ETV Bharat / state

গঙ্গার ভাঙনে সব হারিয়ে সরকারি সাহায্যের আশায় কালিয়াচকের বাসিন্দারা - গঙ্গা ভাঙন মালদায়

আশির দশক থেকেই মালদায় গঙ্গার ভাঙন শুরু হয় । ভাঙনে জেলার মানচিত্র থেকে মুছে যায় কেবি ঝাউবোনা নামের একটি আস্ত গ্রাম পঞ্চায়েত । এবারের গঙ্গার রোষ দেখছে কালিয়াচকের বীরনগর 1 নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত ও পারদেওনাপুর শোভাপুর গ্রাম পঞ্চায়েত ৷

villagers looking-for-government help on ganges eruption
villagers looking-for-government help on ganges eruption
author img

By

Published : Oct 6, 2020, 9:50 PM IST

মালদা, 6 অক্টোবর: "গাংকাট্টি তিনবার ঘর কাড়লা । আব কুনঠে যাব? ভুখ মিটবে ক্যামনে? নিদই বা পাড়ব কোথা ?" গঙ্গাপাড়ে নদীর দিকে তাকিয়ে ভাঙাচোরা ঘরের পাশে বসে এমনটাই আউড়ে যাচ্ছিলেন নাসিমা বিবি । চলতি মরশুমে গঙ্গার কোপে ভিটেহারা হয়েছেন তিনি । এখনও চারদিক থেকে ভেসে আসছে ভারী হাতুড়ির আওয়াজ । নদীর পর এবার নিজেই নিজেই ঘর ভাঙছে মানুষ ! তিল তিল করে গড়ে তোলা মাথা গোঁজার ঠাঁই নিজের হাতে ভেঙে ফেলার যে কতটা যন্ত্রণা তা টের পাচ্ছেন বাসিন্দারা । কীভাবে তাঁরা ফের মাথা তুলে দাঁড়াবেন জানেন না । কোরোনা, লকডাউন আর ভাঙনের ত্র্যহস্পর্শে বিপন্ন তাঁরা । সবাই তাকিয়ে সরকারি সাহায্যের দিকে ।

আশির দশক থেকেই মালদা জেলায় গঙ্গার ভাঙন শুরু হয় । সেই সময় কালিয়াচক 2 ব্লকে একে একে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অসংখ্য গ্রাম । জেলার মানচিত্র থেকে মুছে যায় কেবি ঝাউবোনা নামের একটি আস্ত গ্রাম পঞ্চায়েত । এক রাতে কত মানুষকে যে পথে বসতে হয়েছে তার হিসেব নেই । যে সব বাড়িতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের খাদ্যের সংস্থান হত, সেই বাড়ির বাসিন্দারা থালা হাতে ভিক্ষে চাইতে বাধ্য হয়েছেন । এবার গঙ্গার রোষ দেখছেন কালিয়াচকের বীরনগর 1 নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের চিনাবাজার, দুর্গারামটোলা, বালুগ্রাম, পারদেওনাপুর শোভাপুর গ্রামপঞ্চায়েতের পার অনুপনগর, পারলালপুর গ্রামের বাসিন্দারা । গ্রামগুলির প্রায় 95 শতাংশ বাসিন্দাই দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে । সিংহভাগ পেশায় পরিযায়ী শ্রমিক । এলাকার কয়েকজন কৃষক ও শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন । তাঁদের কাছে গঙ্গা কোনও পুণ্যতোয়া নদী নয় সাক্ষাৎ ডাইনি ।

