হায়দরাবাদ : ভারত বিভিন্ন খেলায় বহু তারকার জন্ম দিয়েছে । হকি, ব্যাডমিন্টন, দাবা, বক্সিং... যাই হোক না কেন, ভারত বিশ্বমানের কম খেলোয়াড়কে দেখেনি । কিন্তু তিক্ত সত্যটা হল, যদি না ব্যক্তিটি একজন ক্রিকেটার হন, কোনও ভারতীয় ক্রীড়াতারকার খ্যাতিই 15 সেকেন্ডের বেশি স্থায়ী হয় না । দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশে IPL-এ একজন এক-ম্যাচের নায়ক যতটা খ্যাতি পান, একজন অলিম্পিক পদকবিজয়ী তা পান না । ক্রিকেট উন্মাদনার দেশ হওয়ার কারণে, ভারতের মানুষ ক্রীড়াজগতের কিছু এমন নায়ককে অবহেলা করেছে, যাঁদের আরও মনোযোগ ও প্রশংসা পাওয়া উচিত ছিল । তিন জন এমন ভারতীয় হকি-তারকাকে দেখে নেওয়া যাক, যাঁদের আরও সম্মান পাওয়া উচিত ছিল ৷
ধ্যান চাঁদ
ধ্যান সিং, যাঁকে ধ্যান চাঁদ বলেই সবাই চেনে, তিনি হলেন বিশ্বের মহানতম হকি খেলোয়াড়দের একজন । তাঁর দক্ষতা এতটাই ছিল, যে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের খেলোয়াড়রা অভিযোগ করতেন, যে ধ্যান চাঁদের হকি স্টিকে নিশ্চই কোনও আঠা লাগানো আছে, যা দিয়ে ড্রিবলিংয়ের সময় তিনি বলটাকে নিয়ন্ত্রণ করেন । বাইশ বছরের ঝকঝকে কেরিয়ারে (1926-1948) তিনি চার'শোরও বেশি আন্তর্জাতিক গোল করেছেন ৷ ইউরোপীয় খবরের কাগজগুলি তাঁকে হকির জাদুকর তকমা দিয়েছিল । 1936 সালে বার্লিনে, মিউনিখ অলিম্পিকে ভারতীয় হকি দল জার্মানিকে 8-1 গোলে হারিয়েছিল । খেলা শেষ হওয়ার পর, অ্যাডল্ফ হিটলার ধ্যান চাঁদকে আমন্ত্রণ জানান এবং তাঁকে জার্মানি আর্মি হকি টিমে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন । কিন্তু তিনি আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, "এই ভারত আমার ভারত" । তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর গোল করার নজির এবং তিনটি অলিম্পিকে (1928, 1932 ও 1936) হকিতে স্বর্ণপদকের জন্য, যখন ভারত এই খেলায় একচ্ছত্র দাপিয়ে বেড়াত । দেশকে তাঁর সবটুকু দেওয়ার পরেও, এই মহান ক্রীড়াবিদকে কখনও ভারতরত্ন সম্মান দেওয়া হয়নি । এছাড়াও, নিজের দেশ, সরকার ও হকি ফেডারেশনের অবহেলার শিকার হয়ে ধ্যান চাঁদের শেষের দিনগুলো দুঃখের মধ্যে, হয়ত তিক্ততার মধ্যেও কেটেছে । তাঁর অর্থাভাব ছিল, গ্রাস করেছিল হতাশাও । তাঁর সঙ্গে কতটা খারাপ ব্যবহার করা হয়েছিল, তা মৃত্যুর দু'মাস আগে করা একটি মন্তব্য থেকেই তাঁর মনের অবস্থা স্পষ্ট হয়ে যায় । বলেছিলেন, "যখন আমার মৃত্যু হবে, গোটা পৃথিবী কাঁদবে । কিন্তু ভারতের মানুষ আমার জন্য একফোঁটা চোখের জলও ফেলবে না । আমি ওদের চিনি ।" লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে AIIMS-এর জেনারেল ওয়ার্ডে মারা যান ধ্যান চাঁদ । দিনটা ছিল 3 ডিসেম্বর, 1979 ।
রূপ সিং
কিংবদন্তি ধ্যানচাঁদের ছোট ভাই রূপ সিং ৷ দাদার মতোই নজরকাড়া এবং সম্মোহক হকি খেলতেন । 1908 সালে জন্ম নেওয়া রূপ সিং ইনসাইড ফরওয়ার্ড পজ়িশনে খেলতেন ৷ তিনি দু'টি অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন ৷ 1932 ও 1936 । তিনি ধ্যান চাঁদের ছায়ায় এতটাই ঢাকা পড়ে গেছেন, যে 1932 সালের লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে দাদার থেকে বেশি গোল করেও তিনি ইতিহাসের পাতায় প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছেন । কিন্তু এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার ফলে রূপ সিংয়ের দীর্ঘ ও সমৃদ্ধিময় হকি কেরিয়ার গড়ে ওঠেনি ৷ তিনি মাসে 148 টাকার পেনশনে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন এবং দারিদ্রের মধ্যেই বাকি জীবন কাটান । 