শিলিগুড়ি ও কলকাতা, 20 জুন : বিধানসভা ভোটে কার্যত ভরাডুবি হয়েছে বিজেপির । ঢাক-ঢোল পিটিয়ে যে দু'শো পারের হুঙ্কার দিলীপ ঘোষ, কৈলাস বিজয়বর্গীয়রা দিয়েছিলেন, তার ধারেকাছে ঘেঁষা তো দূরে থাক... একশোর গণ্ডিও পেরোতে পারেননি । তবে দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় উত্তরবঙ্গের বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে ভাল ফল করেছে গেরুয়া শিবির । আসনও জিতেছে বেশি । আর এর মধ্যেই একটি রব উঠতে শুরু করেছে বিজেপির একাংশের মধ্যে । দাবি, আরও একটা বঙ্গভঙ্গের । পশ্চিমবঙ্গকে ভেঙে দু'টুকরো করে দেওয়ার দাবি উঠছে । উত্তরবঙ্গকে আলাদা করে ভেঙে পৃথক বিজেপি শাসিত রাজ্য অথবা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে দেওয়া হোক । আর দক্ষিণবঙ্গ থাকুক তৃণমূল শাসিত রাজ্য হিসেবে ।
আর এই মুহূর্তে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক যে তিক্ততার জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে, তাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু যথেষ্টই বিরক্ত এই ধরনের দাবি ওঠার পর থেকে । কেন্দ্রের একটা জুজু সবসময় রাজ্যের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে । আর বিশেষ করে বিধানসভা ভোটে বিজেপির ভরাডুবির পর থেকেই আরও তিক্ত হয়েছে সম্পর্ক । তাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয়বারের জন্য সরকার গড়েও বাংলা ভাগের এই গুঞ্জন যথেষ্টই চিন্তায় রাখছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে । প্রতিবাদ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে মেজাজও হারাচ্ছেন । তাই বলতে শোনা যাচ্ছে, "ভোটে হেরেও শিক্ষা হয়নি, এখন বাংলা ভাঙতে চাইছে" । আবার কখনও বলছেন, "পশ্চিমবঙ্গ ইজ় পশ্চিমবঙ্গ । উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গের পার্থক্য কী ? কোনওরকম ডিভাইড অ্যান্ড রুল আমরা করতে দেব না । বিজেপি চাইলেই জলপাইগুড়ি বা আলিপুরদুয়ার বিক্রি করে দিতে পারে না । অত সোজা নয় । রাজ্যের অনুমতি দরকার এসবের জন্য ।"
এদিকে আলিপুরদুয়ারের বিজেপি সাংসদ জন বারলা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন, মুখ্যমন্ত্রী নাকি তাঁদের কথা শোনেন না । ভোট পরবর্তী হিংসা অব্যাহত । বহু বিজেপি কর্মী ও সমর্থক এখনও ঘরছাড়া । পুলিশ সুপার কিংবা জেলাশাসকও নাকি তাঁদের কথা শুনছেন না । তাই, সাধারণ মানুষ যাতে শান্তিতে থাকতে পারেন, সেই জন্যই তিনি আলাদা রাজ্যের দাবি তুলছেন ।
আরও পড়ুন : প্রধানমন্ত্রী-জেলাশাসকদের বৈঠক হাইজ্যাক করেছেন মমতা, পালটা সরব শুভেন্দু
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে... পশ্চিমবঙ্গকে ভেঙে কি দু'টুকরো করতে পারে নরেন্দ্র মোদির সরকার ?
