ETV Bharat / state

লকডাউন-আমফানের খাঁড়া এড়িয়ে 21-এর ভোটে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে মমতা

কোরোনা ভাইরাস ও লকডাউন । এই দুয়ে জর্জরিত রাজ্যের উপর আছড়ে পড়ল আমফান । সুযোগ বুঝে চাপ বাড়াতে ছাড়বে না বিরোধীরাও । ত্রিমুখী এই পরিস্থিতির পর আগামী বছর বিধানসভা ভোটে ঘুরে দাঁড়ানোর বড় চ্যালেঞ্জ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে । কেন চ্যালেঞ্জ ? বিশ্লেষণে দীপঙ্কর বসু ।

author img

By

Published : May 28, 2020, 10:34 PM IST

Updated : May 29, 2020, 11:25 AM IST

21-এর ভোটে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে মমতা
21-এর ভোটে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে মমতা

কলকাতা : শুরুটা হয়েছিল 24 মার্চ । আর মে-র 20-এ যেন বিষফোঁড়া ।

কোরোনা ভাইরাস এবং লকডাউন । দেওয়ালে পিঠ ঠেকেই ছিল । তারই মাঝে ঘূর্ণিঝড় আমফানের তাণ্ডব । কার্যত লন্ডভন্ড গোটা বাংলা । শেষ বার 1737-এর বেঙ্গল সাইক্লোন । 280 বছরের মধ্যে এমন ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেনি রাজ্য । সাম্প্রতিক সময়ে গতি-তীব্রতা-ভয়াবহতা-ধ্বংসলীলার নিরিখে যার সঙ্গে তুলনীয় একমাত্র 1999-এর ওড়িশার সুপার সাইক্লোন । যে ক্ষত সারিয়ে উঠলেও 'সাইক্লোন' শব্দটা ওই প্রদেশের মানুষের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট । সরকারি তথ্য অনুসারে, সেই ঝড়ের তাণ্ডবলীলায় পড়শি রাজ্যে প্রাণ হারিয়েছিলেন 9,885 জন । যদিও বেসরকারি মতে মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছিল 30 হাজারে ।

কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটা বছর । এখন অনেক আগে থেকেই বিপদের পূর্বাভাস পাওয়া যায় । হওয়া যায় সর্তকও । বিপর্যয় মোকাবিলা করার ক্ষমতা হয়েছে আগের থেকে অনেক ক্ষুরধার ।

কিন্তু, 20 মে !

সব হিসেব-নিকেশ যেন ওলট-পালট হয়ে গেল এক সন্ধ্যায় । বঙ্গোপসাগর থেকে সুন্দরবনের দিকে যত এগোল আমফান ততই দিশেহারা হতে থাকল রাজ্য প্রশাসন, কেন্দ্রীয় সরকার থেকে সাধারণ মানুষ প্রত্যেকেই । কী করা উচিত, কী করলে সামান্যতম রক্ষা মিলবে- কোনও হিসেবই মিলছিল না । স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ঘোষণা, কোরোনায় আক্রান্ত হয়ে ইতিমধ্যেই রাজ্যে প্রাণ হারিয়েছেন 223 জন । আক্রান্তের সংখ্যা 4,536 । আবার ভিনরাজ্যে আটকে থাকা শ্রমিকদের ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার । প্রতিদিনই বাস এবং ট্রেনে করে ফিরছেন বহু পরিযায়ী শ্রমিক । এমন পদক্ষেপ রাজ্যে কোরোনা সংক্রমণের মাত্রা যে বৃদ্ধি করতে পারে, সেই সম্ভাবনা কোনওভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না ।

পরিসংখ্যান বলছে, রুজিরুটির তাগিদে দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে কাজ করেন বাংলার কয়েক হাজার শ্রমিক । বছরে নানা রাজ্য থেকে যে পরিমাণ শ্রমিক ভিন রাজ্যে কাজ করতে যান, সেই সংখ্যাটি আর পাঁচটা রাজ্যের থেকে অনেকটাই বেশি বাংলায় । লকডাউনের জেরে কাজ হারিয়েছেন, এই সব হাজার হাজার শ্রমিক । যাঁরা কেউ ট্রেনে-বাসে কেউ বা হেঁটে বাড়ি ফিরছেন । রাজ্য প্রশাসন এই সব শ্রমিকদের পৃথক রাখার জন্য (14 দিনের কোয়ারানটিন) চিন্তাভাবনাও করছিল, যাতে কোনওভাবেই কোরোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে না পড়ে ।