গঙ্গা ভাঙনে দিশাহারা কালিয়াচকের বাসিন্দারা ৷

কয়েক বছর আগেই নদীর ভাঙনে ছিন্নমূল হয়ে চিনাবাজার গ্রামে বাড়ি বানিয়েছিলেন আমিরুল শেখ । পেশায় মৎস্যজীবী । আমিরুল শেখ বলেন, "দেশে যখন কোরোনা হানা দিল তখনই লকডাউন ঘোষণা হল । খুব অসুবিধায় দিন কেটেছে । আমরা গঙ্গায় মাছ ধরে খাই । লকডাউনে নদীতে যেতে পারিনি । মাঝেমধ্যে গেলেও ধরে আনা মাছ বিক্রি করতে পারিনি । এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় ভাঙন । নদী আমার বাড়ি কেটে দিয়েছে । সবই চলে গেল । যেটুকু এখনও বেঁচে আছে তা রক্ষা করার চেষ্টা করছি । ঘরের বাকি অংশ ভেঙে ফেলছি । অন্তত ইটগুলো তো পাব ! চিনাবাজারের সকলেই গরিব । কেউ মাছ ধরে, কেউ বিদেশে খাটতে যায়, কেউ চাষ করে । লকডাউনের জন্য কেউ বাইরে যেতে পারেনি । আমাদের সবার অবস্থা খারাপ । গঙ্গা যদি এভাবে পাড় কাটে তাহলে মানুষ বাঁচবে কীভাবে ? এখন সরকার কিছু সাহায্য করলে তবে বাঁচতে পারব । "

কোরোনার আগে উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন লাল্টু শেখ । লকডাউনের মধ্যে অনেক কষ্টে বাড়ি ফিরেছিলেন । তাঁর কথায়, "কোরোনার জন্য এবার বাইরে ভালো কাজ হয়নি । এলাহাবাদ গিয়ে বসে থাকতে হয়েছিল । দু'মাস সেখানে ফ্যান-ভাত খেয়ে থেকেছি । কোনওরকমে বাড়ি ফিরেছিলাম । কিন্তু শান্তি পেলাম না । বাড়ি গিলে নিল গঙ্গা । এখন কোথায় যাব, থাকব কোথায়, কী খাব, কী কাজ করব, জানি না । হাতে কোনও টাকাপয়সা নেই । কাছেই একটা বাগানে প্লাস্টিক টাঙিয়ে থাকছি । রাজনৈতিক দল থেকে একবেলা খাবার দিচ্ছে । আর এক বেলা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে । ভবিষ্যতে আমরা কীভাবে বেঁচে থাকব জানি না ।"

বালুগ্রামের পরিযায়ী শ্রমিক আনারুল শেখ বলেন, "লকডাউনের আগে চেন্নাই কাজ করতে গিয়েছিলাম । এক মাস দশ দিন কাজ করতে পেরেছিলাম । সেখান থেকে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরি । বাড়ি ফেরার পর কোনওরকমে সংসার চলছিল । পরিবারে মা, ভাই, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, সবাই রয়েছে । এই অবস্থায় গঙ্গা বাড়ি গিলে নিয়েছে । এখন সরকারই শেষ ভরসা । সরকার কিছু করলে বাঁচব, নয়তো বাঁচার কোনও রাস্তা নেই ।"

একই বক্তব্য ইলিয়াস শেখের । তিনি বলেন, "গত 30 অগাস্ট গঙ্গার প্রথম ভাঙনেই বাড়ি নদীতে চলে গিয়েছে । লকডাউনের শুরু থেকে কাজ নেই । বাড়ির বাইরে বেরোনো যাচ্ছিল না । হাতে টাকাপয়সা থাকলে তো চিন্তাই থাকত না । নতুন ঘর দেওয়ার ক্ষমতা নেই । এখনও ত্রিপল টাঙিয়ে আছি । এদিকে ঘরে তিনটি মেয়ে, তিন ছেলে । সরকারি পুনর্বাসন এখনও পাইনি !"

তাঁদের মতোই গঙ্গায় ভিটেমাটি হারানো কয়েক হাজার মানুষ এখন হন্যে হয়ে খুঁজছে ভবিষ্যতের আস্তানা । প্রত্যেকের এক কথা, আপাতত মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু পেলে তবেই ভবিষ্যতে সংসারের চাকা গড়ানোর চিন্তা করতে পারব । ফের পরিবারকে রেখে কর্মক্ষেত্রে ফিরতে পারব । কিন্তু এতগুলো অসহায় মানুষকে প্রশাসন কি পুনর্বাসন দেবে ? এখনও পর্যন্ত মাত্র 64 জন উদ্বাস্তুর সেই সৌভাগ্য হয়েছে ৷ বাকিরা ঘুরছেন প্রশাসনের দরজায় দরজায় । এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি জেলাশাসকের । তবে কালিয়াচক 3 নম্বরের BDO গৌতম দত্ত জানিয়েছেন, "গঙ্গা ভাঙনে গৃহহীনদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারি জমি খোঁজা হচ্ছে । জমি পাওয়া গেলেই প্রত্যেককেই জমির পাট্টা দেওয়া হবে । এখন প্রশাসনের তরফে দুর্গতদের ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে ।"

