শ্রীনগর : বৃহস্পতিবার ভোর চারটে নাগাদ নিজেদের বেকারির দোকানের দিকে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন 45 বছর বয়সি কৌসের রিয়াজ় ও তাঁর ছেলে আকিব রিয়াজ় সোফি । তখনই তাঁরা নিরাপত্তা বাহিনীর সামনে পড়ে যান । অস্বাভাবিক পরিস্থিতির বিষয় আঁচ করে কৌসের তাঁর ছেলেকে ফিরে যাওয়ার কথা বলেন । যখনই তাঁরা গাড়ি ঘুরিয়ে নিচ্ছিলেন, তখনই নির্বিচারে ওই গাড়ির উপর গুলি চালানো শুরু হয় । নিরাপত্তা বাহিনীর আচমকা গুলিবর্ষণে কৌসেরের মৃত্যু হয় ।
আম্মিকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে আকিব তাঁর গাড়িটি থামিয়ে দেন । যার নম্বর JKO1W7338 । তখন তিনি দেখেন যে তাঁর আম্মির মাথার পিছন দিকে গুলি লেগেছে ।
25 বছর বয়সি আকিব ETV ভারতকে বলেছেন, ‘‘নিরাপত্তা বাহিনীকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই আমার আম্মি ভয় পেয়ে যান । আর আমাকে ফিরে যেতে বলেন । কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমাদের উপর গুলি চালানো হয় । গাড়ির উইন্ডশিল্ড ভেদ করে বুলেট এসে আমার মায়ের মাথায় লাগে ।’’
তিনি এরপর বলেন, ‘‘ওখানে মোতায়েন পুলিশ আধিকারিকদের আমি বলি যে আমার আম্মির গুলি লেগেছে । কিন্তু তাঁরা কোনও প্রতিক্রিয়াই দেননি । তার পর কয়েকজন আধিকারিক আমাদের রক্ষক (পুলিশ ভ্যান)-এ নিয়ে পুলি্শ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে যান । সেখানেই আমার আম্মিকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয় । তবে আমার আম্মি ঘটনাস্থানেই মারা গেছিলেন ।’’
ওই এলাকায় কৌসেরের পরিবারের একটি বেকারির দোকান রয়েছে । তাঁরা প্রতিদিন প্রায় একই সময়ে বাড়ি থেকে এসে সেখানে যান ৷ আর স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য পাঁউরুটি তৈরি করেন । আকিব এই অগাস্টের 31 তারিখ বিয়ে করেছেন । তারপর তাঁরা কাছাকাছির একটি নতুন বাড়িতে চলে গেছেন । পর পর দু'টি উৎসবের পর এবার তাঁদের আত্মীয়রা আবার তাঁদের বাড়িতে হাজির হয়েছেন কৌসেরের মৃত্যুর শোকপ্রকাশ করার জন্য ।
পরিবারের দাবি, ‘‘এটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত খুন ।’’
যখন কৌসেরকে মারা হয়, তখন তাঁর শওহর শ্রীনগরের বক্ষ রোগ হাসপাতালে রাতের শিফটে কর্মরত ছিলেন । মহম্মদ আমিন সোফি, আকিবের কাকা ও শ্বশুর । তিনি বলেন, ‘‘আকিব প্রথমে তাঁরা বাবাকে খবরটা দেন । তারপর ঘটনাস্থান থেকেই তিনি আমাকে ফোন করেন । আমরা পুলিশ কন্ট্রোল রুমে যাই । কিন্তু তারা এখনও কৌসেরের মৃতদেহ ফেরত দেয়নি ।’’ এর সঙ্গে তিনি আরও যোগ করেন যে কোনও প্রশাসনিক আধিকারিক এখনও তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি । তাঁদেরকে একাই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ।
তিনি বলেন, ‘‘যেহেতু পরিস্থিতি এখন উত্তপ্ত তাই তাঁরা এখন মৃতদেহ দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে ।’’
পুলিশের কাছ থেকে জানা গেছে যে রাত 2 টো নাগাদ শ্রীনগরের বাটামালো এলাকায় যৌথ অভিযান শুরু হয় । আর অভিযান শেষ হয় কৌসের ও তিন স্থানীয় জঙ্গি নিহত হওয়ার পর । ওই তিন জঙ্গিই দক্ষিণ কাশ্মীরের বাসিন্দা ।
একটি সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিত হয়ে ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ (DGP) দিলবাগ সিং দাবি করেন যে ‘গুলির লড়াই’ চলার সময় কৌসের মারা গেছেন । এই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন CRPF-এর একজন ডেপুটি কমান্ড্যান্ট । তিনিও গুলির লড়াইয়ে জখম হয়েছেন । মিলিটারি বেস হাসপাতালে এখন তাঁর চিকিৎসা চলছে ।
সিং বলেন, ‘‘যেখানে এনকাউন্টার হয়, তার কাছাকাছি কৌসের রিয়াজ় নামে এক মহিলা দুর্ভাগ্যজনক ভাবে মারা গেছেন । একজন নাগরিকের জীবন এই ঘটনায় চলে গেল । এর জন্য আমরা দুঃখিত ।’’