1977 সালে রূপ সিং প্রয়াত হন । বর্তমানে তাঁর স্বীকৃতি সীমাবদ্ধ রয়েছে ক্যাপ্টেন রূপ সিং স্টেডিয়ামের মধ্যেই, যা ১৯৭৮ সালে তৈরি হয়েছিল তাঁর শহর গোয়ালিয়রে । এই স্টেডিয়াম প্রথমে হকি স্টেডিয়াম হিসেবে তৈরি হলেও, এক দশক পরে সেটা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বদলে যায় ।
ধনরাজ পিল্লাই
যদি হকি ক্রিকেট হত, দুর্ভাগ্যজনকভাবে যা হয়নি, তাহলে ধনরাজ পিল্লাই বিরাট কোহলির সমান মর্যাদা পেতেন । ধনরাজ মাঠে কোহলির মতোই আগ্রাসী ছিলেন, এবং যেভাবে তিনি ভারতীয় হকি দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেটা কোহলি বর্তমানে ভারতীয় দলকে যেভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তার থেকে তেমন কিছু আলাদা নয় । ধনরাজ ছিলেন এমন একজন, যিনি সবসময় মনের কথা স্পষ্টভাবে বলতেন । তিনি সমালোচনার কেন্দ্র হতে পারেন, কিন্তু মাঠে তিনি ছিলেন একজন জাদুকর । পিল্লাই ছিলেন একজন সহজাত নেতা ৷ কোহলির মতোই সবসময় সতীর্থদের পাশে দাঁড়িয়েছেন । কিন্তু কোহলি যা পেয়েছেন, তেমন যোগ্য সম্মান ও খ্যাতি ধনরাজ কখনও পাননি । এমনকী, ভারতের প্রাক্তন হকি অধিনায়ক ইন্ডিয়ান হকি ফেডারেশনের কাছ থেকে নিজের বকেয়াটুকুও পাননি । 1989 থেকে 2004 সালের মধ্যে, ধনরাজ 339 টি গেমসে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন ৷ দেশের হয়ে 170 টি গোল করেন । তিনিই হকির ইতিহাসে একমাত্র খেলোয়াড় যিনি চারটি অলিম্পিক (1992, 1996, 2000 ও 2004), চারটি বিশ্বকাপ (1990, 1994, 1998 ও 2002), চারটি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি (1995, 1996, 2002 ও 2003) এবং চারটি এশিয়ান গেমসে (1990, 1994, 1998 ও 2002) খেলেছেন ।
তাঁর অধিনায়কত্বে ভারত 1998 সালের এশিয়ান গেমস এবং 2003 সালের এশিয়া কাপ জিতেছে । নিজের রক্ত-ঘাম-কান্না দেশকে নিংড়ে দেওয়া সত্ত্বেও, কেরিয়ারের শেষের দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয় । 2004 সালের এথেন্স অলিম্পিকে, খেলা শুরুর 98 সেকেন্ড পরেই ধনরাজকে তুলে নেওয়া হয় । নিশ্চিতভাবেই ধাক্কা লেগেছিল সেইসব অনুরাগীদের, যাঁরা এতবছর ধরে ভারতীয় হকিকে বয়ে নিয়ে যাওয়া মানুষটাকে শেষবার দেখতে চেয়েছিলেন ।
এই ঘটনা এতটাই যন্ত্রণাদায়ক ছিল, যে ধনরাজ খেলার পর সাক্ষাতকারের মাঝেই কেঁদে ফেলেন। তিনি মনে করেন, যে তিনি ফেডারেশনের বিরুদ্ধে কথা বলায় তাঁকে অপমান করতেই এটা করা হয়, এবং তারা চেয়েছিল যে ধনরাজ চিরদিন এই ঘটনাটা মনে রাখুন। দুঃখের বিষয়, তিনি আজও সেই স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলেন। তিনি নিজে করার আগেই তাঁকে অবসরগ্রহণ করিয়ে দেওয়া হয়। যদি এই উচ্চতার কোনও খেলোয়াড় অস্ট্রেলিয়া বা জার্মানির মতো দেশের প্রতিনিধিত্ব করতেন, তারা প্রায় প্রতিটি টুর্নামেন্টেই সোনা জিততে পারত। তাই এটা বলা ভুল হবে না, যে ধনরাজের সঙ্গে ইন্ডিয়ান হকি ফেডারেশন খারাপ আচরণ করেছে, এবং এটা তাঁর প্রাপ্য ছিল না।