সুন্দরবন, 26 জানুয়ারি : সুন্দরবনের বাদাবনে কেটেছে ছেলেবেলা । ছিল না খাবার । ছিল না চিকিৎসাও । ছেলেবেলায় প্রতি মুহুর্তে চোখের সামনে দেখেছেন সমাজের প্রান্তিক মানুষরা কী নিদারুণ অসহায়তা ৷ সেই থেকেই বদ্ধপরিকর হন ৷ কিছু একটা করতেই হবে এইসব প্রান্তিক মানুষদের জন্য ৷ পড়াশোনা শেষ করে হলেন চিকিৎসক । কিন্তু মাথায় যে তখনও সেই পিছিয়ে পড়া মানুষদের চিন্তা ৷ চাকরির মোহ ছেড়ে ফিরলেন সেই সুন্দরবনেই । নেমে পড়লেন গরিব মানুষের সেবায় । চলল বছরের পর বছর । অবশেষে মিলল স্বীকৃতি । চলতি বছরে সমাজসেবায় পদ্মশ্রী খেতাব পেলেন চিকিৎসক অরুণোদয় মণ্ডল ।
1953 সালের অবিভক্ত 24 পরগনার হিঙ্গলগঞ্জের দালালখালি গ্রামে জন্ম অরুণোদয়ের । পড়াশোনা গ্রামের স্কুলেই । টাকি গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ ৷ এরপর কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে MBBS । কিন্তু চাকরির মোহ তাঁর ছিল না । তিনি বাঁধা পড়তে চাননি নিয়মের বেড়াজালে । স্বাধীনভাবে প্রাকটিস করেছেন । কর্মজীবনের শুরু থেকে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন । চাক্ষুষ করেছেন প্রান্তিক মানুষের অসহায়তা । 2000 সালের বন্যায় সুন্দরবন ঘুরে ঘুরে তিনি গ্রামের মানুষের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন । উপলব্ধি করেছেন, স্থায়ী কোনও প্রতিষ্ঠান না-গড়ে গ্রামের মানুষের সেবা করা সম্ভব নয় । সুন্দরবনের সাহেবখালি-রায়পাড়াতেই গড়ে তুললেন 'সুজন চিকিৎসা কেন্দ্র'। গত 20 বছর ধরে সেখানে চিকিৎসা করে চলেছেন । ফি নামমাত্র ৷
বর্তমানে তিনি থাকেন লেকটাউনে । বিরাটি স্টেশন থেকে প্রতি শনিবার সকালে তিনি কাঁধে ঔষুধের ব্যাগ নিয়ে হাসনাবাদ লোকালে চড়েন । হাসনাবাদে নেমে নদীপথ পেরিয়ে তিনি সেই সাহেবখালি রায়পাড়ার 'সুজন'-এ পৌছান । শনি ও রবিবার সেখানে চিকিৎসা করেন । মহল্লায় তিনি 'সুন্দরবন সুজন' নামে পরিচিত ।
প্রজাতন্ত্র দিবসের আগের সন্ধ্যায় পদ্মশ্রীর তালিকায় তাঁর নাম ঘোষিত হয়েছে । পদ্ম-স্বীকৃতি পেয়ে কেমন লাগছে? প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানিয়েছেন, "পুরস্কার পেতে কার না ভালো লাগে । আমারও নিশ্চয়ই ভালো লাগছে । রাষ্ট্রীয় খেতাব পেয়ে আমি গর্বিত । আমি তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছি আমার সুন্দরবনের মানুষের কাছে আমি আপন হতে পেরেছি । তাঁদের জন্য কিছু করতে পেরেছি। শেষদিন পর্যন্ত যেন আমার গাঁয়ের মানুষগুলোর পাশে থাকতে পারি।"
অরুণোদয়বাবুর এই কর্মযজ্ঞের প্রেরণা কে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, " অবশ্যই আমার প্রিয় সুন্দরবনের মানুষ । সঙ্গে স্ত্রী অপর্ণার অবদানও অপরিসীম ।"
অপর্ণাদেবী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা । ছেলে অর্ণব বর্তমানে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসা করছেন । পুরস্কার তাঁকে উৎসাহিত করেছে । প্রবীণ চিকিৎসকের চোখে আজও একটাই স্বপ্ন, গোটা সুন্দরবনে গড়বেন আরোগ্য নিকেতন ।