মালদা, 13 নভেম্বর : কালিয়াচক 2 ব্লকের ইমামবাড়া এলাকায় সর্বধর্মের কালীপুজো ৷ জনশ্রুতি, এই পুজো চলে আসছে প্রায় 700 বছর ধরে । পুজোর পত্তন হয় এক মুসলিম রাজার আনুকূল্যে । এখনও এই পুজোয় হিন্দুদের সঙ্গে সমানতালে অংশ নেয় মুসলমানরা । অংশ নেয় অন্য ধর্মের মানুষজনও । শোনা যায়, ইসলাম ধর্মাবলম্বী সেই রাজার শর্ত মেনেই এখনও এই পুজোয় কোনও মূর্তি ওঠে না । রাতের পরিবর্তে পুজো হয় দিনে । কালীপুজোর দিন এখানে পুজো হয় না । পুজো হয় পরদিন । বলিতে কোনও হাড়িকাঠ ব্যবহার করা হয় না । এখানে এক কোপে ছাগের মুন্ড আলাদা না হলেও অন্যান্য জায়গার মতো বলি নষ্ট হয় না । একাধিকবার কোপ দিয়ে ছাগবলি করা যায় । অর্থাৎ বলির জায়গায় কার্যত জবাই প্রথা এখানে চালু রয়েছে । এভাবেই সর্বধর্মের কালীপুজো অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে ৷
ইমামবাড়া এলাকার অদূরেই সঙ্গম হয়েছে গঙ্গা, ভাগীরথী ও পাগলা নদীর । অনেক আগে এই এলাকা পুরোপুরি জঙ্গলে ঢাকা ছিল । সেই সময় জনবসতি থেকে অনেক দূরে এই জায়গায় ছিল শ্মশান । ভাগীরথী গতিপথ পালটে ফেললেও এখনও তার খাতের ধারে রয়েছে সেই শ্মশান । কয়েকবছর আগে সেই মজা খাত দিয়ে ফের গঙ্গার জল ঢোকানো হচ্ছে । যা মরা ভাগীরথী নামে খ্যাত । গঙ্গার জলপ্রবাহ এই খাতে ধরে রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছে স্লুইস গেট । সেই গেটের পাশেই রয়েছে পুরোনো এই কালী মন্দির । যা পাগলি কালী নামে মানুষের মুখে প্রচলিত ।
কথিত রয়েছে, প্রায় 700 বছর আগে ইমামবাড়া এলাকার অধিপতি ছিলেন ইমাম নামে এক রাজা । তাঁর রাজত্বে এই এলাকার জমিদার ছিলেন মধুনাথ মিশ্র । তাঁর ছেলে দুর্গানাথ মিশ্রের সেরেস্তার কাজ করতেন কালু ঘোষ । একই রাতে মিশ্র ও ঘোষ পরিবারের দুই ব্যক্তি কালীর স্বপ্নাদেশ পান । দেবী দু'জনকেই জানান, ভাগীরথী দিয়ে তাঁর পদচিহ্ন ও পুজোর ঘট ভেসে যাচ্ছে । তাঁকে যেন এই এলাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয় । পরদিন দুই পরিবারের সদস্যরা সত্যিই ভাগীরথী দিয়ে দেবীর পদচিহ্ন ও ঘট ভেসে যেতে দেখেন । তাঁরা সেসব নদী থেকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে যান । রাতে তাঁরা ফের স্বপ্নাদেশ পান, বাড়িতে নয়, দেবীকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে শ্মশানের ধারে, পিপুল গাছের নীচে । কিন্তু সেই জায়গার রাজা তো মুসলমান ইমাম! তাই ও এক চিন্তা করে বেশ কিছুদিন পর দুর্গানাথবাবু এলাকার লোকজনকে নিয়ে রাজার কাছে যান । দেবীর আদেশের কথা তাঁকে জানান । ততদিন ঘোষবাড়ির গোয়াল ঘরে মায়ের পুজো চলছিল । রাজা সব শুনে বলেন, তিনি কালী প্রতিষ্ঠায় রাজি । তবে তাঁর কয়েকটি শর্ত আছে । ইমাম শর্ত দেন, এখানে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদেরও দেবীর আরাধনা করতে দিতে হবে । পুজো দিনে করতে হবে । কালীপুজোর দিন বাৎসরিক পুজো করা যাবে না । কারণ, সেই দিনটি মূলত হিন্দুদের জন্যই বরাদ্দ । তাই পাগলি কালীর পুজো হবে পরদিন । বলিতে কোনও হাড়িকাঠ ব্যবহার করা চলবে না । জবাইয়ের মতো ছাগ বলি দিতে হবে । কারণ, মুসলমানরা বলি প্রথা মানে না । রাজার সব শর্ত মেনে নয় ইমামবাড়া এলাকার লোকজন । প্রতিষ্ঠিত হয় পাগলি কালীর বেদি । পরে সেই বেদির উপর মন্দির গড়ে উঠেছে ।
মধুনাথবাবুর উত্তরপুরুষ, বর্তমানে পুজোর পুরোহিত দীপঙ্কর মিশ্র জানালেন, "এই পুজো প্রায় 700 বছরের পুরোনো । আমাদের পূর্বপুরুষ মধুনাথ মিশ্রের ছেলে দুর্গানাথ মিশ্রের আমল থেকে এই পুজো হয়ে আসছে । মিশ্র পরিবারের জমিদারি তখন দেখাশোনা করত ঘোষ পরিবার । আজও ওই বংশের লোকজন সেবাইত হিসাবে এই পুজোকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে । অনেক আগে এই এলাকা জঙ্গলে ভরতি ছিল । ভাগীরথীর তীরে ছিল শ্মশান । সেই সময় ডাকাতরাও এই এলাকায় আস্তানা গড়ত । স্বপ্নাদেশে মায়ের ঘট ও পদচিহ্ন এখানে পাওয়া গিয়েছিল । মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে দুর্গানাথ মিশ্র ও কালু ঘোষ নদী থেকে সেসব তুলে আনেন । প্রথমে সেগুলি নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় । পরে দেবী ফের স্বপ্নাদেশ দেন । তিনি আদেশ দেন, নদীর ধারে শ্মশান এলাকায় পিপুল গাছের নীচে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে । এখানে মায়ের কোনও মূর্তি নেই । কালীপুজোর দিন, দিনের বেলায় এই পুজো হয় । পুজোয় কোনও বিধিনিষেধ নেই । বলিতে হাড়িকাঠ ব্যবহার হয় না । ঘোষ পরিবারের লোকজনই এখানে বলি দেয় । প্রতিবছর প্রায় সাড়ে তিন হাজার ছাগবলি হয়ে থাকে । আগে এটা ইমাম রাজার জায়গা ছিল । পরবর্তীতে তাঁকে চাঁচলে জমি দিয়ে এই জায়গা তাঁর হাত থেকে মুক্ত করা হয় । সব ধর্মের মানুষ এই পুজোয় অংশ নেয় । মুসলমানরাও এখানে ছাগ বলি দেয় ।"
স্থানীয় বাসিন্দা মানিকচন্দ্র মণ্ডল বলেন, "পুজোর ইতিহাস নিয়ে আমি বেশি কিছু জানি না । তবে ছোটো থেকে দেখে আসছি, পুজো হয় দিনের বেলা । কালীপুজোর পরদিন এখানে পুজো হয় । পুজোকে কেন্দ্র করে বড় মেলা বসে । প্রচুর ছাগবলি হয় । সব ধর্মের মানুষ এই পুজোয় অংশ নেয় । মুসলমানরাও বলি দেয় । তবে শুনেছি, এক মুসলিম রাজার আনুকূল্যে এই পুজোর পত্তন হয়েছিল । এখন গোটা জেলা থেকেই মানুষ এখানে পুজো দিতে আসে ।" আর এক স্থানীয় বাসিন্দা বরকত শেখ বলেন, "আমরাও এই পুজোয় অংশ নিই । আমরাও এখানে ছাগবলি দিই । এই কালীর অনেক মহিমা রয়েছে । জন্মের পর থেকেই আমি এই পুজো দেখে আসছি । পুজোতে আমরা হিন্দুদের মতোই আনন্দ করি । এখানে কখনও মূর্তিপুজো হতে দেখিনি ।"