হায়দরাবাদ, 28 সেপ্টেম্বর: বেজে গিয়েছে বিশ্বকাপের দামামা ৷ এক যুগ পর আবার ভারতে বসছে বিশ্বকাপের আসর ৷ স্বাভাবিকভাবেই ক্রিকেট নিয়ে এখন উত্তেজনা তুঙ্গে ৷ ইতিমধ্যেই দল ঘোষণা করে দিয়েছে বিসিসিআইও ৷ বাকি আর মাত্র কয়েকটা দিন ৷ 5 অক্টোবর নিউজিল্যান্ড আর ইংল্যান্ডের লড়াইয়ের মধ্য়ে দিয়েই শুরু হবে এই মহাযুদ্ধ ? সকলের মনে একটাই প্রশ্ন তৃতীয়বার কি ট্রফি ঘরে তুলতে পারবে ভারত? এখনও পর্যন্ত 12বার বসেছে ওয়ান ডে ক্রিকেট বিশ্বকাপের আসর ৷ 1975 থেকে 2019 সাল, আসুন জেনে নেওয়া যাক এক ডজন বিশ্বকাপের গল্প ৷
1975 সালের বিশ্বকাপ (অস্ট্রেলিয়াকে 17 রানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ): প্রথমবার বিশ্বকাপের আয়োজন করেছিল ক্রিকেটের জন্মভূমি ইংল্যান্ড ৷ দু'সপ্তাহ ধরে চলেছিল এই প্রতিযোগিতা ৷ আর অংশ নিয়েছিল 8টি দল ৷ প্রথম থেকেই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ভারত ৷ যদিও ভারতের জন্য এই বিশ্বকাপ তেমন উল্লেখ্য ছিল না ৷ তবে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্য়াচটি পরিচিত হয়ে রয়েছে সুনীল গাভাস্করের কারণে ৷ 60 ওভারের এই খেলায় 174 বল খেলে 36 রানে অপরাজিত ছিলেন তিনি ৷ ফাইনালে ক্লাইভ লয়েডের শতরানের জেরে 291 রান তোলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৷ জবাবে ব্যাট করতে নেমে 274 রানেই অল-আউট হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া ৷
1979 সালের বিশ্বকাপ (ইংল্যান্ডকে 92 রানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ): 75 সালের পর 79 সালেও দাপট দেখিয়েছিল ক্যারিবিয়ানরাই ৷ এবারও আয়োজক দেশ ছিল ইংল্যান্ডই ৷ তবে শেষ হাসি হাসলেন স্য়র ভিভিয়ান রিচার্ডস এবং কলিস কিংস ৷ ভিভের দুরন্ত 138 আর কিংসের 86 রানের দৌলতে 287 রানের টার্গেট রেখেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৷ জবাবে ব্যাট করতে নেমে 129 রানের ওপেনিং পার্টনারশিপের পরেও এই ম্যাচ ঘরে তুলতে পারেনি ইংল্যান্ড ৷ কারণ 182 রানে দ্বিতীয় উইকেট হারানোর পর শেষ আটটি উইকেট তারা হারায় মাত্র 11 রানে ৷ ফলে ইংল্যান্ডকে 92 রানে হারিয়ে দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৷
1983 সালের বিশ্বকাপ (ওয়েস্ট ইন্ডিজকে 43 রানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন ভারত): 1983 সালের বিশ্বকাপের গল্প প্রায় সকলেরই কমবেশি সকলেরই জানা ৷ লর্ডসের ময়দানে কপিলের তরুণ দল রুখে দিয়েছিল ক্যারিবিয়ান অশ্বমেধের ঘোড়াকে ৷ তবে তার আগেই গোটা ভারতের মন কেড়ে নিয়েছিল কপিল দেবের আরও একটি ইনিংস ৷ জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে তাঁর 175 রানের সেই দাপুটে ইনিংসের দৌরাত্মেই ফাইনালে জায়গা পাকা করে টিম ইন্ডিয়া ৷ তখনও হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেননি ফাইনালে এত বড় অঘটন ঘটাতে চলেছে ভারত ৷ লর্ডসের সবুজ পিচে ম্যালকম মার্শাল, অ্যান্ডি রবার্টস আর মাইকেল হোল্ডিংয়ের আগুনে বোলিংয়ের বেশিক্ষণ যে ক্রিজ ধরে রাখতে পারবেন না কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত বা মহিন্দর অমরনাথরা সেকথা সকলেই জানতেন ৷ কিন্তু 183 রানে ভারতকে অলআউট করেও সেদিন ম্য়াচ ঘরে তুলতে পারেনি ক্লাইভ লয়েডের দল ৷ মহিন্দর এবং মদন লাল মিলেই সেদিন শিকার করেন 6 উইকেট ৷ যার জেরে মাত্র 140 রানেই গুটিয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৷