মালদা, 6 অক্টোবর: "গাংকাট্টি তিনবার ঘর কাড়লা । আব কুনঠে যাব? ভুখ মিটবে ক্যামনে? নিদই বা পাড়ব কোথা ?" গঙ্গাপাড়ে নদীর দিকে তাকিয়ে ভাঙাচোরা ঘরের পাশে বসে এমনটাই আউড়ে যাচ্ছিলেন নাসিমা বিবি । চলতি মরশুমে গঙ্গার কোপে ভিটেহারা হয়েছেন তিনি । এখনও চারদিক থেকে ভেসে আসছে ভারী হাতুড়ির আওয়াজ । নদীর পর এবার নিজেই নিজেই ঘর ভাঙছে মানুষ ! তিল তিল করে গড়ে তোলা মাথা গোঁজার ঠাঁই নিজের হাতে ভেঙে ফেলার যে কতটা যন্ত্রণা তা টের পাচ্ছেন বাসিন্দারা । কীভাবে তাঁরা ফের মাথা তুলে দাঁড়াবেন জানেন না । কোরোনা, লকডাউন আর ভাঙনের ত্র্যহস্পর্শে বিপন্ন তাঁরা । সবাই তাকিয়ে সরকারি সাহায্যের দিকে ।

আশির দশক থেকেই মালদা জেলায় গঙ্গার ভাঙন শুরু হয় । সেই সময় কালিয়াচক 2 ব্লকে একে একে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অসংখ্য গ্রাম । জেলার মানচিত্র থেকে মুছে যায় কেবি ঝাউবোনা নামের একটি আস্ত গ্রাম পঞ্চায়েত । এক রাতে কত মানুষকে যে পথে বসতে হয়েছে তার হিসেব নেই । যে সব বাড়িতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের খাদ্যের সংস্থান হত, সেই বাড়ির বাসিন্দারা থালা হাতে ভিক্ষে চাইতে বাধ্য হয়েছেন । এবার গঙ্গার রোষ দেখছেন কালিয়াচকের বীরনগর 1 নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের চিনাবাজার, দুর্গারামটোলা, বালুগ্রাম, পারদেওনাপুর শোভাপুর গ্রামপঞ্চায়েতের পার অনুপনগর, পারলালপুর গ্রামের বাসিন্দারা । গ্রামগুলির প্রায় 95 শতাংশ বাসিন্দাই দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে । সিংহভাগ পেশায় পরিযায়ী শ্রমিক । এলাকার কয়েকজন কৃষক ও শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন । তাঁদের কাছে গঙ্গা কোনও পুণ্যতোয়া নদী নয় সাক্ষাৎ ডাইনি ।

গঙ্গা ভাঙনে দিশাহারা কালিয়াচকের বাসিন্দারা ৷

কয়েক বছর আগেই নদীর ভাঙনে ছিন্নমূল হয়ে চিনাবাজার গ্রামে বাড়ি বানিয়েছিলেন আমিরুল শেখ । পেশায় মৎস্যজীবী । আমিরুল শেখ বলেন, "দেশে যখন কোরোনা হানা দিল তখনই লকডাউন ঘোষণা হল । খুব অসুবিধায় দিন কেটেছে । আমরা গঙ্গায় মাছ ধরে খাই । লকডাউনে নদীতে যেতে পারিনি । মাঝেমধ্যে গেলেও ধরে আনা মাছ বিক্রি করতে পারিনি । এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় ভাঙন । নদী আমার বাড়ি কেটে দিয়েছে । সবই চলে গেল । যেটুকু এখনও বেঁচে আছে তা রক্ষা করার চেষ্টা করছি । ঘরের বাকি অংশ ভেঙে ফেলছি । অন্তত ইটগুলো তো পাব ! চিনাবাজারের সকলেই গরিব । কেউ মাছ ধরে, কেউ বিদেশে খাটতে যায়, কেউ চাষ করে । লকডাউনের জন্য কেউ বাইরে যেতে পারেনি । আমাদের সবার অবস্থা খারাপ । গঙ্গা যদি এভাবে পাড় কাটে তাহলে মানুষ বাঁচবে কীভাবে ? এখন সরকার কিছু সাহায্য করলে তবে বাঁচতে পারব । "

