কলকাতা, 25 সেপ্টেম্বর: তৃণমূল সাংসদ তথা দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের সম্পত্তির বিষয়ে যে হিসেব ও তথ্য হাইকোর্টে জমা দিয়েছে ইডি, তা নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ বিচারপতি অমৃতা সিনহা। বিষয়টি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে সোমবার হাইকোর্টে বিচারপতি সিনহা জানিয়েছেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পত্তির যে হিসেব দেওয়া হয়েছে তা অসম্পূর্ণ। একই সঙ্গে এদিন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা লতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পত্তির হিসেবও ইডি'কে জমা দিতে বলেছে আদালত ৷ অভিষেকের সংস্থার অন্যতম ডিরেক্টর পদে ছিলেন লতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় ৷
অভিষেক একজন সাংসদ এবং একটি কোম্পানির সিইও হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সম্পত্তির হিসেবে মাত্র তিনটি জীবন বিমা পলিসি ছাড়া আর কোনও কিছুর উল্লেখ নেই কেন, সেই প্রশ্ন এদিন তুলেছেন বিচারপতি সিনহা ৷
ইডির আধিকারিক মিথিলেশ কুমার মিশ্র তদন্তের জন্য আরও আধিকারিকের প্রয়োজনের কথা এদিন জানিয়েছেন আদালতে । এই বিষয়ে ইডি'র আইনজীবী পরের শুনানিতে বিস্তারিত জানাবেন। তদন্তের প্রায় আট মাস হয়ে গেলেও এখনও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি বলে মনে করছে আদালত। নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত এই মামলার আগামী 29 সেপ্টেম্বর ফের শুনানি।
জানা গিয়েছে, ইডি'র রিপোর্টে অভিষেকের সংস্থার সম্পত্তির মূল্য সম্পর্কে কিছু জানানো হয়নি । সংস্থার মূল কাজ কী, তাও স্পষ্ট নয় ৷ এখনও কোম্পানিটির ডিরেক্টরদের আর্থিক লেনদেন সম্পর্কে তদন্ত করা বাকি ইডি'র ৷ এদিন বিচারপতি অমৃতা সিনহা নির্দেশ দেন অভিষেক ছাড়াও সংস্থার ডিরেক্টরদের নাম, ঠিকানা, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ডিটেলস এবং সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র 2016 এর মার্চ মাসে অবসর নেওয়ার পর কারা প্রতিদিনের কাজকর্ম দেখাশোনা করত জানাতে হবে ইডিকে ৷ এছাড়াও হাইকোর্টের নির্দেশ, ইডিকে ওই কোম্পানির কর্মচারীদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানাতে হবে আদালতে । কোম্পানিটি সমস্তরকম আইনি দিক মেনে চলত কি না, তা দেখতে হবে ৷
ইডির আধিকারিক মিথিলেশ কুমার মিশ্র ও বিচারপতি অমৃতা সিনহার মধ্যে সওয়াল-জবাব নিম্নরূপ-
বিচারপতি - আদালত নির্দেশ দেওয়ার আগে আপনাদের কাছে কোনও নথি ছিল না ?
ইডি- 21 অগস্ট আমরা কোম্পানির সম্পত্তি অ্যাটাচ করি ।
বিচারপতি - আপনারা জানতেন না কোম্পানির সন্দেহজনক লেনদেন আছে ?
এরপর ইডির আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বিচারপতি বলেন, "আপনারা কোম্পানির জমির বর্ণনা দিয়েছেন । কিন্তু তার বিস্তারিত কোথায় ? আপনারা তদন্তকারী অফিসার, আপনাদের উপর ভরসা আছে । কিন্তু এই ব্যক্তিদের সম্পত্তির তালিকা আপনাদের কাছে থাকা কি উচিত নয় ? 2023 এর মে মাসে যে ব্যাক্তিকে (সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র) গ্রেফতার করা হয়েছে, তার সম্পত্তি এটাচ করতে জুন মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় ? লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের ফ্ল্যাটের বিস্তারিত তথ্য নেই কেন? শুধু জমির বর্ণনা রয়েছে কেন ?"
