হায়দরাবাদ, 17 ডিসেম্বর: প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় বলতেন, কোনও একটি নির্বাচন শেষ না-হওয়া পর্যন্ত তার ব্যাখ্যা করা যায় না। নির্বাচনের ফলাফল হাতে নিয়েই ভোটে কী হল, আর কেন হল তা বোঝা যায়। এমন ভাবনার উপযুক্ত উদাহরণ হতে পারে 2024 সালের লোকসভা নির্বাচন। চারশোর বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় ফেরার ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা এনডিএ ক্ষমতায় ফিরলেও নিজেদের প্রত্যাশার ধারে কাছে পৌঁছতে পারেনি। নরেন্দ্র মোদি টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হতে পারেনি বিজেপি । পরাজয়ের অন্ধকারে ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকা কংগ্রেসকে কার্যত নবজীবন দিয়েছে 2024 সালের লোকসভা নির্বাচন। অন্যদিকে, বাংলায় বিজেপির ফল গতবারের থেকে বেশ খানিকটা খারাপ হয়। আরও একবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরেই আস্থা রাখেন রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষ।
দেনা-পাওনা
সাত দফায় হওয়া এই লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন প্রায় 64.2 কোটি ভোটার। তামাম দুনিয়ার নির্বাচনী ইতিহাসে এর আগে এত মানুষ কখনও কোনও একটি নির্বাচনে অংশ নেননি । সংখ্যার বিচারে বিজেপি পেয়েছে 240টি আসন, কংগ্রেস পেয়েছে 99টি আসন, তৃণমূল পেয়েছে 29টি আসন । শতাংশের বিচারে বিজেপি পেয়েছে 36.55 শতাংশ ভোট। কংগ্রেস পেয়েছে 21.19 শতাংশ ভোট । আর তৃণমূল পেয়েছে 4.37 শতাংশ ভোট।
এর পাশাপাশি বিরোধী ইন্ডিয়া শিবিরের দুটি বড় দল ডিএমকে এবং সমাজবাদী পার্টি পেয়েছে যথাক্রমে 22টি এবং 37টি আসন। শাসক এনডিএ-র দুই বড় শরিক জনতা দল ইউনাইটেড (জেডিইউ) এবং তেলগু দেশম পার্টি (টিডিপি) যথাক্রমে 12টি এবং 16টি আসন পেয়েছে। বালাসাহেব ঠাকরের পুত্র উদ্ধবের শিবসেনা পেয়েছে 9টি আসন আর শরদ পাওয়ারে এনসিপি পেয়েছে 8টি আসন। এর পাশাপাশি সিপিএম পেয়েছে 4টি আসন। সিপিআই (এমএল) পেয়েছে 2টি আসন। আম আদমি পার্টি (আপ)-র দখলে গিয়েছে 3টি আসন। নির্দলরা জয়ী হয়েছেন 7টি আসনে। মাত্র 1টি করে আসন পেয়েছে এমন দলের সংখ্যাও কম নয় । এর মধ্যে তামিলনাড়ুর অন্যতম বড় দল এআইএডিএমকেও আছে ।
ভাঙলেন মোদি, তবে মচকালেন না
লোকসভা নির্বাচনের প্রচার তখনও সেভাবে শুরু হয়নি। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতিও শেষ হতে অনেকটা বাকি। কোন দলের ফল কেমন হবে তা মেপে উঠতে পারছেন না দেশের তামাম নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। সকলেই বলছেন, আর একটু সময় দরকার। কিন্তু তিনি বরাবরই নিজের কাজে ভরসা রাখেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলতে শুরু করলেন, ‘ইস বার, চারশো পার।’ তাঁর আরও দাবি ছিল বিজেপি একাই 370টির কাছাকাছি আসন পাবে। সেটা হয়নি। দেশের তিনটি বড় রাজ্য, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং পশ্চিমবঙ্গে ধাক্কা খেতে হয়েছে বিজেপিকে। তার জেরে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও মেলেনি দশ বছর বাদে। তবে তাতে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়া আটকায়নি। জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধি এবং তাঁর নিজের দল বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অটল বিহারী বাজপেয়ীর মতো মোদিও তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী পরে প্রধানমন্ত্রী থাকা মোদিকে কখনই জোট শরিকদের নিয়ে চলতে হয়নি। এবার হচ্ছে। রাজনৈতিক মহলের অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, চন্দ্রবাবু নাইডু বা নীতীশ কুমারদের সামলাতে হয়তো সমস্যায় পড়বেন মোদি। তবে নতুন সরকারের প্রথম 6-7 মাসে তেমন কোনও সংবাদ শিরোনামে আসেনি ।
রাহুল 'ফিনিক্স' গান্ধি
অসমের এক হেভিওয়েট নেতা একসময় কংগ্রেসে ছিলেন। এখন তিনি বিজেপিতে। পুরনো দল ছাড়ার আগে তিনি নাকি রাহুলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। দল চালাতে বা দলে থাকতে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে সেটাই ছিল আলোচনার মূল বিষয়। নেতার অভিযোগ, তাঁর কথা শোনার থেকে রাহুলের মন বেশি ছিল নিজের সারমেয়কে বিস্কুট খাওয়ানোতে। বিজেপির প্রচারতন্ত্রের সৌজন্যে দেশের আম জনতার কাছে রাজীব-তনয়ের ইমেজ যেন এমনই হয়ে গিয়েছিল। লোকসভা নির্বাচনের আগে দুটি যাত্রা রাহুলকে এক পরিণত রাজনীতিবিদ হিসেবে তুলে ধরেছে। বিশেষ করে ভারত জোড়ো যাত্রা রাহুলকে যে এক নতুন রাজনৈতিক পরিচয় দিয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। লোকসভা নির্বাচনের বছর দেড়েক আগে সেনাপতিও বদল করেছে কংগ্রেস। দলিত নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গের হাতে গিয়েছে সভাপতিত্ব। এর আগে কখনও কোনও দলিত নেতা কংগ্রেসের সভাপতি হননি।
ভোটের প্রচারে দেশের সর্বত্র বিজেপির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনের কথা তুলে ধরতে পেরেছিল কংগ্রেস। ভোটের ঠিক আগে দলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যায় একটি নির্দিষ্ট আর্থিক কারচুুপির অভিযোগে। দল প্রচারের অর্থ দিতে পারছে না বলে পুরীর মতো কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী টিকিটও ফিরিয়ে দেন। তবু লড়াই থেকে সরে আসেনি কংগ্রেস । উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা- একের পর এক বিজেপি শাসিত রাজ্যে অবাক করে কংগ্রেস। যদিও সদ্য শেষ হওয়া মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে শতাব্দী প্রাচীন দলটির ফলাফল হয় অত্যন্ত খারাপ।
তথ্য বলছে, এখন মহারাষ্ট্রে কংগ্রেসের সাংসদ সংখ্যা 13। আর বিধায়ক সংখ্যা 15। এমন রাজনৈতিক সমীকরণ সচরাচর দেখা যায় না। লোকসভার ফল কেন কংগ্রেস বিধানসভা নির্বাচনে ধরে রাখতে পারল না, সেই তর্কে না গিয়ে বলা যায় এবারের লোকসভা নির্বাচন কংগ্রেসকে নতুন রাজনৈতিক জীবন দিয়েছে। গত দুটি নির্বাচনের মত এবারও যদি ফলাফল একইরকম হত তাহলে ভারতীয় রাজনীতি নামক খরস্রোতা নদীতে খড়কুটো আকড়ে বেঁচে থাকাও মুশকিল হত কংগ্রেসের জন্য ।
বাংলার আস্থা মমতায়
বছর তিনেক আগে বিধানসভা নির্বাচনে চমকে দেওয়া ফলাফল লোকসভার নির্বাচনের আগে তৃণমূলকে সুবিধেজনক অবস্থায় রেখেছিল । তবে শিক্ষা থেকে শুরু করে একাধিক ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ এবং বঙ্গের হিন্দুদের একটি অংশ বিজেপির দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় খানিকটা হলেও অস্বস্তিতে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তবে সেই অস্বস্তির কোনও প্রভাব দলে পড়তে দেননি মমতা-অভিষেক। মার্চ মাসের ব্রিগেড সমাবেশ থেকে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে তৃণমূল। সেদিন শুধু প্রার্থী ঘোষণা হয়নি। প্রার্থীদের নিয়ে কার্যত ব়্যাম্পে হেঁটেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তালিকায় ছিল একাধিক চমক। ক্রিকেট থেকে বিনোদন এবং পোড়খাওয়া রাজনীতিক ছিলেন সকলেই। তবে প্রার্থী নির্বাচনের আগে তৃণমূলের অন্দরে কলহের কিছু খবরও মিলেছিল।
উত্তর কলকাতায় দলের দীর্ঘদিনের সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন কুণাল ঘোষ । শেষমেশ কুণাল-সুদীপ সমঝোতা হয়ে যায়। তবে তৃণমূলের আরেক পুরনো নেতা তাপস রায় যোগ দেন বিজেপিতে। তাঁকেই সুদীপের বিরুদ্ধে প্রার্থী করে বিজেপি। ঠিক একইভাবে নানা কারণে বিজেপি ছেড়ে আসা মুকুটমণি অধিকারী থেকে শুরু করে কৃষ্ণ কল্যাণীদেরও প্রার্থী করে তৃণমূল। শেষমেশ এই তিনজনের কেউই অবশ্য জিততে পারেননি।
ইন্দ্রপতনের তালিকা আরও বড় করেছেন দিলীপ ঘোষ থেকে শুরু করে এসএস আলুওয়ালিয়ার মতো বড় নেতারা। উল্টো দিকে জুন মালিয়া থেকে শুরু করে সায়নী ঘোষেদের মতো অন্য জগৎ থেকে আসা তারকাদের উপর আস্থা রেখে প্রবল সাফল্য পায় তৃণমূল।
অন্যদিকে, সৃজন ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে প্রতীক উর রহমান, সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো তরুণ মুখেদের প্রার্থী করে লাভের লাভ হয়নি বামেদের। নিজেদের সেরা বাজি মহম্মদ সেলিম থেকে শুরু করে সুজন চক্রবর্তীদেরও নির্বাচনী ময়দানে নামিয়ে ছিল বামেরা। তাতেও আসন জয়ের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল।
বামেদের হাত ধরে শক্তি আরও কমেছে কংগ্রেসেরও । বহরমপুরে নিজের চেনা মাঠে অচেনা প্রতিপক্ষ ইউসুফ পাঠানের কাছে হেরে গিয়েছেন অধীর চৌধুরী। পশ্চিমবঙ্গের এবারে নির্বাচন সরাসরি প্রাক্তন স্বামী-স্ত্রীর লড়াইয়ে দেখেছে । বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর আসন থেকে প্রাক্তন স্ত্রী সুজাতা মণ্ডলকে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন সৌমিত্র খাঁ। আবার প্রাক্তন জামাইকে হারিয়ে চতুর্থবারের মতো শ্রীরামপুরের সাংসদ হয়েছেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কৃষ্ণনগর আসন থেকে রাজ পরিবারে সদস্য অমৃতা রায়কে হারিয়ে দ্বিতীয় বার লোকসভায় পৌঁছেছেন মহুয়া মৈত্র। তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার মেগা-মঞ্চে ছিলেন রাজ্য রাজনীতির অন্যতম বড় বাহুবলী নেতা অর্জুন সিং। ব্যারাকপুর আসন থেকে টিকিটও চেয়ে পাননি 2019 সালে। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে সাংসদ হন । 2021 সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর আবারও ফিরে আসেন তৃণমূলে। তবে এবার প্রার্থী হতে না পেরে ফের বিজেপিতে যান অর্জুন । প্রার্থী হলেও হেরে যান রাজ্যের মন্ত্রী (অধুনা প্রাক্তন) পার্থ ভৌমিকের কাছে।
ভোটের মুখে গ্রেফতারি
ভোট শুরুর কয়েক মাস আগে দুর্নীতির দুটি পৃথক অভিযোগে গ্রেফতার হন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। ইডির হাতে গ্রেফতার হতে হবে বুঝতে পেরে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দেন হেমন্ত। এর কয়েক মিনিট বাদেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয় । অন্যদিকে, গ্রেফতার হয়ে তিহাড় জেল থেকেই দিল্লি চালাবার পরিকল্পনা করেছিলেন অরবিন্দ। সেভাবেই কেটেছে বেশ কয়েক মাস। পরে তিনি জামিন পান।
প্রকাশ্য জনসভায় জানিয়ে দেন যতদিন না পর্যন্ত দিল্লির মানুষ আবার তাঁকে নির্বাচিত করছেন, ততদিন তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন না। আপাতত দলের নেত্রী অতিশী হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ঝাড়খণ্ডে অবশ্য ইতিমধ্যেই বিধানসভা নির্বাচন হয়ে গিয়েছে। কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপিকে পরাজয়ের মুখ দেখিয়েছেন হেমন্ত। তাঁর নেতৃত্বে নতুন সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। তবে এই দুটি রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীদের গ্রেফতার করে বিজেপির ফল খারাপ হবে বলে অনেকেরই মনে হয়েছিল। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, ভাল ফল করেছে বিজেপি।
চন্দ্রই’বাবু’ অন্ধ্রপ্রদেশে
লোকসভার সঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল অন্ধ্রপ্রদেশে। ফলাফল প্রকাশের পর দেখা গিয়েছে বিরাট জয় পেয়ে ক্ষমতায় ফিরেছেন টিডিপি প্রধান চন্দ্রবাবু নাইডু। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা জগনমোহন রেড্ডির দল ওয়াইএসআর কংগ্রেস কার্যত অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি ইন্ডিয়া শিবিরও।
175টি আসনের বিধানসভায় টিডিপি লড়েছিল 144টি আসনে। তার মধ্যে জিতেছে 135টি আসনে । পবন কল্যাণের দল জনসেনা পার্টি 21টি আসনে লড়ে সবকটিতেই জেতে। 10টি আসনে লড়ে 8টিতে জিতেছে বিজেপি। অন্যদিকে, সব আসনে লড়াই করেও মাত্র 11টি আসনে জিতেছে জগনমোহন রেড্ডির দল। 25টি লোকসভা আসনের মধ্যে 16টি পায় টিডিপি। 3টি পায় বিজেপি আর 2টি পায় জনসেনা পার্টি। সব আসনে লড়েও মাত্র 4টি আসন জেতেন জগনমোহনরা ।
নবীনের পতন, ওড়িশায় গেরুয়া-ঝড়
রাজনৈতিক পালা বদলের সাক্ষী হল ওড়িশাও। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা বিজেডি-কে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো এককভাবে ওড়িশায় ক্ষমতায় এল বিজেপি । ফল প্রকাশের পর সন্ধ্যায় দিল্লিতে বিজেপির সদর দফতরের অনুষ্ঠান থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন এবারই প্রথম প্রভু জগন্নাথের ভূমিতে নিজের মুখ্যমন্ত্রী পাবে বিজেপি। সেই মতো মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেন মোহন মাঝি।
ভোটের ফলাফল অবশ্য বলছে, বিজেডির বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়াকে কাজে লাগাতে পেরেছে বিজেপি। ফলাফল অনুযায়ী 147টি আসনের মধ্যে এনডিএ পেয়েছে 81টি আসন। বিজেপি একাই পেয়েছে 79টি আসন। 2টি গিয়েছে নির্দলদের দখলে। সবচেয়ে বেশি সময় মুখ্যমন্ত্রী থাকা নবীন পট্টনায়কের দল বিজেডি পেয়েছে 51টি আসন। কংগ্রেস পেয়েছে 14টি আসন। 1টি আসন জিততে পেরেছে সিপিএম। অন্যদিকে, লোকসভার 21 টি আসনের মধ্যে 20টি জিতেছে বিজেপি । কংগ্রেস পেয়েছে 1টি আসন । এত বছর ক্ষমতায় থাকা বিজেডি একটি আসনও জিততে পারেনি।
হরিয়ানায় পদ্ম-বিজয়
লোকসভা নির্বাচনে হিন্দি বলয়ে কংগ্রেসের ফল ভালো হয় । হরিয়ানার দশটি আসনের মধ্যে পাঁচটি জেতে কংগ্রেস । এই ফলাফল দেখে অনেকেরই মনে হয়েছিল বিধানসভা নির্বাচনে হয়তো কংগ্রেস শেষ হাসি হাসবে। বিভিন্ন বুথ ফেরত সমীক্ষাতেও উঠে এসেছিল সে কথাই। কিন্তু শেষমেশ জয় হয় বিজেপির । লোকসভা নির্বাচনের সময় হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী বদল করে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। অপেক্ষাকৃত তরুণ নায়াব সিং সাইনিকে নিয়ে আসা হয় প্রবীণ মনোহরলাল খট্টরের জায়গায়। মাত্র দুশো দিন মুখ্যমন্ত্রী থাকা সাইনি বিজেপিকে ঝকঝকে জয় উপহার দিতে ভুল করেননি। বিজেপি পায় 48টি আসন। আর কংগ্রেসের ঝুলিতে যায় 37টি আসন।
বিজেপি কোন জাদুতে হরিয়ানা নির্বাচন জিতেছে তা নিয়ে চর্চার অন্ত নেই। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল থেকেই বোঝা গিয়েছিল জাঠ ভোটাররা বিজেপির থেকে মুখ ফিরিয়েছেন। সেকথা মাথায় রেখে রাজ্যের অন্য জনজাতির ভোটারদের কাছে টানার চেষ্টা করে বিজেপি। তার সরাসরি প্রভাব পড়ে নির্বাচনে। পাশাপাশি কংগ্রেসের মধ্যে থাকা দলীয়-দ্বন্দ্ব বিজেপিকে জিততে সাহায্য করেছে বলেও মনে করে রাজনৈতিক মহলের একটা বড় অংশ।
কাশ্মীর ওমর আবদুল্লার
জম্মু-কাশ্মীরে বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার পর এই প্রথম নির্বাচন হয়। 10 বছর বাদে বিধানসভা ভোট হয় জম্মু-কাশ্মীরে। তাতে ইন্ডিয়া শিবিরের ফলাফল ভালো হয়েছে। ওমর আব্দুল্লার দল ন্যাশনাল কনফারেন্স পেয়েছে 42টি আসন । বিজেপি পেয়েছে 29টি আসন। কংগ্রেস পেয়েছে 6টি আসন। নির্বাচনী ইতিহাসে জম্মু ও কাশ্মীরে এর থেকে বেশি আসন কখনও পায়নি বিজেপি। জম্মু থেকেই নিজেদের সব আসন জিতলেও কাশ্মীরে দাগ কাটতে ব্যর্থ গেরুয়া শিবির ।
মহারাষ্ট্রের মহাযুদ্ধে মহাযুতি
জুন মাসে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনে কী হতে পারে তা রাজনৈতিক মহলে তরজা চলছিল। বিরোধী শিবিরও মনে করেছিল লোকসভার ফসল ঘরে তোলা যাবে বিধানসভা নির্বাচনে। হয়েছে ঠিক তার উল্টো । নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে বিজেপি।
পরপর তিনবার মহারাষ্ট্রে সব থেকে বড় দলও হয়েছে বিজেপি। বিরোধী কংগ্রেস, উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা এবং শরদ পাওয়ারের এনসিপি যখন সংবিধানের জয়গান করছেন, তখন নির্বাচনী প্রচারে ‘লাডলি বহেন-লাডলি ভাউ’র মতো প্রকল্পের কথা বলে বাজিমাত করল এনডিএ। দেবেন্দ্র ফড়নবিশের উপর আস্খা রেখেছিল বিজেপি । একনাথ শিন্ডে এবং অজিত পাওয়ারকে সঙ্গে নিয়ে আবারও ফড়নবিশ এনডিএ-কে বড় জয় এনে দিলেন ।
আড়াই বছর আগে মহাবিকাশ আঘাড়ি থেকে অখণ্ড শিবসেনার বিধায়কদের ভাঙিয়ে এনে সরকার গড়ে বিজেপি । সেবার একনাথের উপর মুখ্যমন্ত্রিত্বের ভার যায়। কিন্তু এবার দেবেন্দ্রকেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে । নির্দলদের সঙ্গে নিয়ে 288 আসনের মহারাষ্ট্র বিধানসভায় বিজেপি পায় 132টি আসন। শিন্ডেরা জেতেন 58টি আসনে । অজিত পাওয়াররা জয়ী হন 41টি আসনে। অন্যদিকে বালাসাহেব-তনয়ের শিবসেনা পায় 20টি আসন। কংগ্রেস পায় 15টি আসন এবং শরদ পাওয়ারের এনসিপি পায় 10টি আসন ।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও মহারাষ্ট্রে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনে কিছুটা বেগ পেতে হয় বিজেপিকে। টানা এগারো দিনেরও বেশি আলোচনার পর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন দেবেন্দ্র। একনাথ আর অজিত শপথ নেন তাঁর দুই ডেপুটি হিসেবে।
হেমন্ত ‘কামব্যাক’ সোরেন
রাজনীতিতে যে কোনও কাজ প্রথম শুরু করার চেয়ে বিরতির পর ফিরে আসা সবসময় কঠিন । তবে এটাও ঠিক যে ভারতীয় রাজনীতি গত সাড়ে সাত দশকে বহু 'কামব্যাক কিং' দেখেছে। মোরারজি দেশাই, ইন্দিরা গান্ধি থেকে শুরু করে অটল বিহারী বাজপেয়ীদের ক্ষমতা থেকে সরে গিয়ে আবার ফিরে আসার গল্প তেমন অজানা নয়। তবে সাম্প্রতিক অতীতে ভারতীয় রাজনীতির সবথেকে চর্চিত ফিরে আসা নায়কের নাম হেমন্ত সোরেন।
ভারতীয় রাজনীতির গুরুজি হিসেবে পরিচিত শিবু সোরেনের ছোট ছেলে লোকসভা নির্বাচনের আগে জেলে গিয়েছিলেন। তাঁর জায়গায় মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন চম্পাই সোরেন। জামিন পেয়ে ফিরে এসে আবারও মুখ্যমন্ত্রী হন হেমন্ত। দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন চম্পাই।
এমনই ঘটনাবহুল পরিস্থিতিতে ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা নির্বাচন হয়। মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা দেশের কৃষিমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান এবং অসমের মুখ্যমন্ত্রী তথা উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপির ম্যানফ্রাইডে হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে প্রচারে ঝড় তোলে বিজেপি।
বাংলাদেশে থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীরা ঝাড়খণ্ডে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করছে। তাতে ঝাড়খণ্ডের নিজস্ব সামাজিক ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য বদলে যাচ্ছে। এমন অভিযোগ তুলে ব্যাপক প্রচার হয়। তাতেও কাজের কাজ হয়নি। ঝাড়খণ্ডে 81টি আসনের মধ্যে 56টি আসনে জয়ী হয়েছে জেএমম, কংগ্রেস, আরজেডি ও সিপিআই (এমএল)(এল)-এর 'ইন্ডিয়া' শিবির ৷ মহিলা ভোটারদের মন পেতে ‘মাইয়া সম্মান যোজনা’ শুরু করেছিল সরকার। তাতে মহিলারা 1 হাজার টাকা করে পেতেন । এবার ভোটের পর সেই অঙ্ক বেড়ে 2500 টাকা করা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে সরকার। আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্যে শিবু সোরেনের হাতে তৈরি ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম) একাই পেয়েছে 34টি আসন । বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ পেয়েছে 21টি আসন ৷
সংসদে পা প্রিয়াঙ্কার
2024 সালের শেষ লগ্নে লোকসভার সদস্য হলেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধি । দাদার ছেড়ে আসা কেরলের ওয়েনাড় আসন থেকে প্রতিপক্ষ সিপিআই প্রার্থী সত্যেন মোকেরিকে 4 লক্ষ 10 হাজার 931 ভোটে পরাজিত করেন প্রিয়াঙ্কা ৷ লিডের বিচারে দাদা রাহুলকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন। বিজেপির নভ্য়া হরিদাস 11.48 শতাংশ ভোট পেয়ে ছিলেন তৃতীয় স্থানে ৷ তাঁর সঙ্গে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াঙ্কার ভোটের ব্যবধান 5 লক্ষ 12 হাজার 399 ৷ প্রিয়াঙ্কার জয়ের ফলে সংসদে গান্ধি পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেড়ে হল 3 । তাছাড়া জওহরলাল নেহরু এবং বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের আবার এক দাদা-বোনের জুটি দেখতে চলেছে সংসদ। সাংসদ হিসেবে শুরুটা অবশ্য় ভালোই হয়েছে প্রিয়াঙ্কার। সংবিধান নিয়ে বিতর্কে তাঁর ভাষণ অনেকেরই নজর কেড়েছে।