ETV Bharat / state

নীলবাড়ি দখলের লড়াইয়ে শুরু থেকেই এগিয়ে ছিল তৃণমূল - 200-র বেশি আসনে জিতল তৃণমূল কংগ্রেস

লোকসভার নির্বাচন আর বিধানসভার নির্বাচন কখনোই এক জিনিস নয় । রাজনীতির সমীকরণ সবসময় যে পাটিগণিতের হিসেবে হয় না, তা হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন দিলীপ-কৈলাসরা । অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তোলাবাজি থেকে শুরু করে একাধিক অভিযোগ এনেছে বিজেপি । কিন্তু এই অভিযোগগুলিকে কোনওদিনই প্রমাণ করতে পারেনি । এমনই আরও অনেকগুলি কারণ রয়েছে যেগুলি তৃণমূলকে বিজেপির থেকে এগিয়ে রেখেছিল । আলোচনায় বিশ্বজিৎ সিংহ ।

West Bengal Assembly Election Result 2021
ছবি
author img

By

Published : May 2, 2021, 10:22 PM IST

32 দিনের খেলার পর অবশেষে একপাক্ষিক জয় ৷ বিপুল মার্জিনে জিতে তৃতীয়বার বাংলার মসনদে তৃণমূল কংগ্রেস ৷ অনেক অভিযোগ, আক্রমণ, নেতার দলবদলের পরও গেরুয়া শিবির ভয়ঙ্করভাবে বাংলার মাটিতে গেরুয়া আবির ছড়াতে পারল না ৷ গত লোকসভা ভোটের পর যেভাবে গোটা রাজ্য বিজেপির রকেটগতির উত্থান দেখেছিল, তাতে অনেকেই মনে করেছিলেন বিজেপি সরকার গড়তে চলেছে । কিন্তু বাস্তব পুরো আলাদা । দু'শোর বেশি আসন পেয়ে ফের একবার সরকার গড়ার পথে তৃণমূল কংগ্রেস । কোন কোন জায়গায় বিজেপির থেকে এগিয়ে ছিল তৃণমূল ?

বাংলা চরিত্রটাই বুঝতে ভুল করে ফেলেছে বিজেপি । বাঙালির রাজনৈতিক চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে, তাঁরা সবসময়ই চেয়ে এসেছেন একজন নায়ককে । বা নায়িকাকে । কিন্তু একুশের বঙ্গভোটের মহারণে বিজেপির সেভাবে কোনও নায়ক বা নায়িকা ছিলেন না । আর এখানেই খেলা শুরুর আগেই কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল পদ্মশিবির । এমন কেউ ছিলেন না, যাঁকে দেখে মানুষ ভোট দেবেন ।

খামতি আরও ছিল । নীলবাড়ি দখলের লড়াইয়ে বিজেপির প্রচারে যাঁদের সামনের সারিতে দেখা গিয়েছিল, তাঁদের সিংহভাগ হিন্দিভাষী । কলকাতার মানুষরা হিন্দিটা বোঝেন মানে এটা ধরে নেওয়া ভুল যে গোটা বাংলার মানুষ হিন্দি বোঝেন । বিজেপির হিন্দিভাষী তাবড় তাবড় নেতারা কী বলতে চেয়েছেন সেটাই গ্রামাঞ্চলের মানুষরা বুঝতে পারেননি । ভাষাগত ব্যবধানটা এখানে একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে । সম্ভবত সেই কারণেই এবারের ভোটে সেভাবে মানুষের মনে দাগ কাটতে পারল না বিজেপি ।

আরও পড়ুন : গণি-মিথের অবসান, তৃণমূল ও বিজেপিতেই ভরসা রাখল মালদা

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, তবে ইন্দিরা গান্ধির ক্ষেত্রে কী হয়েছিল ? তিনি কি বাংলায় কথা বলতেন ? তিনিও তো হিন্দিভাষীই ছিলেন । তবে ইন্দিরা গান্ধির ক্ষেত্রে একটি পশ্চাতপট ছিল । ইন্দিরা গান্ধি সেই সময় তাঁদের কাছে খুব পরিচিত একটি মুখ ছিলেন । একটি পরিচিত চরিত্র ছিলেন তিনি ।

