মালদা, 8 মে : কোরোনা রুখতে যে লকডাউন চলছে, তাতে কোমর ভেঙেছে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির ৷ ঘরবন্দী হয়ে জীবন বাঁচানোর রসদ হয়তো মিলছে, কিন্তু পেট চালানোর রসদ নিঃশেষ হয়ে গেছে এই পরিবারগুলির ৷ পরিবারের জন্য অন্ন সংস্থান করতে ঘুম উড়েছে অটো ও টোটোচালকদের ৷ গোটা জেলায় অটোর সংখ্যা প্রায় 1400 ৷ টোটো চলে প্রায় 13 হাজার ৷ এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ তাঁদের সবার রোজগার ৷ পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেকে আবার পেশাটাকেই বদলে ফেলেছেন ৷ টোটোচালক থেকে হয়েছেন সবজি-বিক্রেতা ৷ কতদিন এই পরিস্থিতি থাকবে, কেউ জানে না ৷ লকডাউনে অটো ও টোটোচালকদের যে নাভিশ্বাস উঠেছে তা মেনে নিচ্ছে পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলিও ৷
কোরোনা যে গোটা পৃথিবীর অর্থ ব্যবস্থায় ভয়ঙ্কর ও সুদূরপ্রসারী আঘাত হানতে চলেছে, তা নিয়ে নিশ্চিত অর্থনীতিবিদরা ৷ কোরোনা তিলে তিলে খাদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে গোটা পৃথিবীর অর্থনীতিকে ৷ আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে এর প্রভাব হতে চলেছে আরও মারাত্মক ৷ এখন থেকেই তার ছায়া যেন দেখতে পাচ্ছে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলি ৷ সরকার কিংবা বিভিন্ন সংগঠন হয়তো এই মুহূর্তে তাদের কাছে কিছু ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে ৷ কিন্তু সেটা কতদিন? তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে এই মানুষগুলির মনে ৷ সেই তালিকায় রয়েছে অটো ও টোটোওয়ালারাও ৷ গত 25 মার্চ থেকে লকডাউনে বন্ধ যাত্রী পরিবহণ ব্যবস্থা ৷ সরকারি নির্দেশিকা উপেক্ষা করে কেউ কেউ অটো কিংবা টোটো রাস্তায় নামানোর চেষ্টা করেছিল বটে, তবে পুলিশের রক্তচক্ষু আর লাঠি তাদের ফের ঘরে সিঁধিয়ে দিয়েছে ৷ রোজগারের অভাবে এখন অনেকের ঘরেই দু’বেলা হাঁড়ি চড়ছে না ৷ অনেকে আবার পরিস্থিতি মোকাবিলায় পেশাটাকেই পালটে ফেলেছেন৷
মালদা শহরের অলিগলিতে নিজের টোটোয় সবজির ডালা নিয়ে ঘুরছিলেন শহরের হায়দারপুর ঘোষপাড়ার বাসিন্দা বকুল দাস ৷ তিনি বলেন, “সবজি বিক্রি করা আমার পেশা নয় ৷ আমি টোটো চালাতাম ৷ কিন্তু লকডাউন ঘোষণার পর থেকে আমরা দুই ভাই মিলে নিজেদের টোটোতে পাড়ায় পাড়ায় সবজি বিক্রি করছি ৷ সংসারটা তো চালাতে হবে ! রোজগার না থাকলে খাব কী ? তাই এই সিদ্ধান্ত ৷ সবজি বিক্রির আয়েই এখন সংসার চলছে ৷ দিনে শ’পাঁচেক টাকা রোজগার হয়ে যায় ৷ আগে টোটো চালিয়ে সারা দিনে 600-700 টাকা উপার্জন হত ৷ এখন রোজগার কিছুটা কম হলেও খাবার তো জুটছে ! পেট চালানোর জন্য আমাদের পেশাটাই বদলে ফেলতে হয়েছে ৷ আগে বেঁচে থাকা, তারপর পুরোনো পেশাকে টেনে নিয়ে যাওয়া ৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আর পুরোনো পেশায় ফিরছি না ৷”