কোরোনার আগে উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন লাল্টু শেখ । লকডাউনের মধ্যে অনেক কষ্টে বাড়ি ফিরেছিলেন । তাঁর কথায়, "কোরোনার জন্য এবার বাইরে ভালো কাজ হয়নি । এলাহাবাদ গিয়ে বসে থাকতে হয়েছিল । দু'মাস সেখানে ফ্যান-ভাত খেয়ে থেকেছি । কোনওরকমে বাড়ি ফিরেছিলাম । কিন্তু শান্তি পেলাম না । বাড়ি গিলে নিল গঙ্গা । এখন কোথায় যাব, থাকব কোথায়, কী খাব, কী কাজ করব, জানি না । হাতে কোনও টাকাপয়সা নেই । কাছেই একটা বাগানে প্লাস্টিক টাঙিয়ে থাকছি । রাজনৈতিক দল থেকে একবেলা খাবার দিচ্ছে । আর এক বেলা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে । ভবিষ্যতে আমরা কীভাবে বেঁচে থাকব জানি না ।"

বালুগ্রামের পরিযায়ী শ্রমিক আনারুল শেখ বলেন, "লকডাউনের আগে চেন্নাই কাজ করতে গিয়েছিলাম । এক মাস দশ দিন কাজ করতে পেরেছিলাম । সেখান থেকে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরি । বাড়ি ফেরার পর কোনওরকমে সংসার চলছিল । পরিবারে মা, ভাই, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, সবাই রয়েছে । এই অবস্থায় গঙ্গা বাড়ি গিলে নিয়েছে । এখন সরকারই শেষ ভরসা । সরকার কিছু করলে বাঁচব, নয়তো বাঁচার কোনও রাস্তা নেই ।"

একই বক্তব্য ইলিয়াস শেখের । তিনি বলেন, "গত 30 অগাস্ট গঙ্গার প্রথম ভাঙনেই বাড়ি নদীতে চলে গিয়েছে । লকডাউনের শুরু থেকে কাজ নেই । বাড়ির বাইরে বেরোনো যাচ্ছিল না । হাতে টাকাপয়সা থাকলে তো চিন্তাই থাকত না । নতুন ঘর দেওয়ার ক্ষমতা নেই । এখনও ত্রিপল টাঙিয়ে আছি । এদিকে ঘরে তিনটি মেয়ে, তিন ছেলে । সরকারি পুনর্বাসন এখনও পাইনি !"

তাঁদের মতোই গঙ্গায় ভিটেমাটি হারানো কয়েক হাজার মানুষ এখন হন্যে হয়ে খুঁজছে ভবিষ্যতের আস্তানা । প্রত্যেকের এক কথা, আপাতত মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু পেলে তবেই ভবিষ্যতে সংসারের চাকা গড়ানোর চিন্তা করতে পারব । ফের পরিবারকে রেখে কর্মক্ষেত্রে ফিরতে পারব । কিন্তু এতগুলো অসহায় মানুষকে প্রশাসন কি পুনর্বাসন দেবে ? এখনও পর্যন্ত মাত্র 64 জন উদ্বাস্তুর সেই সৌভাগ্য হয়েছে ৷ বাকিরা ঘুরছেন প্রশাসনের দরজায় দরজায় । এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি জেলাশাসকের । তবে কালিয়াচক 3 নম্বরের BDO গৌতম দত্ত জানিয়েছেন, "গঙ্গা ভাঙনে গৃহহীনদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারি জমি খোঁজা হচ্ছে । জমি পাওয়া গেলেই প্রত্যেককেই জমির পাট্টা দেওয়া হবে । এখন প্রশাসনের তরফে দুর্গতদের ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে ।"

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.