বিচারপতি - আদালত নির্দেশ দিয়েছে কোম্পানির সম্পূর্ণ সম্পত্তির তালিকা দিতে ।
ইডি- আমরা তদন্ত করছি এই ব্যাপারে । ধীরে ধীরে সমস্ত তথ্য দিতে পারব আশা করি ।
বিচারপতি - কোম্পানির ভিতরে ফ্যাক্টরি সম্পর্কে জানানো হয়েছে, সেখানে চারটে গাড়ি রয়েছে । দুটি আলাদা গাড়ি রয়েছে জিনিসপত্র বহন করার জন্য । একটা সাইকেল রয়েছে । সেটা কী ধরনের তা স্পষ্ট নয় । সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র 2012 সাল থেকে 2016 সাল পর্যন্ত চাকরি করেছেন ওই কোম্পানিতে । তার সমস্ত ডিটেল নেই কেন ? আপনারা কী ভাবে তদন্ত করছেন? আপনারা কী চাইছেন ভালোভাবে তদন্ত করতে নাকি যেমন তেমন তদন্ত করলেই হবে ? আপনারা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ? আপনাদের তদন্ত নিয়ে আমার মনে সন্দেহ আছে ।
বিচারপতি ইডির আধিকারিককে - ছ'জন ডিরেক্টর ওই কোম্পানির । আপনারা তাদের সবাইকে জিজ্ঞসাবাদ করেছেন ? জীবন বিমার সার্টিফিকেট কই ? তাদের সন্দেহজনক লেনদেন আছে যখন বলছেল, তখন আপনাদের জিজ্ঞসাবাদ করা উচিত ছিল ! অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে জানানো হয়েছে তার শুধুমাত্র তিনটি বিমা পলিসি আছে । এই তথ্য সঠিক ?
ইডি- এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে এই তথ্যই আছে ।
বিচারপতি - আপনারা কি পোস্ট অফিস ? আপনাদের কেউ তথ্য দেবে আর আপনারা সেটা জানাবেন ? আমি সকড, একজন মেম্বার অফ পার্লামেন্টের মাত্র তিনটি পলিসি ? লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস কোম্পানিতে কী হতো ? সেই তথ্য কই ? সেখানে আলপিন থেকে হাতি পর্যন্ত সবই হতো, আপনাদের কাছে সেই তথ্য কই ? ফ্যাক্টরিতে সেখানে কি হতো ?
ইডি- পানীয় জলের ফ্যাক্টরি । সেখানে জল ভর্তি বোতল রয়েছে ।
বিচারপতি - কোম্পানিতে মূলত কি হতো ? আপনারা যাচাই করে দেখেছেন ? আপনাদের তদন্ত কখনও শেষ হবে বলে তো আমার মনেই হচ্ছে না ।
এরপর সিটের প্রধান অশ্বিন শেনভি বিচারপতিকে জানান, আদালত যে সমস্ত প্রশ্ন করেছে তিনি তার নোট নিয়েছেন ।
বিচারপতি - কিন্তু কীভাবে আপনারা তদন্তের শেষে পৌঁছাতে পারবেন ? শুধু নোট নিলেই হবে ?
অশ্বিন শেনভি- সিবিআইতে আমদের একটু কর্মী ঘাটতি আছে । আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি ।
বিচারপতি - আপনাদেরকে প্রভুত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে । আপনারা সার্চ করতে পারেন । বাজেয়াপ্ত করতে পারেন । এখানে যখন সন্দেহজনক লেনদেন আছে, আপনারা আপনাদের ক্ষমতার ব্যাবহার কি পরিপূর্ণ ভাবে করেছেন ?
এরপর বিচারপতি সিনহা শেনভির কাছে জানতে চান, আর কারও সহযোগিতা কি প্রয়োজন আছে ?
অশ্বিন শেনভি- আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে ফাইনান্সিল ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে ।
বিচারপতি - 188এ হরিশ মুখার্জি রোডের সম্পত্তি কার ? আপনারা জানেন ? সিনেমা জগতের মাত্র একজনের নাম আপনারা দিয়েছেন । আমি তো অনেকের নাম শুনছিলাম । সেসব কোথায় ? মাত্র একজন? আর কারও যোগ নেই ?
ইডি- আমরা এখনও পর্যন্ত অর্পিতা মুখোপাধ্যায় আর একজনের নাম পেয়েছি ।
বিচারপতি - যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের কথা জানতে চাইছি না ।
বিকাশ ভট্টাচার্য - ইডির এক আধিকারিক নিখিলেশ কুমার মিশ্র (এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর) আগেই চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন হরিশ মুখার্জি রোডের সম্পত্তি অভিষেকের । কিন্তু এখনও আদালতে বলা হচ্ছে এই সম্পত্তি কার তারা সেটা এখনো জানেন না ।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার বিচারপতি সিনহার বেঞ্চে অভিষেকের কোম্পানির সম্পত্তির হিসাব দিয়েছিল ইডি । কিন্তু সেই রিপোর্ট পড়ে ক্ষুব্ধ বিচারপতি এদিন ফের শুনানি করেন এই মামলার ।