1987 সালের বিশ্বকাপ (ইংল্যান্ডকে 7 রানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া): 1987 সালে বিশ্বকাপের আসর বসেছিল ভারত এবং পাকিস্তানে ৷ এই প্রথমবার ইংল্যান্ডের বাইরে কোনও দেশে আয়োজিত হয় এই প্রতিযোগিতা ৷ এবারও এক নতুন দল জিতে নেয় ট্রফি ৷ 1987 সালে অ্যালেন বর্ডারের নেতৃত্বে 7 রানে ইংল্যান্ডকে হারায় অস্ট্রেলিয়া ৷ 'বার্থ অফ এ নেশন' সিনেমার শিরোনাম মনে রেখেই বোধহয় বলা যায় ক্রিকেটের ময়দানে জন্ম হল এক নতুন সুপারপাওয়ারের ৷ এই বিশ্বকাপ থেকেই 60 ওভারের বদলে 50 ওভারের একদিনের ক্রিকেটের জন্ম হয় ৷ ভারতের জন্যও এই বিশ্বকাপটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ৷ কারণ এই বিশ্বকাপেই নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম ভারতীয় হিসাবে হ্যাটট্রিক করেন চেতন শর্মা ৷
1992 সালের বিশ্বকাপ (ইংল্যান্ডকে 22 রানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান): ইমরান খানের হাত ধরে এই প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় পাকিস্তান ৷ মেলবোর্নে ইংল্যান্ডকে 22 রানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় পাকিস্তান ৷ এই বিশ্বকাপেই পৃথিবীর পরিচয় হয় ইমজামাম উল হক নামের এ তরুণ ব্যাটারের সঙ্গে ৷ ফাইনালে ইমরানের 72 এবং জাভেদ মিয়াঁদাদের 58 রানের ইনিংসের জেরে 250 রান তোলে পাক টিম ৷ ওয়াসিম আক্রমের আগুনে বোলিংয়ের সামনে সেদিন জয় তুলে নিতে পারেননি ব্রিটিশ ব্যাটাররা ৷
1996 সালের বিশ্বকাপ (অস্ট্রেলিয়াকে 7 উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা): এবার বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছিল ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কায় ৷ এই প্রথমবার ট্রফি ঘরে তোলে কোনও আয়োজক দেশ ৷ অরবিন্দ ডি সিলভার অলরাউন্ড পারফরম্য়ান্সের জেরে সোনালি ট্রফি ঘরে তোলে লঙ্কাবাহিনি ৷ ফাইনালে একদিকে যেমন রিকি পন্টিং, মার্ক টেলর এবং ইয়ান হেইলি ঘরে ফেরান ডি সিলভা তেমনই ব্যাট হাতে খেলেন 107 রানের ঝকঝকে ইনিংস ৷ ফাইনালে 22 বল বাকি থাকতেই জয়ের জন্য জরুরি 242 রান তুলে নেয় শ্রীলঙ্কা ৷
1999 সালের বিশ্বকাপ (পাকিস্তানকে 8 উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া): 99 সালের বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকেই ক্রিকেটে শুরু হয় অজি যুগ ৷ ফাইনালে পাকিস্তানকে 8 উইকেটে পরাস্ত করে চ্যাম্পিয়ন হয় অস্ট্রেলিয়া ৷ মাত্র 132 রানে পাকিস্তানকে ফাইনালের মঞ্চে অলআউট করে দেয় অজি বোলাররা ৷ আর জবাবে ব্যাট করতে মেনে 36 বলে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের 54 রানের দৌলতে মাত্র 20 ওভারেই জয় তুলে নেয় ক্যাঙারুবাহিনি ৷ যদিও এই বিশ্বকাপের অস্ট্রেলিয়া বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার সেমিফাইনাল ম্যাচটি অনেক বেশি ঐতিহাসিক ছিল ৷ অ্যালেন ডোনাল্ডের রান-আউট গোটা ম্য়াচের ফলাফলই বদলে দেয় ৷