যদিও, কোরোনা মোকাবিলায় নবান্নের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল বার বার । প্রশিক্ষিত নার্স, চিকিৎসক যেমন কম, তেমনই PPE কিটের অভাব রাজ্যের জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর খামতি আরও প্রকট করে তুলছিল । এই দুর্বলতা নিয়ে সরকারকে নিশানা করতে পিছপা হচ্ছিল না বাম-ডান কোনও পক্ষই । দেওয়ালে পিঠ ঠেকেই ছিল । ঠিক সেই সময় আছড়ে পড়ল ঘূর্ণিঝড় আমফান ।

পূর্ব মেদিনীপুরের দিঘা-শংকরপুর-তাজপুর । উপকূলবর্তী এলাকায় বইতে শুরু করেছে ঝোড়ো হাওয়া । নবান্নের কন্ট্রোল রুমে তখন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । উদ্দেশ্য, গোটা পরিস্থিতির উপর নজরদারি । কিন্তু, ঘূর্ণিঝড়ের মতিগতি ছিল অন্য । 20 মে, দুপুর । ঘড়ির কাঁটা সবে 2 টা 30 টপকেছে । তীব্র গতিতে আছড়ে পড়ল আমফান । মূহূর্তে সুন্দরবন সংলগ্ন গোটা এলাকা পরিণত হল ধ্বংসস্তূপে । যেন তাসের ঘরের চেহারা নিয়েছে গোটা দক্ষিণ 24 পরগনা । ঝড়ের গতি তখন ঘণ্টায় 190 কিলোমিটার ছাড়িয়েছে । বাঁধের পর বাঁধ, বাড়ির পর বাড়ি ভেঙে পড়ছে । মুহূর্তে মনে করিয়ে দিল আয়লা, বুলবুল এবং ফণীর তাণ্ডবের কথাগুলো । 2009 এবং 2019 সালে তো এমনই ছবি দেখেছিলেন সেখানকার বাসিন্দারা । গতি সামান্য কমিয়ে আমফানের অভিমুখ তখন কলকাতার দিকে । গতিবেগ ঘণ্টায় 130 কিলোমিটার । দমদম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শুরু করে হুগলি নদী বয়ে শহর কলকাতায় শুরু হল আমফানের আস্ফালন । গোটা শহর তখন গৃহবন্দী । প্রার্থনা একটাই, প্রলয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার । মুখ্যমন্ত্রী ঠায় বসে কন্ট্রোল রুমে । প্রত্যক্ষ করছেন প্রকৃতির তাণ্ডবলীলা ।

আনন্দের শহরে তখন শুধুই হাহাকার । রাত যত বেড়েছে বিদ্যুৎহীন শহরের অন্ধকার হয়েছে ততই গাঢ় । বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি আর গোঁ গোঁ করে ফুঁসে চলা আমফান । দিনটার উপর যেন ভেঙে পড়েছিল ভয়ঙ্কর হতাশা । সুন্দরবনের গ্রামীণ জনপদ থেকে কলকাতা শহর- এক লহমায় যেন ভুতুড়ে বাড়ির চেহারা নিয়েছিল । মুখ্যমন্ত্রী আগে জানিয়েছিলেন মৃতের সংখ্যা 72, যা ক্রমে বেড়ে 86 ছুঁয়েছে । দুই 24 পরগনা হারিয়েছে তার পরিচিত রূপ ।

পরিসংখ্যান বলছে, আম, লিচু, পান-সুপারি থেকে শুরু করে পাট, তিল বা যে কোনও রকমের সবজি সব কিছুই মুছে গিয়েছে এই দুই জেলা থেকে । 1650 হেক্টরেরও বেশি জমির উৎপাদন নষ্ট হয়েছে । শুধু ধান নষ্ট হয়েছে 1.58 লাখ হেক্টর জমির । রাজ্য কৃষি দপ্তর জানিয়েছে, যদিও 76.5 শতাংশ বোরো ধান কাটা হয়ে গিয়েছিল, তবুও জমিতে জল জমে যাওয়ায় পরিস্থিতি জটিল হতে চলছে । কারণ, যে ধান কেটে মাঠে ফেলা রাখা হয়েছিল গোলায় তোলার জন্য, তার সবটাই প্রায় জলের তলায় । কোরোনার ফলে ইতিমধ্যেই সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে । আর ঠিক সেই সময়ই তাণ্ডব চালাল আমফান ।