যদি এককথায় উত্তর চান, তাহলে... হ্যাঁ । কেন্দ্রের সেই অধিকার আছে । বিজেপির থেকে এমনিতেই অভিযোগ উঠছে বাংলায় ভোট পরবর্তী হিংসার । 356 ধারা জারি করার কথা বারবার বলছে বঙ্গ বিজেপি । রাজ্যপালও বাংলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে দু'দিন অন্তর টুইট করছেন । এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্র যদি মনে করে, রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারে । তারপর রাজ্যে সেনা নামিয়ে বলতেই পারে... রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে হলে বাংলাকে ভাগ করাটা দরকার ।
অথবা দুই পক্ষের কে কী বলতে চাইছে... মানে যাঁরা পৃথক রাজ্য চাইছেন বা যাঁরা চাইছেন না... উভয় পক্ষের মতামত কেন্দ্র শুনতে পারে । তারপর সেই সংক্রান্ত প্রস্তাব আনতে পারে সংসদে । বলতে পারে, যাঁরা পৃথক রাজ্য চাইছেন, তাঁদের দাবি কেন্দ্রের কাছে ন্যায্য মনে হয়েছে । তারপর সেই প্রস্তাব সংসদে পাশ করিয়ে রাজ্যটাকে দু'ভাগ করতেই পারে কেন্দ্র । তবে বিষয়টিকে যতটা সহজ মনে হচ্ছে তার থেকে আরও অনেক বেশি জটিল ।
আরও পড়ুন : বিহার ভোটে তারকা প্রচারকদের চার্টার্ড বিমানে 24 কোটি টাকা খরচ বিজেপির
একটি রাজ্যকে ভাঙার আগে যে যে দিকগুলি খতিয়ে দেখা হয়...
- ইতিমধ্যেই একাধিক রাজ্য ভাগ হয়েছে । মধ্যপ্রদেশ ভেঙে ছত্তিশগড় । বিহার ভেঙে ঝাড়খণ্ড । অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে তেলাঙ্গানা । পঞ্জাব ভেঙে হরিয়ানা । উত্তরপ্রদেশ ভেঙে উত্তরাখণ্ড । এই রাজ্যগুলি ভাগাভাগির সময় মূলত যে বিষয়গুলির উপর নজর দেওয়া হয়েছে, সেগুলির মধ্যে রয়েছে -- প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক ।
- প্রথমে আসা যাক প্রশাসনিক বিষয়ে । অর্থাৎ, এমন দাবি উঠতেই পারে, রাজ্যটি এতটাই বড় যে... কোনও একটি এলাকা বঞ্চিত হচ্ছে প্রশাসনিক সুযোগ সুবিধা থেকে । রাজ্য সরকার গোটা আয়তনগত সমস্যার কারণে রাজ্যটাকে ঠিকভাবে চালাতে পারছে না ।
- যে রাজ্যটির ভাগাভাগির কথা হয়েছে, সেই সংশ্লিষ্ট রাজ্যের কোনও একটি অংশ এমন দাবি করতেই পারে যে সেই এলাকায় কোনও উন্নয়ন হয়নি । বাকি রাজ্যের তুলনায় সেই এলাকা আর্থিকভাবে বঞ্চিত হয়েছে । সেদিক থেকে দাবি উঠতেই পারে, ওই এলাকাটিকে আলাদা রাজ্য বা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল করে দেওয়ার জন্য ।
- একইরকমভাবে কোনও রাজ্যের দু'টি এলাকার সাংস্কৃতিক পার্থক্যের থেকেও রাজ্যভাগের দাবি উঠতে পারে । অথবা কোনও একটি এলাকা যদি অতীতে পৃথক রাজ্য কিংবা প্রিন্সলি এস্টেট থাকে, তাহলে সেই এলাকা আবার তাদের অতীতের মর্যাদা ফিরে পাওয়ার দাবি করতে পারে ।
মাটিগাড়া নকশালবাড়ির বিজেপি বিধায়ক আনন্দময় বর্মন বলেন, "প্রথম থেকে উত্তরবঙ্গ বঞ্চিত রয়েছে । উন্নয়ন হোক বা পরিষেবা । উত্তরবঙ্গবাসীরা কোনও দিনই রাজ্য সরকারের সহযোগিতা পাননি । উত্তরকন্যা-র মতো শাখা সচিবালয় গঠন করা হলেও সেখানে মন্ত্রিসভার কোনও বৈঠক হয় না । উন্নয়নের দিক থেকেও রাজ্য সরকারের নজরে উত্তরবঙ্গ অনেকটাই বঞ্চিত । সে কারণেই উত্তরবঙ্গকে নিয়ে আলাদা রাজ্য করার দাবি রয়েছে অনেকদিন ধরে।"