2003 সালের বিশ্বকাপ (ভারতকে 125 রানের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া): 2003 সালে প্রোটিয়াদের ঘরে আয়োজিত হয় বিশ্বকাপের আসর ৷ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যয়ের নেতৃত্বে দুই দশক পর আরও একবার জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে ভারত ৷ অসাধারণ ফর্মে ছিলেন সচিন তেন্ডুলকরও ৷ কিন্তু 'ম্যান অফ দ্য সিরিজের' ট্রফি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় মাস্টার ব্লাস্টারকে ৷ ফাইনাল ম্যাচে রিকি পন্টিং, ম্যাথু হেডেনদের দুর্ধর্ষ ব্যাটিংয়ের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি জাহির খান, আশিষ নেহেরারা ৷ নির্ধারিত 50 ওভারে মাত্র 2 উইকেট হারিয়ে 359 রান তোলে অস্ট্রেলিয়া ৷ জবাবে মাত্র 234 রানেই শেষ হয়ে যায় দাদার দল ৷
2007 সালের বিশ্বকাপ (শ্রীলঙ্কাকে 53 রানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া): তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জিতে 2007 সালে সোনালি ট্রফির মালিকানা করায়ত্ত করে অস্ট্রেলিয়া ৷ আশ্চর্যের বিষয় হল এবারও একটি এশিয়ান দেশকে হারিয়েই ট্রফি ঘরে তোলে অজিবাহিনি ৷ ফাইনালে গিলক্রিস্টের মারকুটে 149 রানের ইনিংসের দৌলতে 53 রানে জয় তুলে নেয় অস্ট্রেলিয়া ৷ ভারতের জন্য এই বিশ্বকাপ ছিল একেবারে হতাশা জনক ৷ গ্রপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় রাহুল দ্রাবিড়ের দলকে ৷
2011 সালের বিশ্বকাপ (শ্রীলঙ্কাকে 6 উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন ভারত): 28 বছরের অধরা স্বপ্ন পূর্ণ হয় 2011 সালে ৷ মহেন্দ্র সিংহ ধোনির নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার বিশ্বজয়ের স্বাদ পায় টিম ইন্ডিয়া ৷ সচিন তেন্ডুলকর, বীরেন্দ্র সেহওয়াগদের ব্যর্থতার দিনে ভারতকে বিপদজনক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করেন গৌতম গম্ভীর এবং ধোনি ৷ প্রথমে ব্যাট করে মহেলা জয়বর্ধনের 103 রানের ইনিংসের দৌলতে 6 উইকেটে 274 রানের লক্ষ্যমাত্রা রাখে শ্রীলঙ্কা ৷ জবাবে প্রথমে পর পর সচিন এবং বীরুকে হারিয়ে চাপে পড়ে গিয়েছিল ভারত ৷ কিন্তু বিরাট কোহলি, গৌতম গম্ভীর এবং ধোনির হাত ধরে বদলে যায় ম্য়াচের ফলাফল ৷ আর ধোনির সেই আইকনিক ছয় তো আজও ভুলতে পারেনি গোটা ভারত ৷ এই ফাইনাল ম্যাচে 91 রানে অপরাজিত থাকেন ধোনি ৷ আর তার আগে 97 রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে ঘরে ফেরেন গৌতম ৷
2015 সালের বিশ্বকাপ (নিউজিল্যান্ডকে 7 উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া): 2015 সালে অবশ্য আর বিশ্বজয়ের স্বাদ পায়নি ভারত ৷ সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে বিদায় নিতে হয় ভারতকে ৷ ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে 7 উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় অস্ট্রেলিয়া ৷ এই নিয়ে পঞ্চমবার ট্রফি ঘরে তোলে অজিবাহিনি ৷ 17 ওভার বাকি থাকতেই জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় 184 রান ঘরে তুলে নেয় তারা ৷ 56 রানে অপরাজিত থাকেন স্টিভ স্মিথ ৷
2019 সালের বিশ্বকাপ (নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড): 2019 সালের বিশ্বকাপের মতো নাটকীয় বিশ্বকাপ ফাইনাল আর নেই বললেই চলে ৷ 100 ওভারের ম্যাচ পূর্ণ হওয়ার পরেও নিউজিল্যান্ড বনাম ইংল্যান্ডের এই ফাইনালের কোনও মিমাংসা হয়নি ৷ লর্ডসে প্রথম ব্যাট করে 241 রান তুলেছিল নিউজিল্যান্ড ৷ একই রানে এসে থামে ইংল্যান্ডের দৌড় ৷ এমনকী সুপার ওভারেও কোনও ফলাফল পাওয়া যায়নি ৷ শেষ পর্যন্ত ইনিংসে বেশি বাউন্ডারি মারার নিরিখে এগিয়ে থাকায় কাপ তুলে দেওয়া হয় ইংল্যান্ডের হাতে ৷
আরও পড়ুন : বিশ্বকাপের ঠিক আগে তামিম বিতর্কে অবসরের জল্পনা উসকে দিলেন শাকিব