মালদা, 24 মার্চ : ভোটপুজো সামনেই । প্রতিশ্রুতির ঢাক বাজাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলি । ইতিমধ্যে তৃণমূল থেকে বিজেপি, সিপিএম থেকে কংগ্রেস, সকলেই নিজেদের নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করেছে । প্রতিটি দলই নিজেদের ইস্তাহারে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিয়েছে । প্রায় প্রত্যেক দলই জানিয়েছে, ভোটে জিতলে গরিব পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করবে । কেউ বলছে, উত্তরবঙ্গের চা বাগানের শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি করা হবে 350 টাকা । কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলই মালদা জেলার বিড়ি শ্রমিকদের কথা ভাবেনি । অন্তত ইস্তাহারে তার কোনও প্রতিফলন নেই । এতেই হতাশ জেলার বিড়ি শ্রমিকরা । তাঁদের দরজায় ভোট চাইতে গেলে এবার প্রতিটি দলের প্রার্থীই প্রশ্নের মুখে পড়বেন ।
মালদা জেলায় এখনও কোনও ভারী শিল্প গড়ে ওঠেনি । কুটিরশিল্পেই ভরসা জেলার লাখ লাখ মানুষের । যেমন, সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ বিড়ি শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত । এর মধ্যে বিড়ি শ্রমিকের সংখ্যা তিন লাখেরও বেশি । একসময় তাঁরা বিড়ি কারখানার মালিকদের হাতে রীতিমতো শোষিত হতেন । প্রতি হাজার বিড়ি বেঁধে রোজগার হত 30 থেকে 40 টাকা । এখন অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলেও আকালের বাজারে নয়া মজুরিতেও সংসার চলে না । বর্তমানে প্রতি হাজার বিড়ি বেঁধে ওঁরা মজুরি পান মাত্র 150 টাকা । অথচ এই কাজে ঝুঁকি অনেক । দীর্ঘদিন ধরে তামাকের কাজ করায় অনেক শ্রমিকই যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন । অথচ তাঁদের জন্য বিমার কোনও ব্যবস্থা নেই । কোনও ভাতাও জোটে না ।
ইংরেজবাজারের আরাপুর গ্রামে একযোগে বিড়ি বাঁধছিলেন বেশ কিছু শ্রমিক। সকলেই মহিলা । তাঁদের মধ্যে থেকে রশিদা বিবি বলে ওঠেন, "15 বছর ধরে বিড়ি বাঁধছি । দিনে 10 ঘণ্টা কাজ করলে খুব বেশি হলে 700 বিড়ি বাঁধা যায় । কিন্তু মজুরি জোটে হাজার বিড়িতে মাত্র 150 টাকা । শুনেছি, রাজনৈতিক দলগুলি এবার ভোটে জিতলে উত্তরবঙ্গের চা শ্রমিকদের দৈনিক 350 টাকা মজুরির করার কথা বলেছে । আমাদের মজুরি কি বাড়বে না ? বিড়ি বাঁধতে গেলে কাশি সহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় । বিড়ি বাঁধায় খুব কষ্ট । তবু সংসার চালাতে বিড়ি বাঁধতে হয় । এই অবস্থায় আমাদের মজুরি বাড়লে খুব ভালো হয় ।"
আরও পড়ুন: মালদায় আগ্নেয়াস্ত্র ও কার্তুজ-সহ গ্রেফতার দুষ্কৃতী
আরেক শ্রমিক দিলারা খাতুন বলেন, "প্রতি হাজার বিড়ি বেঁধে আমরা 150 টাকা মজুরি পাই । ভোটের মুখে রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের ইস্তাহার প্রকাশ করেছে । তাতে দেখা যাচ্ছে, উত্তরবঙ্গের চা শ্রমিকদের দৈনিক 350 টাকা মজুরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে । কিন্তু বিড়ি শ্রমিকদের কথা কেউ বলছে না । রাজনৈতিক দলগুলি যাতে আমাদের মতো বিড়ি শ্রমিকদের কথাও ভাবে, তার জন্য আবেদন জানাচ্ছি । কারণ, এই মজুরিতে আমাদের সংসার চলে না । তার উপর এই কাজে অনেক শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় । কিন্তু আমাদের জন্য বিমা কিংবা অন্য কোনও সুবিধে হয়নি । এই টাকা দিয়েই আমাদের পেট চালানোর সঙ্গে ছেলেমেয়ের পড়াশোনা সহ যাবতীয় কাজে চলে ।"
বিড়ি শ্রমিক তহমিনা বিবি বলেন, "বিড়ি বাঁধার জন্য শরীরে অসম্ভব সমস্যা হয় । বুকে কফ জমে থাকে । কাশি সারতে চায় না । কিন্তু সংসার তো চালাতে হবে ! যা মজুরি পাই, তাতে সংসার চলে না । তার উপর চিকিৎসা, ছেলেমেয়ের পড়াশোনাও রয়েছে । শুনছি, রাজনৈতিক দলগুলি চা শ্রমিকদের দৈনিক 350 টাকা মজুরি করার আশ্বাস দিয়েছে । কিন্তু ওদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করতে চাই না । তাতে বিবাদ হবে । আমরা চাই, আমাদেরও মজুরি বাড়ানো হোক । ভোট চাইতে আসলে আমরা রাজনৈতিক দলগুলির কাছেও এই আর্জি রাখব । কিন্তু তাঁরা নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যায় । যদি বলি, ভোট দিতে যাব না, তাহলে বলবে, তোমরা দেশের নাগরিক নও । তাই ভোট দিতেই হয় । দিনের পর দিন এভাবেই চলছে । কিন্তু আমাদের সমস্যা বাড়ছে ।"
বিড়ি শ্রমিকদের সংগঠনগুলি প্রতিটিই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় রয়েছে । ফলে ভোটের মুখে শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে মুখ খুলতে রাজি নয় কেউ । কিন্তু আর কতদিন জেলার কয়েক লাখ বিড়ি শ্রমিকের এভাবে দিন কাটবে ? তাঁদের দিনবদলের দিন আসবে না ?