এক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহকে লোকে চেনেন বটে । কিন্তু বঙ্গভোটের আগে জে পি নাড্ডার বাংলায় কতটা পরিচিতি ছিল, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে । বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বিজেপি যে নেতাদের প্রচারে নিয়ে এসেছিল তাঁদের প্রত্যেকেই হিন্দিভাষী । বাংলার বিশেষ করে গ্রামবাংলার মানুষের কাছে তাঁদের কোনও পরিচিতি নেই ।

এখন বলা যেতেই পারে, মিঠুন চক্রবর্তী তো ছিলেন । নায়কও বটে । এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, মিঠুন চক্রবর্তী কখনোই অমিতাভ বচ্চন নন । বিশ বছর আগে তাঁর যে ক্যারিশ্মা ছিল, তা আজ আর নেই । তাছাড়া মিঠুন কোনওদিনই গ্রামাঞ্চলে সেভাবে ঢুকতে পারেননি । শহর থেকে মফঃস্বল পর্যন্তই মিঠুনের ক্রেজ়টা ছিল । তার উপর তিনি এখন বৃদ্ধ । সেই প্রভাবটা আজ অনেকটাই ম্লান ।

আরও পড়ুন : কাজে এল না সিদ্দিকি টনিক, এই প্রথম বিধানসভা বাম-কংগ্রেসহীন

লোকসভার নির্বাচন আর বিধানসভার নির্বাচন কখনোই এক জিনিস নয় । রাজনীতির সমীকরণ সবসময় যে পাটিগণিতের হিসেব হয় না, তা হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন দিলীপ-কৈলাসরা । অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তোলাবাজি থেকে শুরু করে একাধিক অভিযোগ এনেছে বিজেপি । কিন্তু এই অভিযোগগুলিকে কোনওদিনই প্রমাণ করতে পারেনি । অভিষেকের স্ত্রী রুজিরাকে সিবিআই বাড়ি গিয়ে জেরা করে এসেছে । একাধিকবার জেরা করেছে । কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও অকাট্য প্রমাণ দেখাতে পারেনি । বিষয়টি উল্টে এমনভাবে মানুষের সামনে গিয়েছে, যেন অভিষেককে হেনস্থা করা হচ্ছে । সেই কারণেই নারদা-সারদা কাণ্ডে নাম জড়ালেও একাধিক তৃণমূলের নেতা সসম্মানে নির্বাচনী বৈতরণী পার করে গিয়েছেন ।

কারণ আরও রয়েছে । প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু জায়গায় সমস্যা রয়েছে বিজেপি । লকেট চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে স্বপন দাশগুপ্ত, একাধিক সাংসদকে নিয়ে এসে প্রার্থী করা হল বিধানসভায় । বাবুলকেই বা কেন টালিগঞ্জের প্রার্থী করা হল তা নিয়েও বেশ ধোঁয়াশা রয়েছে । তাঁর আদি বাড়ি হুগলিতে । কিন্তু প্রার্থী করা হল টালিগঞ্জ থেকে । শুধুমাত্র তিনি একসময় টালিগঞ্জে গান গাইতেন বলেই কি তাঁকে সেখানকার প্রার্থী করে দেওয়া হল ? টালিগঞ্জের শিল্পীদের সকলে কি টালিগঞ্জে থাকেন ? সেখানে তো বেশিরভাগই বস্তি এলাকা । অরূপ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও টালিগঞ্জের ওই মানুষগুলো সময়ে-অসময়ে তাঁকেই পাশে পান । ইভিএমেও তার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে ।