ইতিহাস ঘেঁটে একটা কথা বলাই চলে, এই আমফানের সঙ্গে তুলনীয় একমাত্র 1737-এর বেঙ্গল সাইক্লোন । 10 ও 11 অক্টোবরের সন্ধিক্ষণে ধেয়ে এসেছিল ঘূর্ণিঝড় । তুমুল ঝোড়া হাওয়া-বৃষ্টির দাপট কেড়ে নিয়েছিল তিন লাখেরও বেশি প্রাণ । আর এবার মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, আমফানে ক্ষতির মুখে ছয় কোটির বেশি মানুষ । যা জাতীয় বিপর্যয়ের সামিল ।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইতিমধ্যেই হাজার কোটির আর্থিক সাহায্যের কথা ঘোষণা করেছেন । রাজ্য প্রশাসনও হাজার কোটির ত্রাণ তহবিল গঠন করেছে । প্রায় 400 কিলোমিটার জুড়ে পুর্নবাসন এবং পুনর্নির্মাণের কাজ করতে হবে । কিন্তু, কীভাবে মানা হবে সামাজিক দূরত্ব ? যখন কোরোনার মত বিপদ লুকিয়ে রয়েছে প্রতিটি কোণায়, তখন কীভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব হবে ? লকডাউনের কারণে চাপ আগেই ছিল, এবার ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে কার্যত সর্বশান্ত হয়ে যাওয়া কৃষকরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন ? কাজ হারিয়ে ফিরে আসা হাজার হাজার শ্রমিকের ভবিষ্যৎ কী ? দু-মুঠো অন্ন সংস্থানের জন্য তাঁরা কি রাজ্যে কাজ পাবেন ? সন্দেহ নেই, এই প্রশ্নগুলো বেশ কিছু সময়ের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যস্ত রাখবে ।

আর একবার ইতিহাস-পরিসংখ্যানের দিকে নজর দেওয়া যাক । 2009 সালের আয়লার প্রভাব তেমনভাবে পড়েনি শহর কলকাতায় । মূলত, দুই 24 পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর এবং হাওড়াতেই ঝড়ের দাপাদাপি চলেছিল সেবার । তখন বাংলার মাটিতে বাম রাজত্বের সব থেকে কঠিন সময় । তার ঠিক দুই বছর পর 2011 সালে বিধানসভা নির্বাচনে এই জেলাগুলি থেকে পুরোপুরি মুছে গিয়েছিল বামেরা ।

আমফানের তাণ্ডবে বিদ্যুত্হীন থেকেছে শহর কলকাতার অনেকাংশ । কোথাও 70, কোথাও আবার 99 ঘণ্টা পর মাথার উপর পাখা ঘুরেছে । শহরের অধিকাংশ এলাকায় নিত্য ব্যবহার্য-পানীয় জলটুকুও পাওয়া যায়নি । ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ । পথে নেমে অবরোধ করেছেন । পিছপা হননি ঘেরাও করতে ।

আগামী বছর রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন । ইতিমধ্যেই তৃণমূল কংগ্রেসের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে গেরুয়া শিবির । গত লোকসভা ভোটে দিলীপ ঘোষদের 'রকেট গতি'র উত্থান তৃণমূলের অন্দরে চাপটা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে ।

আর একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দিয়ে শেষ করা যাক । 2004-এ একটি আসন থেকে 2009-এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল উঠে এসেছিল 19-এ । আর বামেরা 26 থেকে কমে দাঁড়িয়েছিল 9টিতে । সেই 2009 সালেই আয়লার দাপট দেখেছিল বাংলা । এরপর 2011 সালের বিধানসভা ভোটে 34 বছরের বাম শাসনের পতন হয় । কাকতালীয়ভাবে হলেও, 2019-এর লোকসভা ভোটে 2 থেকে 18-এ চলে আসে BJP। আর তার পর আমফান ।