আরও পড়ুন : পৌরভোটের আগে নীল নকশা তৈরি গেরুয়া শিবিরে
তৃণমূল কংগ্রেসের উত্তরবঙ্গের কোর কমিটির চেয়ারম্যান তথা শিলিগুড়ি পুরনিগমের প্রশাসক বোর্ডের চেয়ারম্যান গৌতম দেব বলছেন, "বিধানসভা নির্বাচনের আগে বাংলাকে দখল করতে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তারপরও জিততে না পারায় তাঁরা এখন হতাশ । উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলায় ভাল ফলাফল করায় উত্তরবঙ্গের শান্তিকে তাঁরা নষ্ট করতে চাইছেন । এসবই বিজেপির গেম প্ল্যান । তবে বাংলার মানুষ এর প্রতিবাদ করবেই ।"
যখনই কোনও রাজ্য ভাঙার দিকে এগোনো হয়েছে, তখনই প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক এই তত্ত্বগুলির মধ্যে কোনও একটি সামনে এসেছে । রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কথায়, অনেকটা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এই তত্ত্বগুলিকে । আসলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু না কিছু রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছিল । কিন্তু সব দাবি সবসময় পূরণ হয়নি । কখনও গুজরাত থেকে আলাদা করে পৃথক সৌরাষ্ট্র গঠনের দাবি উঠেছে । কখনও কর্নাটক থেকে কুর্গকে আলাদা করার দাবি উঠেছে । মাঝে তো উত্তরপ্রদেশকে চারভাগ করে দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল ।
আমাদের রাজ্যেও এমন উদাহরণ রয়েছে । সিপিএম জমানার শেষ দিকে প্রায়ই খবরের শিরোনামে উঠে আসত পাহাড় জ্বলছে । দাবি উঠেছিল পৃথক গোর্খাল্যান্ডের । তারও আগে পৃথক কামতাপুরের দাবি উঠেছিল । গ্রেটার কোচবিহারকে একটি পৃথক রাজ্য করার দাবি উঠেছিল । দাবিগুলির প্রতিটি রাজনৈতিক দলই কোনও না কোনও সময়ে নিজেদের স্বার্থে এই ইস্যুগুলিকে ব্যবহার করেছে । মূলত ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে ব্যবহার হয়েছে ।
আরও পড়ুন : কোন পথে ত্রিপুরায় মমতার সমীকরণ ?
যদিও গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি বিনয় তামাং বিজেপির এই ধরনের দাবির সঙ্গে একেবারেই একমত নন । তাঁর বক্তব্য, "বিজেপির দাবির সঙ্গে আমাদের কোনও লেনদেন নেই ।" বিজেপির এই ধরনের দাবির বিরোধিতা করেছেন দার্জিলিং জেলা সিপিএমের সম্পাদক জীবেশ সরকারও । বলছেন, "বিজেপি এখন যে পৃথক রাজ্যের দাবি করছে আমরা তার বিরোধিতা করছি । তবে এই পৃথক রাজ্যের দাবির জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে দায় নিতে হবে । গোর্খাল্যান্ডের চুক্তির সময় মুখ্যমন্ত্রী পৃথক রাজ্যের দাবিতে অস্বীকার করেননি । এছাড়াও কেপিপি এবং গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার মতো বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, যারা পৃথক রাজ্যের দাবি করে এসেছিল, মুখ্যমন্ত্রী নিজে তাদেরকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছেন । আমরা চাই বাংলা অটুট থাকুক ।"
মুখে বলা আর কাজে করার মধ্যে জটিলতা অনেক...