বকুলবাবু পেশা বদলে সংসারের চাকাটাকে তবু গড়িয়ে নিয়ে যেতে পারছেন ৷ কিন্তু আরও বড় সমস্যায় পড়েছে অটোওয়ালারা ৷ টোটোতে সবজি বিক্রি করা সম্ভব ৷ কিন্তু অটোতে তা সম্ভব নয় ৷ তাই অটোওয়ালারা এখন উপরওয়ালার কাছে আর্জি জানানো ছাড়া আর কিছু করতে পারছে না ৷ এমনই এক অটোওয়ালা, মঙ্গলবাড়ি খয়রাতিপাড়ার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম । বলেন, “পরিস্থিতি খুব শোচনীয় ৷ আমাদের অবস্থা একেবারেই ভালো নয় ৷ এতদিন ধরে লকডাউন চলছে ৷ গাড়ি বন্ধ ৷ এর উপর ভিত্তি করেই আমাদের সংসার চলে ৷ এই অবস্থায় সরকারও আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখে না ৷ ঘরে চাল-ডালও নেই ৷ প্রশাসন আমাদের জন্য কোনও ব্যবস্থা নেয়নি ৷ লকডাউনে অটো রাস্তায় বের করলে পুলিশের লাঠি খেতে হয় ৷ দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না ৷ এতদিন ধরে গাড়ি বসে রয়েছে ৷ অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে ৷ লকডাউন উঠে গেলে আগে গ্যারেজে গাড়ির কাজ করাতে হবে ৷ ফের টাকার ধাক্কা ৷ কোথায় থেকে সেসব আসবে জানি না ৷ আমাদের মতো পরিবারে অর্থনীতির কোমরটাই ভেঙে দিয়েছে কোরোনা ৷ এমন অবস্থা আর 10 দিন চললে কোরোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগেই আমরা না খেয়ে মরে যাব ৷ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আমাদের দিনে 500 টাকা রোজগার হয়েই যায় ৷ কিন্তু এখন সব বন্ধ ৷ আমাদের পরিস্থিতি কেউ জানে না ৷”
অটো ও টোটোওয়ালাদের পরিস্থিতি যে মারাত্মক আকার নিয়েছে তা মেনে নিচ্ছেন তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন, INTTUC-এর জেলা সভাপতি মানব বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তিনি বলেন, “এই লকডাউনে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পরিবহণে যুক্ত শ্রমিকরা ৷ টোটো, অটো থেকে শুরু করে বাস, সব পরিবহণ শ্রমিকরাই দিন আনে, দিন খায় ৷ এদের অন্য কোনও রোজগার নেই ৷ এরা মূলত শহরের বস্তি এলাকায় থাকে ৷ অনেকে গ্রাম থেকে শহরে অটো কিংবা টোটো চালাতে আসে ৷ এদের কারও কোনও জমি কিংবা জায়গা নেই ৷ এদের রোজগার পুরোপুরি বন্ধ ৷ এরা এখন কী খাবে বুঝে পাচ্ছে না ৷ এদের জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলবে, দিনে 500 টাকা রোজগার হয় ৷ কিন্তু তার মধ্যে যে খরচও রয়েছে, সেসব ধরলে এরা দিনে 250-300 টাকা রোজগার করে ৷ এই টাকা পরিবার চালাতেই শেষ হয়ে যায় ৷ কারও ব্যাঙ্কে কোনও সঞ্চয় নেই ৷ এরা কী করে খাবে? কোনও কোনও টোটোওয়ালা এখন সবজি বিক্রি করছে ৷ আমাদের কাছে অনেকে সাহায্য চাইতে আসছে ৷ আমরা সংগঠনগতভাবে তাদের সাহায্যের চেষ্টা করছি ৷ কারণ, ব্যক্তিগতভাবে এই হাজার হাজার মানুষকে সাহায্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় ৷ এই মুহূর্তে মালদা জেলায় প্রায় 1400 অটো রয়েছে ৷ টোটোর সংখ্যা প্রায় 13 হাজার ৷ কোরোনার লকডাউনে এরা সবাই বিপর্যস্ত ৷”