ফের একবার কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে বাংলার মাটিতে ? নিঃসন্দেহে আমফান মমতার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ বয়ে নিয়ে আসবে ।

লেখক- ETV ভারতের নিউজ় কো-অর্ডিনেটর

কলকাতা : শুরুটা হয়েছিল 24 মার্চ । আর মে-র 20-এ যেন বিষফোঁড়া ।

কোরোনা ভাইরাস এবং লকডাউন । দেওয়ালে পিঠ ঠেকেই ছিল । তারই মাঝে ঘূর্ণিঝড় আমফানের তাণ্ডব । কার্যত লন্ডভন্ড গোটা বাংলা । শেষ বার 1737-এর বেঙ্গল সাইক্লোন । 280 বছরের মধ্যে এমন ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেনি রাজ্য । সাম্প্রতিক সময়ে গতি-তীব্রতা-ভয়াবহতা-ধ্বংসলীলার নিরিখে যার সঙ্গে তুলনীয় একমাত্র 1999-এর ওড়িশার সুপার সাইক্লোন । যে ক্ষত সারিয়ে উঠলেও 'সাইক্লোন' শব্দটা ওই প্রদেশের মানুষের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট । সরকারি তথ্য অনুসারে, সেই ঝড়ের তাণ্ডবলীলায় পড়শি রাজ্যে প্রাণ হারিয়েছিলেন 9,885 জন । যদিও বেসরকারি মতে মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছিল 30 হাজারে ।

কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটা বছর । এখন অনেক আগে থেকেই বিপদের পূর্বাভাস পাওয়া যায় । হওয়া যায় সর্তকও । বিপর্যয় মোকাবিলা করার ক্ষমতা হয়েছে আগের থেকে অনেক ক্ষুরধার ।

কিন্তু, 20 মে !

সব হিসেব-নিকেশ যেন ওলট-পালট হয়ে গেল এক সন্ধ্যায় । বঙ্গোপসাগর থেকে সুন্দরবনের দিকে যত এগোল আমফান ততই দিশেহারা হতে থাকল রাজ্য প্রশাসন, কেন্দ্রীয় সরকার থেকে সাধারণ মানুষ প্রত্যেকেই । কী করা উচিত, কী করলে সামান্যতম রক্ষা মিলবে- কোনও হিসেবই মিলছিল না । স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ঘোষণা, কোরোনায় আক্রান্ত হয়ে ইতিমধ্যেই রাজ্যে প্রাণ হারিয়েছেন 223 জন । আক্রান্তের সংখ্যা 4,536 । আবার ভিনরাজ্যে আটকে থাকা শ্রমিকদের ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার । প্রতিদিনই বাস এবং ট্রেনে করে ফিরছেন বহু পরিযায়ী শ্রমিক । এমন পদক্ষেপ রাজ্যে কোরোনা সংক্রমণের মাত্রা যে বৃদ্ধি করতে পারে, সেই সম্ভাবনা কোনওভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না ।

পরিসংখ্যান বলছে, রুজিরুটির তাগিদে দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে কাজ করেন বাংলার কয়েক হাজার শ্রমিক । বছরে নানা রাজ্য থেকে যে পরিমাণ শ্রমিক ভিন রাজ্যে কাজ করতে যান, সেই সংখ্যাটি আর পাঁচটা রাজ্যের থেকে অনেকটাই বেশি বাংলায় । লকডাউনের জেরে কাজ হারিয়েছেন, এই সব হাজার হাজার শ্রমিক । যাঁরা কেউ ট্রেনে-বাসে কেউ বা হেঁটে বাড়ি ফিরছেন । রাজ্য প্রশাসন এই সব শ্রমিকদের পৃথক রাখার জন্য (14 দিনের কোয়ারানটিন) চিন্তাভাবনাও করছিল, যাতে কোনওভাবেই কোরোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে না পড়ে ।

