ঢাকা, 9 ডিসেম্বর: বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে চায় ভারত । দু’দেশের সম্পর্কে টানাপড়েনের আবহে ঢাকায় দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সোমবার এ কথাই জানালেন বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রি ৷ হাসিনা-পরবর্তী সময়ে ইউনুস প্রশাসনের সঙ্গে এটাই ছিল ভারতের প্রথম উচ্চস্তরীয় দ্বিপাক্ষক বৈঠক ৷
এদিন অন্তর্বর্তী সরকারের মুখ্য উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুসের সঙ্গেও দেখা করেন বিদেশ সচিব মিস্রি ৷ তাঁর সঙ্গে ছিলেন ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় বর্মাও ৷ তবে বৈঠক শেষে খানিকটা ভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া দিয়েছে বাংলাদেশ। দুই দেশের সচিব স্তরে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পরেও হিন্দু-সহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার খবরগুলিকে 'বিভ্রান্তিকর ও ভুয়ো তথ্য' বলে উল্লেখ করল বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রক ৷ একই সঙ্গে ইউনুস প্রশাসন ফের বার্তা দিল, কোনও দেশেরই অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো উচিত নয় ৷
সম্প্রতি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের ঘটনা ও গত 25 নভেম্বর ঢাকায় গ্রেফতার হওয়া চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পর ইউনুস প্রশাসনের কড়া সমালোচনা করে ভারত ৷ এরপর থেকেই দু'দেশের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে টানাপোড়েন চলছে ৷ এই পরিস্থিতিতে সোমবার সকালে ফরেন অফিস কনসালটেশনে (এফওসি) অংশ নিতে ঢাকায় পৌঁছন বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রি এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দল ৷
ঢাকায় পৌঁছে সরকারি অতিথিনিবাস পদ্মা ভবনে বাংলাদেশের বিদেশসচিব মহম্মদ জসীম উদ্দিনের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বসেন মিস্রি ৷ কয়েকটি পর্যায়ে দু'ঘন্টা ধরে চলা এই বৈঠকের পর বাংলাদেশের বিদেশ দফতরের উপদেষ্টা মহম্মদ তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন মিস্রি।
এই সৌজন্য সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বিদেশ সচিব ৷ তিনি জানান, উচ্চস্তরীয় এই বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের আধিকারিকদের কাছে হিন্দু-সহ সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনার কথা উত্থাপন করেছেন ৷ একই সঙ্গে ভারত যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে গভীরভাবে কাজ করতে ইচ্ছুক, তাও তুলে ধরেছেন ৷
বিদেশ সচিব মিস্রি বলেন, "সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি নিয়ে আলোচনা হয়েছে ৷ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও ভালো থাকা নিয়ে আমরা যে উদ্বিগ্ন, সেটাও জানিয়েছি ৷ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সম্পত্তির উপর হামলা চালানোর মত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাগুলি নিয়েও কথা হয়েছে ৷"
বৈঠক শেষে বাংলাদেশের বিদেশ সচিব জসীম উদ্দিনের বার্তা বাংলাদেশের বিদেশ সচিব জসীম উদ্দিন অবশ্য বলেন, "ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলিতে বাংলাদেশের বিষয়ে ভুল তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে ৷ জুলাই-অগস্ট মাসে বিপ্লবের সময় এবং তারপরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হিংসার অভিযোগ নিয়ে ভুয়ো তথ্য ছড়ানো হচ্ছে ৷ এই বিষয়ে আমরা তাদের (ভারত সরকারের) দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি ৷ যথোপযুক্ত পদক্ষেপ করতে বলেছি ৷" তিনি জানান, ঢাকা আশা করে দু'দেশের মানুষের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তুলতে এই ধরনের নেতিবাচক প্রচারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে ভারত সরকার ৷ তিনি জোর দিয়ে জানান, বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে তাঁদের ধর্মীয় উপাচার পালন করছেন ৷ জসীম উদ্দিন বলেন, "একই সঙ্গে আমরা এটাও বলেছি যে, কোনও দেশেরই অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো উচিত নয় ৷ বাংলাদেশ অন্য দেশের নিজস্ব বিষয়ে কখনও মন্তব্য করে না ৷ ঢাকাও একই সম্মান আশা করে ৷" এদিনের আলোচনা নিয়ে বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রকের অন্যতম শীর্ষ আধিকারিকের কথায়, "বিদেশ সচিবের এই সফর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী করতে সাহায্য করবে ৷ দু'দেশ একে অপরকে তাদের দুশ্চিন্তার বিষয়ে জানাতে পারবে ৷ সম্পর্কের পারিপার্শ্বিক ইস্যুগুলি নিয়েও আলোচনা হবে ৷" ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্তে যেন কারও যেন মৃত্যু না হয়, অর্থাৎ 'জিরো কিলিং'কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় তার জন্য দু'তরফই একে অপরকে অনুরোধ করেছে ৷ ভারতের সঙ্গে যে ইস্যুগুলি নিয়ে সমস্যা রয়েছে, তার সমাধান আশা করছে ঢাকা ৷ বাংলাদেশের বিবৃতি অনুযায়ী, 9 ডিসেম্বরের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তিস্তার জল ভাগ করার চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে ৷ এছাড়া গঙ্গা জল চুক্তি (গঙ্গা ওয়াটার ট্রিটি) নিয়েও কথা হয়েছে ৷ 2026 সালে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৷ পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশের বিদেশ সচিব বলেন, "আমরা তাদের (ভারত) অনুরোধ করেছি, ভারত থেকে যেন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ বজায় থাকে ৷" |
এদিকে নয়াদিল্লি যে ঢাকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চায়, তাও আজ স্পষ্ট করলেন মিস্রি ৷ তিনি বলেন, "আমাদের মধ্যে অত্যন্ত খোলামেলা আলোচনা হয়েছে ৷ বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক, গঠনমূলক এবং উভয়ের পক্ষে লাভজনক সম্পর্ক চায় ভারত ৷" বিদেশ সচিব মিস্রি জানান, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, শক্তি, বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া, কূটনৈতিক বোঝাপড়া-সহ একাধিক বিষয়ে দু'দেশের প্রতিনিধির মধ্যে কথা হয়েছে ৷
মিস্রি বলেন, "অতীতের মতোই বর্তমানেও ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় ৷ অন্তর্বর্তী এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মহম্মদ ইউনুসের শপথ নেওয়ার পর প্রথম যে রাষ্ট্রপ্রধানেরা অভিনন্দন জানান, তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ৷ আমরা ভবিষ্যৎ নিয়েও আশাবাদী ৷"
সম্প্রতি ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডেপুটি হাইকমিশন চত্বরে ভাঙচুর থেকে অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আইনি উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সোশাল মিডিয়ায় ভারতের উদ্দেশে কড়া বার্তা দিয়ে বলেন, "সাম্য ও পারস্পরিক স্বাধীনতার উপর ভিত্তি করে যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, আমরা তাতে বিশ্বাসী ৷ শেখ হাসিনা নির্বাচনকে বাদ দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে ভারতমুখী নীতি নিয়ে চলতেন ৷ ভারতের বোঝা উচিত এটা শেখ হাসিনার বাংলাদেশ নয় ৷"
গত 5 অগস্ট বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৷ এরপর 8 অগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্ব অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় ৷ আওয়ামি লীগ সরকারের পতনের পরেও বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের খবর সামনে আসে ৷ তবে, আগরতলার ঘটনার পর নয়াদিল্লি কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তীব্র নিন্দা করে বিবৃতি জারি করে ৷