পুরুলিয়া, 22 জুলাই : কোনও দিন স্কুলে যাননি ৷ অ আ ক খ তাঁদের কাছে অজানা ৷ লোকের জমিতে চাষ বা দিন মজুরের কাজ করে কোনওরকমে সংসার চলে ৷ তবে তাঁদের স্বপ্ন, ছেলেমেয়েগুলো পড়াশোনা করুক ৷ এই অভাব পিছু ছাড়ুক তাঁদের ৷ কিন্তু, কোরোনা যেন সেই স্বপ্নের পথেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷
লকডাউনের জেরে চারমাস ধরে বন্ধ স্কুল ৷ নিয়মিত পড়াশোনার জন্য অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে সরকার থেকে ৷ তবে, সেই সুবিধা পাচ্ছে না পুরুলিয়া জেলার অনেক পড়ুয়া ৷ কারণ, তাদের অনেকের বাবা-মায়ের কাছেই নেই স্মার্টফোন ৷
আর্থিক সঙ্গতিহীন ও প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো জেলায় না থাকায় ছেলেমেয়েদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে পুরুলিয়ার অনেক পড়ুয়াকে ৷ বেশি সমস্যায় পড়ছে শবর সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা ৷ বাড়িতে মোবাইল নেই ৷ তাই অনলাইন ক্লাসও তারা করতে পারছে না ৷ আবার, টিউশন খরচ বহনের সামর্থও নেই ৷ সব মিলিয়ে একেবারে বন্ধ শবর পরিবারের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ৷ পুঞ্চা ব্লকের দামোদরপুর শবরপাড়ার বাসিন্দা জানকী শবর বলেন, "কোরোনা পরিস্থিতিতে দীর্ঘ চার মাসেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যালয়গুলি বন্ধ রয়েছে । এর ফলে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাও লাটে উঠেছে । কাজ বন্ধ ৷ কীভাবে সংসার চালাব সেই চিন্তায় রয়েছি ৷ তার উপর টিউশন দেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থাও নেই । বাড়িতে বড় মোবাইল ফোনও নেই, মোবাইলের ব্যবহারও ঠিকমতো কেউ জানি না । আর আমরা নিজেরাও নিরক্ষর, তাই বাড়িতেও পড়াতে পারি না । আর এতদিন ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় ছেলেমেয়েরা বাড়িতে পড়াশোনা করে না । ভেবেছিলাম আমরা পড়াশোনা জানি না তাই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাব । কিন্তু, এরকম চলতে থাকলে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সমস্যায় হবে । বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকারা অন্তত সপ্তাহে যতটুকু সময় হবে গ্রামে এসে অফলাইন ক্লাস করলে কিছুটাও উপকৃত হত ছেলেমেয়েরা ।"
পুরুলিয়া 2 নম্বর ব্লক এলাকার অভিভাবকরাও জানান অসুবিধার কথা । ডুবকিডি গ্রামের বাসিন্দা চন্দনা মাহাত, শীতলপুর গ্রামের সুলতান আনসারিরা বলেন, "ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়া একটা অভ্যাস । সেখানে শুধু পড়াশোনাই নয়, আচার ব্যবহারও শিখে থাকে । ছেলেমেয়েদের মনটাও ভালো থাকে । কিন্তু, এই পরিস্থিতিতে তো দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ রয়েছে । তাই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে । আমরা নিজেরাও নিরক্ষর, তাই আমরাও পড়াতে পারি না । আর এখন আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় দিন চালানোই মুশকিল, তার ছেলেমেয়েদের টিউশন খরচ কীভাবে সামলাব । শুনেছিলাম মোবাইলেও পড়াশোনা হচ্ছে । কিন্তু বাড়িতে তো ভালো মোবাইলই নেই । তাই পড়বে কীভাবে । ঘুরে ঘুরে, খেলাধূলা করেই দিন কাটাচ্ছে ছেলেমেয়েরা । যেটুকু পড়াশোনা হয়েছিল সেটাও বোধ হয় ভুলে গিয়েছে ৷ আর পড়াশোনার অভ্যাসটাও নষ্ট হচ্ছে ।"
অনলাইন ক্লাসের সুবিধা না পাওয়ায় বিকল্প রাস্তা বেছেছে কিছু স্কুলের শিক্ষক ৷ তাঁরা কিছু মডেল প্রশ্ন তৈরি করে পৌঁছে দিচ্ছেন পড়ুয়াদের কাছে ৷ শিক্ষক গতিকৃষ্ণ মাহাত বলেন, "আমরা যতটুকু পারছি, সাহায্য করছি ৷ স্কুল থেকে একটা মডেল প্রশ্ন দেওয়া হচ্ছে ৷ যাতে বাচ্চারা সঠিকভাবে পড়াশোনা করতে পারে ৷ কী পড়াশোনা করছে, সেটার মূল্যায়ন হিসেবেই একটা মডেল প্রশ্ন দেওয়া হচ্ছে ৷"
শবর সম্প্রদায়ের ছাত্র-ছাত্রী থেকে জেলার বিভিন্ন প্রান্তের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খুদে পড়ুয়ারাও স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনা করতে না পারার কথা জানিয়েছে । কেউ বলছে স্কুল বন্ধ, তাই পড়াশোনাও বন্ধ ৷ কারও কথায়, পড়তে বসলেও পড়া হচ্ছে না ৷ ভুল-ঠিক দেখিয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই ।
এই বিষয়ে জেলাশাসক রাহুল মজুমদার বলেন, "কোরোনা পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের । যদিও অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা হলেও অনেকেই মোবাইলের ব্যবহার না জানায় অসুবিধায় পড়েছে । তবে এই বিষয়ে পুরুলিয়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চিন্তা-ভাবনা রয়েছে । আলোচনা করে সেই মতো বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ।"