কলকাতা, 26 জুলাই : সযত্নে রক্ষিত আবক্ষ মূর্তি ঘিরে চেনা আবেগের বিস্ফোরণ রয়েছে । শ্রদ্ধায় স্মরণে টালাবাসীর আমফানের জন্য সুন্দরবনে পাঠানো ত্রাণে জ্বলজ্বল করছিল তাঁর নাম । এ তল্লাটের একমাত্র লাইব্রেরিও তাঁরই নামে । বাৎসরিক রক্তদান শিবিরও হয় তাঁর নামে । তাঁর রক্তঋণ শোধ করতে রক্তদানের সেই প্রক্রিয়া চালানো হবে আদিগন্ত কাল ধরে । সেটাই ধনুক ভাঙা পণ । কার্গিল জয় দেখে যেতে পারেননি ক্যাপ্টেন কণাদ ভট্টাচার্য । তাতে কি ! কণাদের রক্তঝরা বলিদানেই তো এসেছিল যুদ্ধ জয়ের গৌরব । সেটা ছিল 26 জুলাই । ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজয় দিবস ৷
সালটা 1999 । চলছে কারগিল যুদ্ধ । 21 মে বিকেল থেকে কণাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পরিবারের । সেনাবাহিনীর শিখ রেজিমেন্টের সদস্য হিসাবে কণাদ গিয়েছিলেন কারগিল যুদ্ধে । তখন ওর বয়স 24 । টানা দু'মাস একদিনও মামা বিপিনবিহারী, মা পূর্ণিমা, বাবা কমলাকান্ত, আর দুই বোন দু'চোখের পাতা এক করতে পারেনি । ছটফটে ছেলেটাকে ভালোবাসতো গোটা পাড়া । আসলে ছোট থেকে মামার বাড়িতেই মানুষ কণাদ । ঠিকানা 3/2 D, BT রোড । এলাকাটা টালা বারওয়ারি দূর্গা পূজা কমিটির একেবারে পাশে । টালা ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশনের মাঠে ক্যারাটে শিখতেন কণাদ । সেখান থেকেই আসে ব্ল্যাক বেল্ট । ভালো ক্রিকেট খেলতেন । কলকাতা ক্রিকেট লিগের প্রথম ডিভিশনের প্লেয়ার ছিলেন তিনি । বিপদে-আপদে পাড়ার লোকের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া ছিল তাঁর অভ্যেস । সেটা পেয়েছিলেন মামা আর বাবার কাছ থেকেই । এমন যুবককে না ভালোবেসে থাকা যায় ! টালা এলাকাও তাই কণাদের নিখোঁজ হওয়ার খবরে ছিল বিষন্ন । প্রতিদিনই দু'বেলা খোঁজ নিতেন এলাকার মানুষজন । বিশেষ করে অনুজিৎ কুমার নান । ক্লাব অন্তপ্রাণ মানুষটা ছুটে গিয়েছেন কণাদের বাড়িতে বারবার । কোনও খবর এলো না কি? একটু একটু করে আশা কমছিল । কিন্তু টালাবাসী যেন মানতে চাইছিল না । সবাই মনে প্রাণে চাইছিলেন এক চমৎকার ঘটিয়ে ফেরৎ আসুক কণাদ । নাহ, আসেননি ।
দিনটা ছিল 15 জুলাই । শ্রাবণের অঝোর ধারায় সিক্ত কলকাতার রাজপথ । বৃষ্টি ঝরা সেই দিনে ফোন আসে কণাদের বাড়িতে । কণাদের সহকর্মী ধরা গলায় জানান খবরটা । কার্গিল সেক্টরের টাইগার হিলে উদ্ধার হয়েছে বীরের দেহ । গুলিতে তা প্রায় ঝাঁঝরা । মুহূর্তে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন পূর্ণিমা । বিলাপ করে ওঠেন, " তুই যে বাবা কথা দিয়ে ছিলি যুদ্ধ জিতে আমায় মেডেল এনে দিবি . . . " মুহূর্তে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে খবরটা । গোটা টালা এলাকা সেদিন ভেঙে পড়েছিল টিনের চালের একচিলতে ঘরটায় । সবার চোখে জল ।