যদিও, কোরোনা মোকাবিলায় নবান্নের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল বার বার । প্রশিক্ষিত নার্স, চিকিৎসক যেমন কম, তেমনই PPE কিটের অভাব রাজ্যের জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর খামতি আরও প্রকট করে তুলছিল । এই দুর্বলতা নিয়ে সরকারকে নিশানা করতে পিছপা হচ্ছিল না বাম-ডান কোনও পক্ষই । দেওয়ালে পিঠ ঠেকেই ছিল । ঠিক সেই সময় আছড়ে পড়ল ঘূর্ণিঝড় আমফান ।

পূর্ব মেদিনীপুরের দিঘা-শংকরপুর-তাজপুর । উপকূলবর্তী এলাকায় বইতে শুরু করেছে ঝোড়ো হাওয়া । নবান্নের কন্ট্রোল রুমে তখন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । উদ্দেশ্য, গোটা পরিস্থিতির উপর নজরদারি । কিন্তু, ঘূর্ণিঝড়ের মতিগতি ছিল অন্য । 20 মে, দুপুর । ঘড়ির কাঁটা সবে 2 টা 30 টপকেছে । তীব্র গতিতে আছড়ে পড়ল আমফান । মূহূর্তে সুন্দরবন সংলগ্ন গোটা এলাকা পরিণত হল ধ্বংসস্তূপে । যেন তাসের ঘরের চেহারা নিয়েছে গোটা দক্ষিণ 24 পরগনা । ঝড়ের গতি তখন ঘণ্টায় 190 কিলোমিটার ছাড়িয়েছে । বাঁধের পর বাঁধ, বাড়ির পর বাড়ি ভেঙে পড়ছে । মুহূর্তে মনে করিয়ে দিল আয়লা, বুলবুল এবং ফণীর তাণ্ডবের কথাগুলো । 2009 এবং 2019 সালে তো এমনই ছবি দেখেছিলেন সেখানকার বাসিন্দারা । গতি সামান্য কমিয়ে আমফানের অভিমুখ তখন কলকাতার দিকে । গতিবেগ ঘণ্টায় 130 কিলোমিটার । দমদম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শুরু করে হুগলি নদী বয়ে শহর কলকাতায় শুরু হল আমফানের আস্ফালন । গোটা শহর তখন গৃহবন্দী । প্রার্থনা একটাই, প্রলয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার । মুখ্যমন্ত্রী ঠায় বসে কন্ট্রোল রুমে । প্রত্যক্ষ করছেন প্রকৃতির তাণ্ডবলীলা ।

আনন্দের শহরে তখন শুধুই হাহাকার । রাত যত বেড়েছে বিদ্যুৎহীন শহরের অন্ধকার হয়েছে ততই গাঢ় । বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি আর গোঁ গোঁ করে ফুঁসে চলা আমফান । দিনটার উপর যেন ভেঙে পড়েছিল ভয়ঙ্কর হতাশা । সুন্দরবনের গ্রামীণ জনপদ থেকে কলকাতা শহর- এক লহমায় যেন ভুতুড়ে বাড়ির চেহারা নিয়েছিল । মুখ্যমন্ত্রী আগে জানিয়েছিলেন মৃতের সংখ্যা 72, যা ক্রমে বেড়ে 86 ছুঁয়েছে । দুই 24 পরগনা হারিয়েছে তার পরিচিত রূপ ।

পরিসংখ্যান বলছে, আম, লিচু, পান-সুপারি থেকে শুরু করে পাট, তিল বা যে কোনও রকমের সবজি সব কিছুই মুছে গিয়েছে এই দুই জেলা থেকে । 1650 হেক্টরেরও বেশি জমির উৎপাদন নষ্ট হয়েছে । শুধু ধান নষ্ট হয়েছে 1.58 লাখ হেক্টর জমির । রাজ্য কৃষি দপ্তর জানিয়েছে, যদিও 76.5 শতাংশ বোরো ধান কাটা হয়ে গিয়েছিল, তবুও জমিতে জল জমে যাওয়ায় পরিস্থিতি জটিল হতে চলছে । কারণ, যে ধান কেটে মাঠে ফেলা রাখা হয়েছিল গোলায় তোলার জন্য, তার সবটাই প্রায় জলের তলায় । কোরোনার ফলে ইতিমধ্যেই সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে । আর ঠিক সেই সময়ই তাণ্ডব চালাল আমফান ।

