পুরুলিয়া, 18 জুন : অযোধ্যা পাহাড়ের দেশ, শিল্প ও শিল্পীর আঁতুড়ঘর পুরুলিয়া ৷ বাংলার লোকশিল্পের একটা বড় অংশই এই জেলার অহঙ্কার ৷ ছৌ, ঝুমুর, নাটুয়া, বাউল, সাঁওতালি নাচ ও গানের ভূমি মানভূম । যে মাটিতে সারা বছর ধরে লোকশিল্পের অনুষ্ঠান লেগেই থাকে । কিন্তু, কোরোনা বদলে দিয়েছে দুনিয়া ! ফলে গত কয়েক মাস বন্ধ সরকারি ও বেসরকারি অনুষ্ঠান । রোজগারও বন্ধ । ভরসা ছিল সরকারি শিল্পী ভাতা ৷ কিন্তু, তাও গত এক মাস হল মেলেনি বলে অভিযোগ । সব মিলিয়ে লকডাউনে চরম সংকটে পুরুলিয়ার লোকশিল্পীরা ।
জঙ্গলমহল-পুরুলিয়ায় সরকারি ভাতা পান এমন শিল্পীর সংখ্যা 21 হাজার 726 । এর বাইরেও রয়েছে অসংখ্য শিল্পী ৷ এর থেকে পুরুলিয়ার লোকশিল্পীর সংখ্যা তথা লোকশিল্প চর্চা সম্পর্কে একটা আন্দাজ হয় ৷ আগেই বলা হয়েছে, কোরোনা সেসব ওলট-পালট করে দিয়েছে । সরকারি আসরের মতোই গাঁ-গঞ্জের নাচ-গানের আসরও বন্ধ । শিল্পীদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা । বিষণ্ণ-কালো মেঘ জমছে সমৃদ্ধ লোকশিল্পের দেশ পুরুলিয়ার আকাশে ৷ বাড়ছে অনটনে পড়া অসহায় শিল্পীর সংখ্যা ৷ তবু, জাত শিল্পীর স্বভাব---অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বাড়ি বসে চলছে রেওয়াজ ৷ কিন্তু, বাস্তব কঠিন বস্তু ৷ ফলে, গান-নাচ-নাটক থেকে সরলেই ঘিরে ধরছে তীব্র অভাবের ময়াল, আগামী দিনের ভাবনায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন মানুষগুলো । অনেকেই জানালেন, তাঁরা সরকারি ভাতা পান না ৷ অনেক আবার বলছেন, ভাতার আবেদন করেও প্রশাসনের তরফে মেলেনি সারা । বাধ্য হয়ে কেউ কেউ আপাতত শিল্পসত্ত্বা গুটিয়ে রেখে রাজমিস্ত্রির কাজে নেমেছেন । মানভূম লোকসংস্কৃতি ও নারী উন্নয়ন সমিতির সম্পাদক পোস্তবালা দেবী কর্মকার, বলরামপুর ব্লকের নাটুয়া শিল্পী কম্পাউন্ডার কালিন্দী, ঝুমুর শিল্পী বিজয় কর্মকার, পুঞ্চা ব্লকের বাউল শিল্পী দিলীপ কুমার সহিসদের লোকশিল্প আলাদা হতে পারে, কিন্তু তাঁদের দুঃখের রং এক । একইরকম অসহায়তার কথাই জানান তাঁরা৷
কোরোনায় কাজ নেই ৷ সব অনুষ্ঠান বন্ধ । নতুন করে কোনও বুকিং নেই । ভরসা বলতে রেশনের চাল আর 1 হাজার টাকা সরকারি ভাতা । যাতে বাঁচতে গিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় হাল । শিল্পীরা আরও জানান, প্রথমদিকে খাদ্যসামগ্রীর সাহায্য মিলেছিল । এখন সেসব বন্ধ । কার্যত খেয়ে-না খেয়ে অস্তিত্বের লড়াই চালাচ্ছেন তাঁরা ।
বাউল দিলীপকুমার সহিস বলেন, "অনুষ্ঠান নেই ৷ কোনওমতে টিকে আছি ৷" অন্য কিছু করতেও মন সায় দেয় না ৷ বলেন, "শিল্পটাকেও তো ধরে রাখতে হবে ৷"
জেলার খ্যাতনামা ঝুমুর গানের দলের হারমোনিয়ামবাদক বীজয় কর্মকার বলেন, "কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি ৷ কোনও কাজ নেই ৷ বসে আছি ৷ সরকারি ভাতাটি যদি বাড়ানো হয় তা হল উপকার হয় ৷"
বাউল শিল্পী কৃপাসিন্ধু কর্মকারের কথায়, "প্রায় এক বছর আগে শিল্পী ভাতার জন্য আবেদন জানিয়েছিলাম । এখনও ভাতা মেলেনি । কোরোনায় গ্রামে-গঞ্জের বাউলের আসর বসাও বন্ধ । রোজগারের তাগিদে বাউল গান ছেড়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করছি। সরকারি ভাতা পেলে সাহায্য হত ।"
যদিও পুরুলিয়া জেলার শিল্পীদের কেন্দ্রীয় স্তরে ভাতা দেওয়া হচ্ছে ৷ কোনও মাসের ভাতা বকেয়া নেই ৷ জানিয়ে দিলেন পুরুলিয়া জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের আধিকারিক উৎপল পাল । তবে, 2017 সালের পর থেকে নতুন করে শিল্পী ভাতার আবেদন যে নেওয়া হচ্ছে না, তাও জানিয়ে দিলেন ।
উৎপল পাল বলেন, "শিল্পীরা আমাদের সম্পদ । তাঁদের বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। সে কথা ভেবেই দপ্তরের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় স্তরে সকলকে ভাতা দেওয়া হচ্ছে । জয়বাংলা স্কিমের মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে শিল্পীদের ।"
তাঁর কথায়, "বকেয়া ভাতা মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে । কোনও মাসের ভাতা বাকি নেই । বহাল খাতা যাঁদের রয়েছে তাঁরা ভাতা পাচ্ছেন ।" তবে, "নতুন করে শিল্পী ভাতার আবেদন 2017 সালে বন্ধ হয়েছে । রাজ্য সরকার ও পুরুলিয়া জেলা প্রশাসন শিল্পীদের পাশে রয়েছে ।"
প্রশাসনের আশ্বাস আছে । তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে পুরুলিয়ার কয়েক হাজার লোকশিল্পী ৷