শুনল ইটিভি ভারত ৷
ইটিভি ভারত- দেশের হয়ে অস্কারের মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করছে 'লাপাতা লেডিজ' ৷ প্রথম শোনার পর অনুভূতি কেমন ছিল?
বিপ্লব- সেটা একটা দারুণ অনুভূতি ৷ খবরটা শোনার পর অসাধারণ একটা ভালোলাগা কাজ করেছে ৷ তবে এখটা জিনিস সঙ্গে আছে, আমি যখন থেকে সিনেমা লেখা শুরু করেছিলাম ৷ অনেকগুলো দৃশ্য, সংলাপ লেখার পর মনে হয়েছিল, এটা যখন সিনেমা হয়ে আসবে তখন ভারতীয় দর্শকদের কাছে যেমন গ্রাহ্যতা পাবে, ভালোবাসা পাবে তেমনই দেশের বাইরেও এটা সমাদৃত হবে ৷ মনে হয়েছিল ছবির বিষয়বস্তু এতটাই ইন্টারেস্টিং এবং গভীর যে বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এই ছবি যাবে ৷ একটা ধারনা আমার মনের মধ্যে তৈরি হচ্ছিল ৷
ইটিভি ভারত- ছবির জন্য এই লেখা কবে থেকে শুরু হয়েছিল?
বিপ্লব- আসলে আজ থেকে প্রায় 10 বছর আগে এই ছবির আইডিয়ার একটা সারাংশ লিখে ফেলেছিলাম ৷ বেশ কিছুটা সময় চিত্রনাট্য লেখার পর আমি সময় নিই ৷ বিভিন্ন রুরাল জায়গা ঘুরে দেখেছি মানুষের জীবনের ছোট ছোট মুহূর্ত ৷ কী রকম তাঁদের পোশাক-আশাক বা ভাবের আদান প্রদান ৷ এই সিনেমার প্রয়োজনে আরও ঘুরে বেড়াই, রিসার্চ করি ৷ আর একটু গভীর ভাবে ভাবতে শুরু করি ৷
ইটিভি ভারত- 'লাপাতা লেডিজ'-এর গল্প কীভাবে পৌঁছল কিরণ রাও ও আমির খানের হাতে?
বিপ্লব- প্রায় 5-6 বছর আগে একটা স্ক্রিপ্ট রাইটিং প্রতিযোগিতা হয়েছিল দেশে ৷ গ্লোবাল সার্চ ফর ইন্ডিয়ান স্ক্রিপ্ট রাইটারস-নামে প্রতিযোগিতায় হিন্দি সিনেমার জন্য স্ক্রিপ্ট রাইটারদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ৷ ঘটনাটা ঘটে 2018 সালের শেষের দিকে ৷ আমি এই গল্পের আগের যে সারংশ ও কুড়ি-পঁচিশটা দৃশ্য তৈরি করে রেখেছিলাম সেটা নিয়ে পাকাপাকি ভাবে বসি ৷ পুরো স্ক্রিপ্ট তৈরি করে জমা দিই ৷ সৌভাগ্যক্রমে প্রায় 4 হাজার স্ক্রিপ্টের মধ্যে এটা দ্বিতীয় হয় ৷ এই প্রতিযোগিতায় জুরি মেম্বার হিসাবে ছিলেন আমির খান, জুহি চতুর্বেদী, অঞ্জুম রাজাবলি ও রাজকুমার হিরানী ৷ প্রত্যেকের এই ছবির চিত্রনাট্য ভীষণ ভালোলাগে ৷
অস্কারের মঞ্চে ভারতের 'তুরুপের তাস' লাপাতা লেডিজ, উচ্ছ্বসিত সিনেপ্রেমীরা
ইটিভি ভারত- তারপর?
বিপ্লব- জুরি মেম্বারদের মধ্যে আমির খানজি ওনার বাড়িতে একদিন ডাকেন আমায় ৷ স্ক্রিপ্ট আরও একবার শুনলেন তিনি এবং কিরণ রাওজি ৷ পরবর্তী সময়ে উনি জানান এই ছবি প্রযোজনা করতে চান তিনি ৷ আর জানান এই ছবি পরিচালনা করতে চান কিরণ রাও ৷ তারপর আস্তে আস্তে আজকের পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়ায় ৷ তাছাড়া আমির খানের ছবি আমার ভীষণ ভালো লাগে ৷ ওঁনার বিভিন্ন ছবি আমাকে মুগ্ধ করেছে ৷ আর কিরণ রাওজি ভীষণ ভালো চলচ্চিত্র পরিচালক৷
ইটিভি ভারত- দুজন মহিলার মাধ্যমে দেশের মেয়েদের কথা তুলে ধরার ভাবনা কী প্রথম থেকেই ছিল?