17 জুলাই কলকাতা বিমানবন্দরে নামে কণাদের কফিনবন্দী দেহ । পাড়ার কয়েক জন গেছিলেন সেখানে । ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও । তার ব্যবস্থাপনাতেই টালায় আসে কফিন । সেদিন শুধু টালাবাসী নয়, কণাদকে একটিবার দেখতে গোটা কলকাতা যেন নেমে এসেছিল রাজপথে । শহিদ তর্পণে । রাজপথে সেদিন হয়েছিল পুষ্প বৃষ্টি । স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে অনুজিৎ বলছিলেন, " আমার 55 বছরের জীবনে আবেগের অমন বিস্ফোরণ দেখিনি । রাস্তার দু'ধারে শুধু কালো মাথার সারি । চোখে জল শহরবাসীর । হাতে ফুল । গলায় ছিল জাতীয় সংগীত । " দেখতে দেখতে পার হয়ে গেছে 20 টা বছর । কিন্তু সেদিনের স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছে টালা এলাকা । আরও ভালো করে বললে টালা ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশন । সেদিনের সেই টিনের চালের ক্লাব ঘর এখন তিন তলা বিল্ডিং । এই ক্লাবেই ক্যারাটে শিখে ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছিলেন কণাদ । তার স্মৃতিতে আজকের পাকা বিল্ডিংয়ের নাম দেওয়া হয়েছে কণাদ ভবন । ক্লাবের সামনে বসেছে আবক্ষ মূর্তি । ক্লাবের গ্রন্থাগারের নামও কণাদের নামেই । টালা ব্রিজের উপরের বাস স্টপটাও ছিল শহিদের নামে । এখন টালা ব্রিজ অতীত ৷ এক স্মৃতি । চারপাশে শুধুই ধ্বংসস্তূপ । ভাঙা পড়েছে সেই বাস স্টপ । সেদিকে তাকিয়ে কণাদ স্মৃতি রক্ষায় তৎপর কল্যাণ চৌধুরী বলেন, " নতুন ব্রিজ তৈরি হলেও বাস স্টপের নাম একই থাকবে । আমরা জানাবো সেই দাবি । " কল্যাণ কণাদের বেড়ে ওঠা বাড়িটার বর্তমান মালিক । বাড়ির মাঝে তিনি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেন কণাদকে । বলেন, " আমার বড় ভালো লাগে এটা ভাবতে ৷ যে আমি কণাদের বাড়িতে থাকি । এই বাড়িতে এসেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর, সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, দিলীপ ঘোষসহ আরও অনেকে । কণাদের বাড়ি যখন বিক্রি হয়ে যাবে শুনেছিলাম, তখন মনের ভেতর জেদ চেপে গেছিল । যেকোনও লোকের হাতে এই বাড়ি তুলে দেওয়া যাবে না ৷ অনেক কষ্ট করে এই বাড়িটা কিনেছি । আজ অবধি সেই বাড়ির কোনও পরিবর্তন হয়নি । "
শুধু বিজয় দিবস নয়, কণাদের জন্মদিনটাও ঘটা করে পালন করে টালা ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশন । সম্পাদক অনুজিৎ নান বলেন, " কণাদের জন্মদিন উপলক্ষে আমরা রক্তদান শিবির করি । কোনও উপহার দেওয়া হয় না রক্তদাতাদের । শুধু ওর নাম টুকুই যথেষ্ট । একশোরও বেশি মানুষ সেই রক্তদান শিবিরের রক্ত দেন । শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন কণাদকে । " না, এখন আর চোখের জল পড়ে না টালাবাসীর । বরং কণাদের নাম শুনলে বুকটা গর্বে ফুলে ওঠে । কণাদের দেহ যেদিন কলকাতা বিমানবন্দরে আসে, সেদিন ওর বাবা কমলাকান্ত সবাইকে বলেছিলেন, " কাঁদবেন না কেউ । ও দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে । এ মৃত্যু গর্বের । " কণাদের শেষকৃত্যের পর কমলাকান্ত লিখে গিয়েছিলেন দুটো লাইন, " আমার জীবনে, লভিয়া জীবনে/জাগরে সকল দেশ ৷ "