বিজেপি তিন অঙ্কের নীচে আটকে যাওয়ার আরও একটি বড় কারণ হল, এনআরসি-সিএএ । নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে যেমন ভীত রাজ্যের মুসলিম মানুষরা, সেরকমই ভীত বর্ণহিন্দুরা । আর এখানে মমতা বারবার আশ্বাস দিয়ে এসেছেন, তিনি রাজ্য এনআরসি-সিএএ হতে দেবেন না । সেটা মানুষের মনের ভিতরে গেঁথে দিয়েছেন । এই সব মিলিয়েই মানুষের রায় গিয়েছে জোড়াফুলের পক্ষে ।

(লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক)

32 দিনের খেলার পর অবশেষে একপাক্ষিক জয় ৷ বিপুল মার্জিনে জিতে তৃতীয়বার বাংলার মসনদে তৃণমূল কংগ্রেস ৷ অনেক অভিযোগ, আক্রমণ, নেতার দলবদলের পরও গেরুয়া শিবির ভয়ঙ্করভাবে বাংলার মাটিতে গেরুয়া আবির ছড়াতে পারল না ৷ গত লোকসভা ভোটের পর যেভাবে গোটা রাজ্য বিজেপির রকেটগতির উত্থান দেখেছিল, তাতে অনেকেই মনে করেছিলেন বিজেপি সরকার গড়তে চলেছে । কিন্তু বাস্তব পুরো আলাদা । দু'শোর বেশি আসন পেয়ে ফের একবার সরকার গড়ার পথে তৃণমূল কংগ্রেস । কোন কোন জায়গায় বিজেপির থেকে এগিয়ে ছিল তৃণমূল ?

বাংলা চরিত্রটাই বুঝতে ভুল করে ফেলেছে বিজেপি । বাঙালির রাজনৈতিক চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে, তাঁরা সবসময়ই চেয়ে এসেছেন একজন নায়ককে । বা নায়িকাকে । কিন্তু একুশের বঙ্গভোটের মহারণে বিজেপির সেভাবে কোনও নায়ক বা নায়িকা ছিলেন না । আর এখানেই খেলা শুরুর আগেই কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল পদ্মশিবির । এমন কেউ ছিলেন না, যাঁকে দেখে মানুষ ভোট দেবেন ।

খামতি আরও ছিল । নীলবাড়ি দখলের লড়াইয়ে বিজেপির প্রচারে যাঁদের সামনের সারিতে দেখা গিয়েছিল, তাঁদের সিংহভাগ হিন্দিভাষী । কলকাতার মানুষরা হিন্দিটা বোঝেন মানে এটা ধরে নেওয়া ভুল যে গোটা বাংলার মানুষ হিন্দি বোঝেন । বিজেপির হিন্দিভাষী তাবড় তাবড় নেতারা কী বলতে চেয়েছেন সেটাই গ্রামাঞ্চলের মানুষরা বুঝতে পারেননি । ভাষাগত ব্যবধানটা এখানে একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে । সম্ভবত সেই কারণেই এবারের ভোটে সেভাবে মানুষের মনে দাগ কাটতে পারল না বিজেপি ।

আরও পড়ুন : গণি-মিথের অবসান, তৃণমূল ও বিজেপিতেই ভরসা রাখল মালদা

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, তবে ইন্দিরা গান্ধির ক্ষেত্রে কী হয়েছিল ? তিনি কি বাংলায় কথা বলতেন ? তিনিও তো হিন্দিভাষীই ছিলেন । তবে ইন্দিরা গান্ধির ক্ষেত্রে একটি পশ্চাতপট ছিল । ইন্দিরা গান্ধি সেই সময় তাঁদের কাছে খুব পরিচিত একটি মুখ ছিলেন । একটি পরিচিত চরিত্র ছিলেন তিনি ।

এক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহকে লোকে চেনেন বটে । কিন্তু বঙ্গভোটের আগে জে পি নাড্ডার বাংলায় কতটা পরিচিতি ছিল, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে । বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বিজেপি যে নেতাদের প্রচারে নিয়ে এসেছিল তাঁদের প্রত্যেকেই হিন্দিভাষী । বাংলার বিশেষ করে গ্রামবাংলার মানুষের কাছে তাঁদের কোনও পরিচিতি নেই ।