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এর আগে চলতি বছরের 1 জুলাই 65 বছর বয়সি একজন নাগরিক বসির আহমেদ খান সেনা আক্রমণে নিহত হয়েছিলেন । বসিরের পরিবার তাঁদের তিন বছরের নাতিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন । অভিযোগ তাঁকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে গাড়ি থেকে টেনে বের করে মারা হয়েছে । যদি নিরাপত্তা বাহিনীর তরফে বারবার এই বিষয়টিকে অস্বীকার করা হয়েছে ।
DGP-র বক্তব্য অনুযায়ী, চলতি বছরে এই অঞ্চলে 177 জন জঙ্গি নিহত হয়েছে । শুধুমাত্র শ্রীনগরেই বিভিন্ন অভিযানে 16 জন জঙ্গি নিহত হয়েছে । তারমধ্যে সাত জন জঙ্গি আবার শ্রীনগরেরই বাসিন্দা ।
বৃহস্পতিবার রাত 2টো নাগাদ বাটামালো এনকাউন্টার শুরু হয় । যেখানে তা হয়, সেটা পুলিশ কন্ট্রোল রুমের কাছে । ওই এলাকা ঘন বসতিপূর্ণ । সশস্ত্রবাহিনী আবদুল মাজিদ গনির বাড়ি ঘিরে ফেলে । ওই ব্যক্তি জম্মু ও কাশ্মীর গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ছিলেন । এখন অবসর নিয়েছেন ।
ETV ভারতকে গনি বলেন, ‘‘বাহিনী দরজায় টোকা মারল । আর আমাদের বেরিয়ে যেতে বলল । তারা আমাদের মোবাইল ফোন নিয়ে নিল । আর আমার সন্তানদের আটক করল । তারা আমাদের রাস্তার উপর অপেক্ষা করতে বলল । আমরা বুঝতেই পারছিলাম না যে ঠিক কী হচ্ছিল । আমার পরিবার ছাড়া সেই সময় বাড়িতে আর কেউই ছিল না ।
গনির বক্তব্য অনুযায়ী, পুলিশ তাঁর তিন ছেলেকে আটক করেছেন । তাঁদের মধ্যে একজনের নাম ইজ়হার উল ইসলাম । তিনি BUMS ডাক্তার । দ্বিতীয় জনের নাম ইদ্রিস উল ইসলাম । তিনি একজন দন্ত চিকিৎসক । আর তৃতীয় জনের নাম শাহীন উল ইসলাম । তিনি স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন । গনির দুই মেয়েও রয়েছেন । তাঁদের একজন এখন MBBS পড়ছেন ।
ওই অভিযানে তাঁদের একতলা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । বাড়ির সদস্যদের দাবি, ওই অভিযানের সময় বাড়ি থেকে কয়েক লাখ টাকার সোনার গয়না ও নগদ 45 হাজার টাকা চুরি হয়েছে ।
যেখানে গুলির লড়াই হয়, তার কাছাকাছি এলাকায় যাঁরা থাকেন বা এই ধরনের গুলির লড়াইয়ের সময় জঙ্গি ও সশস্ত্র বাহিনীর মাঝখানে যাঁরা পড়ে যান, তাঁরা এর আগে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে জঙ্গি দমন অভিযানের সময় পুলিশ আধিকারিকরা গয়না ও নগদ টাকা চুরি করে নিয়ে যায় । যদিও এই দাবি পুলিশ বারবার অস্বীকার করেছে ।
স্থানীয়দের দাবি, সকাল সাড়ে 7 টা নাগাদ গুলির লড়াই থেমে যায় । তারপর ওই এলাকায় সংঘর্ষ শুরু হয় । বিক্ষোভকারীদের থামাতে পুলিশকে কাঁদানে গ্যাসও ছুঁড়তে হয় । কৌসেরের হত্যার প্রতিবাদে স্থানীয়রা বাটামোলার বিভিন্ন রাস্তা ও গলি অবরোধ করেন । টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখান । ফলে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় ।
সোপোরে একটি পরিবার অভিযোগ করে যে 23 বছর বয়সি যুবক ইরফান আহমেদ দারকে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ ‘হেপাজতে’ নিয়ে মেরে ফেলেছে । তারপর সেখানে প্রতিবাদ হয় । তারপর দিনই এই ঘটনাটি ঘটল । ওই এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । DGP-এর বক্তব্য অনুযায়ী, ইরফানের কাছ থেকে হ্যান্ড গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছে । তারপর তাঁকে নিয়ে অন্য উদ্ধারে যাওয়ার সময় তিনি ‘পালিয়ে’ যাওয়ার চেষ্টা করেন । এরপর তাঁর দেহ সোপোরের তুজ্জার শরিফ এলাকার একটি পাথর খাদানের কাছে পাওয়া যায় ।
এদিকে পুলিশ এই ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে ।