বারাসত, 23 জানুয়ারি : পোষ্য বলে কি ভালোবাসার টান থাকবে না? ভালোবাসার জন্য মানুষ প্রাণ দিতে রাজি এমন অনেক লোক দেখা গেলেও, পোষ্যকে বাঁচাতে আত্মহত্যার আবেদন এই প্রথম ৷ ঘটনাটি ঘটেছে বারাসতে ৷ মাস কয়েক আগে টানা ২১ দিন অনাহারে থাকার পর বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে জেলাশাসকের কাছে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন করেছিলেন বারাসতের এক মহিলা । এবার প্রতিবেশী ও কাউন্সিলরের হুমকি পেয়ে পোষ্য সারমেয়দের বাঁচাতে নিরুপায় হয়ে জেলাশাসকের কাছে আত্মহত্যার আবেদন জানালেন বারাসতের আর এক বাসিন্দা ইন্দ্রাণী ভৌমিক । ইন্দ্রাণীর পোষ্য একদল কুকুরের দিনে-রাতে ডাকাডাকি ও প্রতিবেশীর বাড়ির সামনের রাস্তায় মলত্যাগ করা নিয়ে বেজায় চটেছেন ইন্দ্রাণীর প্রতিবেশীরা । অতিষ্ঠ হয়ে তারা ইন্দ্রাণীকে কুকুরগুলিকে নিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার বা কুকুরগুলোকে সরিয়ে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন । স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছেও অভিযোগ জানিয়েছেন । দিন কয়েক আগে স্থানীয় কাউন্সিলার রত্না ভট্টাচার্য ইন্দ্রাণীকে শাসিয়ে গিয়েছেন, আগামী ৩১ জানুয়ারীর মধ্যে কুকুরগুলিকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে হবে, অন্যথা তাঁকে বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে কুকুর পুষতে হবে । সন্তান স্নেহে লালন-পালন করা পোষ্য সারমেয়দের রক্ষা করতে জেলাশাসকের কাছে বাধ্য হয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন জানিয়েছেন ইন্দ্রাণী । এখন জেলা প্রশাসন কী পদক্ষেপ নেয়, সেদিকেই তাকিয়ে আছেন বছর পঁয়তাল্লিশের অবিবাহিত ইন্দ্রাণী । জেলাশাসক চৈতালি চক্রবর্তী বলেন, "উনি স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন জানিয়েছেন । বিষয়টি পুলিশ প্রশাসনকে খতিয়ে দেখতে বলেছি।"
বারাসত পৌরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের পোদ্দার গলিতে থাকেন ইন্দ্রাণী । অংকে স্নাতক ইন্দ্রাণী একটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের শিক্ষিকা, বাড়িতে থাকেন একাই । বাবা, মা ও এক ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে । বড় ভাই দিল্লির পালামৌতে এয়ারফোর্সে চাকরি করেন । ইন্দ্রাণীর মোট ১২টি পোষ্য কুকুর রয়েছে । ছয় বছর আগে পাড়ার মধ্যেই একটি কুকুর সাতটি বাচ্চা প্রসব করেছিল । প্রসবের পরেই মারা যায় মা কুকুর । অসহায় কুকুরের বাচ্চাগুলোকে রাস্তা থেকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন ইন্দ্রাণী । মাতৃসম ভালোবাসা দিয়ে দুধের বাচ্চাগুলোকে যত্ন নিয়ে বড় করে তুলেছেন তিনি । এখন ইন্দ্রাণীর পোষ্য সারমেয়র সংখ্যা দাড়িয়েছে ১২-য় । তাদের নিয়েই ভরা সংসার ইন্দ্রাণীর । নিজের হাতেই তাদের খাওয়ানো,পরিচর্যা করেন । ইন্দ্রাণী অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের শিক্ষিকা। নিজের সামান্য আয় ও দাদার আর্থিক সাহায্যেই পোষ্যদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি ।
ইন্দ্রাণীর এই পোষ্যদের নিয়েই বেশ কিছুদিন ধরে চটেছেন প্রতিবেশীরা । তাদের অভিযোগ, দিনে-রাতে কুকুরগুলো চিৎকার করে ডাকতে থাকে । বাড়ির সামনে মলত্যাগ করে । অন্যদিকে ইন্দ্রাণীর অভিযোগ, ডাকাডাকি করলেই প্রতিবেশীরা বারান্দায় থাকা কুকুরগুলোর গায়ে জল ছিটিয়ে দেন ৷ গালিগালাজও করে প্রতিবেশীরা । প্রতিবেশী সোনালি বিশ্বাস, পাপিয়া দাস, সৌম্যজিৎ দাসের অভিযোগ, আগে ইন্দ্রাণীর সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ভালোই ছিল । কুকুরগুলোর আসার পরই তাঁদের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে । তাঁদের অভিযোগ, কুকুরগুলো দিনেরাত চিৎকারে বাচ্চাদের পড়াশোনায় সমস্যা হচ্ছে । আমরা ইন্দ্রাণীকে বলেছি, কুকুরগুলোকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে ।
সম্প্রতি ইন্দ্রাণীর প্রতিবেশীরা কুকুর নিয়ে তাঁদের সমস্যার কথা জানিয়েছিলেন স্থানীয় সিপিএম কাউন্সিলর রত্না ভট্টাচার্যকে । রত্না গত ৭ জানুয়ারি ইন্দ্রাণীর বাড়িতে যান । তিনি ইন্দ্রাণীকে আগামী ৩১ জানুয়ারী পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বলেন, এই সময়ের মধ্যে হয় কুকুরদের অন্যত্র সরিয়ে দিতে হবে, নয়তো বাড়ি ছেড়ে কোনও গ্রামে গিয়ে থাকতে হবে । কাউন্সিলর রত্না ভট্টাচার্য অবশ্য সেকথা স্বীকারও করেছেন । তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশীরাই আমার কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন । তাই আমি ইন্দ্রাণীকে এই কথাগুলো বলে এসেছি ।"
ইন্দ্রাণী বলেন, ‘কুকুরগুলোর একমাত্র ভরসা আমি । ওদের ছেড়ে দেওয়া মানে মৃত্যুর মুখে ফেলে দেওয়া । আমি সন্তান স্নেহে ওদের বড় করেছি । ওদের ছেড়ে আমি থাকতে পারব না । তাই আমি জেলাশাসকের কাছে আত্মহত্যার আবেদন করেছি’।
বারাসত পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান অশনি মুখার্জি বলেন, "এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা । সভ্য সমাজে গোটা দেশজুড়েই পশুপ্রেমীরা আছেন । প্রতিবেশীদের আরও সহনশীল হওয়া দরকার ।" বারাসতের পশুপ্রেমী অর্পিতা চৌধুরী বলেন, "এটি অত্যন্ত অমানবিক ঘটনা । কুকুরকে সেবা করা যদি সংবিধান বিরোধী হয়, তাহলে ইন্দ্রাণীদের মতো পশুপ্রেমীদের জেলে ভরে দেওয়া হোক । প্রতিবেশী ও কাউন্সিলরের শাসানির পর ইন্দ্রাণীর মানসিক অবস্থা যা হয়েছে, তাতে তিনি যেকোনও অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারেন । প্রশাসন এখনই কোনও ব্যবস্থা না নিলে আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে আন্দোলনে নামবো ৷"