ইতিহাস ঘেঁটে একটা কথা বলাই চলে, এই আমফানের সঙ্গে তুলনীয় একমাত্র 1737-এর বেঙ্গল সাইক্লোন । 10 ও 11 অক্টোবরের সন্ধিক্ষণে ধেয়ে এসেছিল ঘূর্ণিঝড় । তুমুল ঝোড়া হাওয়া-বৃষ্টির দাপট কেড়ে নিয়েছিল তিন লাখেরও বেশি প্রাণ । আর এবার মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, আমফানে ক্ষতির মুখে ছয় কোটির বেশি মানুষ । যা জাতীয় বিপর্যয়ের সামিল ।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইতিমধ্যেই হাজার কোটির আর্থিক সাহায্যের কথা ঘোষণা করেছেন । রাজ্য প্রশাসনও হাজার কোটির ত্রাণ তহবিল গঠন করেছে । প্রায় 400 কিলোমিটার জুড়ে পুর্নবাসন এবং পুনর্নির্মাণের কাজ করতে হবে । কিন্তু, কীভাবে মানা হবে সামাজিক দূরত্ব ? যখন কোরোনার মত বিপদ লুকিয়ে রয়েছে প্রতিটি কোণায়, তখন কীভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব হবে ? লকডাউনের কারণে চাপ আগেই ছিল, এবার ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে কার্যত সর্বশান্ত হয়ে যাওয়া কৃষকরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন ? কাজ হারিয়ে ফিরে আসা হাজার হাজার শ্রমিকের ভবিষ্যৎ কী ? দু-মুঠো অন্ন সংস্থানের জন্য তাঁরা কি রাজ্যে কাজ পাবেন ? সন্দেহ নেই, এই প্রশ্নগুলো বেশ কিছু সময়ের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যস্ত রাখবে ।

আর একবার ইতিহাস-পরিসংখ্যানের দিকে নজর দেওয়া যাক । 2009 সালের আয়লার প্রভাব তেমনভাবে পড়েনি শহর কলকাতায় । মূলত, দুই 24 পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর এবং হাওড়াতেই ঝড়ের দাপাদাপি চলেছিল সেবার । তখন বাংলার মাটিতে বাম রাজত্বের সব থেকে কঠিন সময় । তার ঠিক দুই বছর পর 2011 সালে বিধানসভা নির্বাচনে এই জেলাগুলি থেকে পুরোপুরি মুছে গিয়েছিল বামেরা ।

আমফানের তাণ্ডবে বিদ্যুত্হীন থেকেছে শহর কলকাতার অনেকাংশ । কোথাও 70, কোথাও আবার 99 ঘণ্টা পর মাথার উপর পাখা ঘুরেছে । শহরের অধিকাংশ এলাকায় নিত্য ব্যবহার্য-পানীয় জলটুকুও পাওয়া যায়নি । ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ । পথে নেমে অবরোধ করেছেন । পিছপা হননি ঘেরাও করতে ।

আগামী বছর রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন । ইতিমধ্যেই তৃণমূল কংগ্রেসের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে গেরুয়া শিবির । গত লোকসভা ভোটে দিলীপ ঘোষদের 'রকেট গতি'র উত্থান তৃণমূলের অন্দরে চাপটা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে ।

আর একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দিয়ে শেষ করা যাক । 2004-এ একটি আসন থেকে 2009-এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল উঠে এসেছিল 19-এ । আর বামেরা 26 থেকে কমে দাঁড়িয়েছিল 9টিতে । সেই 2009 সালেই আয়লার দাপট দেখেছিল বাংলা । এরপর 2011 সালের বিধানসভা ভোটে 34 বছরের বাম শাসনের পতন হয় । কাকতালীয়ভাবে হলেও, 2019-এর লোকসভা ভোটে 2 থেকে 18-এ চলে আসে BJP। আর তার পর আমফান ।

ফের একবার কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে বাংলার মাটিতে ? নিঃসন্দেহে আমফান মমতার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ বয়ে নিয়ে আসবে ।

লেখক- ETV ভারতের নিউজ় কো-অর্ডিনেটর

Last Updated : May 29, 2020, 11:25 AM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.