বিজেপির একাংশ যতই উত্তরবঙ্গকে ভাগাভাগি করার কথা বলুক না কেন, এখানে বেশ কিছু বাধা রয়েছে । প্রথমত পশ্চিমবঙ্গ কখনোই খুব একটা বড় রাজ্য নয় । পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেক বড় রাজ্য ভেঙে ছোট করা হয়নি । তাহলে শুধু পশ্চিমবঙ্গকেই কেন ভাঙা হবে ? এই সাধারণ প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে । আর তাছাড়া রাজ্য রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা অনেকেই বলছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই বা এত সহজে ছেড়ে দেবেন কেন ? এমন কোনও সম্ভাবনা তৈরি হলে কড়া প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । আর সেক্ষেত্রে রাজ্যে হিংসার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে । তার উপর বাঙালির অখণ্ড বঙ্গের সেন্টিমেন্টটাও মমতা পেয়ে যাবেন । এমনটা হলে আখেড়ে বিজেপিরই ক্ষতি ।
রাজ্য রাজনীতিকে যাঁরা খুব কাছে থেকে দেখেছেন, তাঁদের মতে, আরও একটি বড় বাধা থাকছে কেন্দ্রের সামনে । কেন্দ্র কখনও এমনটা বলতে পারে না যে, উত্তরবঙ্গে আমরা বেশি আসন জিতেছি, তাই ওটা আলাদা রাজ্য করে আমাদের সরকার গঠন করা হবে । সেখানে কেন্দ্রকে বাংলা ভাগের জন্য শক্তপোক্ত কোনও একটা কারণ দেখাতে হবে । মানে ওই প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক --- এই ধরনের কোনও একটা মজবুত কারণ । কিন্তু গোর্খাল্যান্ড বা কামতাপুর বা গ্রেটার কোচবিহার... প্রতিটি ক্ষেত্রেই পৃথক পৃথক দাবিদাওয়া রয়েছে । পৃথক কারণ রয়েছে । সেই সবক'টি একসঙ্গে করতে গেলে কেউ না কেউ বঞ্চিত হবে । আর যে বা যারা বঞ্চিত হবে, সঙ্গে সঙ্গে ফোঁস করে উঠবে ।
আরও পড়ুন : মুকুলের পথে ঘরে ফিরে সুদীপ কি ত্রিপুয়ায় তৃণমূলের সুদিন ফেরাবেন ?
সুতরাং, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা মোদির সরকার বিষয়টিকে নিয়ে খুব একটা নাড়াচাড়া করবে না বলেই মনে করছেন অনেকে । কারণ এটা বুমেরাং হয়ে বিজেপির দিকে ফিরে আসার সম্ভাবনাই বেশি । তাঁদের মতে, বরং যে চাপা-উত্তেজনাটি তৈরি হয়েছে, বিজেপি এটিকে এভাবেই লালিত-পালিত করে যাবে আরও অনেকদিন ধরে । হয়ত পরের নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক বাড়াতে এটাকেই হাতিয়ার করবে । কিন্তু কোনও স্থায়ী সমাধানের দিকে হয়ত বিজেপি এগোবে না । এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ।
বঙ্গ বিজেপির হাবভাব দেখেও অন্তত তেমনটাই ইঙ্গিত মিলছে । বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ তাই কিছুটা ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে বলছেন, " বাংলাকে ভেঙে নয়, বাংলাকে এক রেখেই তৃণমূলের অপশাসনকে রুখে বাংলার উন্নয়নের জন্য আমরা লড়াই করব ।" দিলীপবাবুর বক্তব্য, বিজেপি কখনওই রাজ্য ভাগের পক্ষে নয় । তাঁর দাবি, বিজেপি বাংলাকে অভিন্ন রেখে বাংলার উন্নয়ন করতে চায় । উত্তরবঙ্গের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত । সেখানে কোনও উন্নয়নই হয়নি । তাই উত্তরবঙ্গের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা থেকে এই ধরনের আন্দোলন । আর সেই থেকেই উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার দাবি তুলছেন কেউ কেউ ।