বিপ্লব- একদম, আমি সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউটে পড়াশোনা করার আগে থেকেই এই ধরনের বিষয় নিয়ে একটা ভাবনাচিন্তা ছিল ৷ আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া নারী-পুরুষের বৈষম্য, বিশেষ করে বিভিন্ন জায়গায় নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা বা অন্তরায় অনেক বেশি ৷ নিরপেক্ষ ভাবে একজন ছেলে বা পুরুষ হয়েও আমার মনে হত এই বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলা বা কাজ করা দরকার ৷ আমরা রাইটার-ফিল্মমেকার ৷ এই নিয়ে কথা বলতে গেলে সিনেম্যাটিক ফর্ম আনতে পারি ৷ ফলে আমি যা যা দেখেছি, উগ্র পুরুষতান্ত্রিকতা, একটা লিঙ্গ বৈষ্যমের বিভিন্ন চেহারা বিভিন্ন জায়গায়- সেগুলোই আনার চেষ্টা করেছি গল্প বা স্ক্রিপ্টটির মাধ্যমে ৷
ইটিভি ভারত- পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের 'দেবী', 'মহানগর' বা 'পথের পাঁচালী'র মতো সিনেমাতে নারীদের অন্য রূপ তুলে ধরা হয়েছে ৷ সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট থেকে পড়াশোনা করায় তা কী প্রচ্ছন্ন প্রভাব ফেলেছে আপনার মধ্যে?
বিপ্লব- কনসাসসি-আনকনসাসলি সত্যজিৎ রায়-সহ অনেক বিশ্ব বিখ্যাত পরিচালকের কাজ আমাকে ইন্সপায়ার করেছে, এটা ঠিক। ছোটবেলা থেকেই শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল ৷ নানা রকমের সিনেমা দেখতে পছন্দ করতাম ৷ সাহিত্যের দিকেও ঝোঁক ছিল ৷ এই সবকিছুই হয়তো আমার অজান্তে মনের অবচেতনে কাজ করতে শুরু করে ৷ পরবর্তী সময়ে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে পড়াকালীন সেই বিষয়টা পূর্ণতা পায় ৷
ইটিভি ভারত- ছবির জন্য গল্পের ভাঁজ অনেক সময় পরিবর্তন হয় ৷ এক্ষেত্রে কী হয়েছে?
বিপ্লব- সিনেমার খাতিরে যখন এই বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসা হয় তখন কিছু পরিবর্তন এসেছে ৷ পরবর্তী সময় স্নেহা দেশাইজি, দিব্যানীধি শর্মাজি ওনারাও স্ক্রিন প্লে ও ডায়লগস নিয়ে কাজ করেন ৷ তারপর সিনেমাটি তৈরি করার জন্য খুব সুন্দর একটা টিম তৈরি হয় ৷ প্রত্যেকে অসাধারণ কাজ করেছেন ৷
ইটিভি ভারত- কেমন ইনপুট ছিল ?
বিপ্লব- যেমন ধরুন, পুলিশ ইন্সপেক্টর মনোহরজির যে চরিত্র ছিল আমার লেখায় ছিল সেখানে অনেক সুন্দর সুন্দর সংলাপ দিয়েছেন দিব্যানীধি শর্মাজি ৷ যার ফলে চরিত্র আরও বেশি গভীরতা পেয়েছে ৷ মঞ্জু মাই চরিত্রও চিত্রনাট্যে ছিল ৷ কিন্তু সেই চরিত্রের মধ্যেও আরও কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সংলাপ আনা হয় ৷ যার কিছু সাজেশন দিয়েছেন আমিরজি, কিছু কিরণজি এবং দিব্যানীধি-স্নেহা ৷
ইটিভি ভারত- সিনেমার ছোট ছোট দৃশ্যের গভীরতা মারাত্মক.. মঞ্জু মাইয়ের মুখে সেই সংলাপ যেখানে তিনি বলছেন..."এই দেশে মেয়েদের সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে ফ্রড চলছে..যার নাম ভালো ঘরের বৌ-মেয়ে"..
বিপ্লব- এই দৃশ্য সত্যিই অসাধারণ ৷ এখানে বেশ কিছু সংলাপ যোগ করা হয়েছে ৷ পার্টিকুলার এই ডায়লগ কিন্তু যতদূর মনে পড়ছে লিখেছেন স্নেহা দেশাইজি বা দিব্যানীধিজি ৷
ইটিভি ভারত- পরবর্তী কাজ কী আসছে?
বিপ্লব- দক্ষিণ ভারত বেস করে একটি সিনেমা লিখছি। খুব শিগগিরি অফিশিয়ালি ঘোষণা করা হবে। সেই জন্য কিছুদিন আগেই হায়দরাবাদ ঘুরে গিয়েছি। তাছারা আরও কিছু সিনেমার রিসার্চ এবং পরিকল্পনা চলছে।