এখন বলা যেতেই পারে, মিঠুন চক্রবর্তী তো ছিলেন । নায়কও বটে । এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, মিঠুন চক্রবর্তী কখনোই অমিতাভ বচ্চন নন । বিশ বছর আগে তাঁর যে ক্যারিশ্মা ছিল, তা আজ আর নেই । তাছাড়া মিঠুন কোনওদিনই গ্রামাঞ্চলে সেভাবে ঢুকতে পারেননি । শহর থেকে মফঃস্বল পর্যন্তই মিঠুনের ক্রেজ়টা ছিল । তার উপর তিনি এখন বৃদ্ধ । সেই প্রভাবটা আজ অনেকটাই ম্লান ।

আরও পড়ুন : কাজে এল না সিদ্দিকি টনিক, এই প্রথম বিধানসভা বাম-কংগ্রেসহীন

লোকসভার নির্বাচন আর বিধানসভার নির্বাচন কখনোই এক জিনিস নয় । রাজনীতির সমীকরণ সবসময় যে পাটিগণিতের হিসেব হয় না, তা হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন দিলীপ-কৈলাসরা । অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তোলাবাজি থেকে শুরু করে একাধিক অভিযোগ এনেছে বিজেপি । কিন্তু এই অভিযোগগুলিকে কোনওদিনই প্রমাণ করতে পারেনি । অভিষেকের স্ত্রী রুজিরাকে সিবিআই বাড়ি গিয়ে জেরা করে এসেছে । একাধিকবার জেরা করেছে । কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও অকাট্য প্রমাণ দেখাতে পারেনি । বিষয়টি উল্টে এমনভাবে মানুষের সামনে গিয়েছে, যেন অভিষেককে হেনস্থা করা হচ্ছে । সেই কারণেই নারদা-সারদা কাণ্ডে নাম জড়ালেও একাধিক তৃণমূলের নেতা সসম্মানে নির্বাচনী বৈতরণী পার করে গিয়েছেন ।

কারণ আরও রয়েছে । প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু জায়গায় সমস্যা রয়েছে বিজেপি । লকেট চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে স্বপন দাশগুপ্ত, একাধিক সাংসদকে নিয়ে এসে প্রার্থী করা হল বিধানসভায় । বাবুলকেই বা কেন টালিগঞ্জের প্রার্থী করা হল তা নিয়েও বেশ ধোঁয়াশা রয়েছে । তাঁর আদি বাড়ি হুগলিতে । কিন্তু প্রার্থী করা হল টালিগঞ্জ থেকে । শুধুমাত্র তিনি একসময় টালিগঞ্জে গান গাইতেন বলেই কি তাঁকে সেখানকার প্রার্থী করে দেওয়া হল ? টালিগঞ্জের শিল্পীদের সকলে কি টালিগঞ্জে থাকেন ? সেখানে তো বেশিরভাগই বস্তি এলাকা । অরূপ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও টালিগঞ্জের ওই মানুষগুলো সময়ে-অসময়ে তাঁকেই পাশে পান । ইভিএমেও তার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে ।

বিজেপি তিন অঙ্কের নীচে আটকে যাওয়ার আরও একটি বড় কারণ হল, এনআরসি-সিএএ । নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে যেমন ভীত রাজ্যের মুসলিম মানুষরা, সেরকমই ভীত বর্ণহিন্দুরা । আর এখানে মমতা বারবার আশ্বাস দিয়ে এসেছেন, তিনি রাজ্য এনআরসি-সিএএ হতে দেবেন না । সেটা মানুষের মনের ভিতরে গেঁথে দিয়েছেন । এই সব মিলিয়েই মানুষের রায় গিয়েছে জোড়াফুলের পক্ষে ।

(লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক)

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.