কোরোনা প্রভাব ফেলেছে বিশ্বজুড়ে ৷ মৃত্যুর পর মৃত্যু এখনও অব্যাহত ৷ আক্রান্তের সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে ৷ বিশ্বজুড়ে প্রায় সব দেশেই চলছে লকডাউন ৷ বিভিন্ন দেশে আটকে পড়েছে ভিনদেশি বহু মানুষ ৷ বিশ্বের বহু প্রান্তে আটকে পড়েছেন বহু ভারতীয় ৷ কোরোনা সংক্রমণের জন্য অতঙ্কিত তাঁরা ৷ তেমনই এক প্রবাসী ভারতীয় সায়ন্তন দাস অধিকারী ৷ তিনি UK-র ক্যান্ডিড কমিউনিকেশনের ডিরেক্টর ৷ কোরোনা যখন মহামারীতে পরিণত হয়েছে তখন পূর্ব লন্ডনের রমফোর্ডে আটকে পড়েছেন তিনি ৷ ভিডিয়ো বার্তার মাধ্যমে ইটিভি ভারতের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন তাঁর অভিজ্ঞতা ৷
বিলেত বলতে ছোটবেলা থেকে লন্ডনকেই সবাই বুঝতাম । অ্যামেরিকাকে ঠিক বিলেত বলতে কখনও শুনিনি । তাই 2017-তে পাকাপাকিভাবে এই বিলেতে আসার পর কয়েকটা বিষয়ে এক্কেবারে নিশ্চিত ছিলাম । তার মধ্যে সবার প্রথমে ছিল শিক্ষা আর স্বাস্থ্য । এর পরেরটা ছিল নির্ভেজাল খাবার-দাবার । অন্তত কলকাতার মতো কার্বাইডের পাকানো কলা আর রং করা আপেল খেতে হবে না । আর এটাই বরাবর শুনে এসেছি যে এই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল পরিচালক ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসেস বা NHS-এর চিকিৎসা ব্যবস্থা এতটাই উন্নত যে এরা কাউকে মরতে দেবে না।
বিশ্বাস করুন, এই কোরোনা ভাইরাসের করুণা না থাকলে উপরে লেখা আমার ওই ধারণাগুলো যাচাই করার কোনও সম্ভাবনা কোনোদিনও হয়তো থাকতো না । মাত্র একমাসের মধ্যে আমি আমার জন্ম শহর কলকাতাকে পরতে পরতে খুঁজে পেয়েছি এই লন্ডনে । স্বাস্থ্য ব্যবস্থার করুণ পরিস্থিতি, দেশীয় দোকানগুলোতে কালোবাজারি, গুপ্তধন খোঁজার মতো অবস্থা হ্যান্ড স্যান্টিটাইজ়ার আর মাস্ক-এর, আর সর্বোপরি রোজকার এই মৃত্যুমিছিল । আমার এই প্রতিবেদন লেখার সময় অবধি সরকারি হিসেবে ব্রিটেনে শুধুমাত্র হাসপাতালে মৃতের সংখ্যা 15,464 । আর দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা 1,14,217 । হাসপাতালের বাইরে অর্থাৎ কেয়ার হোম বা নিজ বাসভবনে মৃতের সংখ্যা কিন্তু সরকারি তরফে এখনও আমরা কেউ জানি না । ডাক্তারি মহলে যা শোনা যাচ্ছে তাতে ওই সংখ্যাটা হাসপাতালে মৃতের সংখ্যার খুব একটা কম হবে না । সত্যি, এই বিলেতকে সামনে থেকে না দেখলে কারও পক্ষেই বিশ্বাস করা কঠিন ।
মহামারী শব্দটা ছোটবেলা থেকে ইতিহাসের বইয়েই পড়েছিলাম । জীবদ্দশায় দেখে যাব, তাও আবার খোদ এই লন্ডন শহরে বসে, এটা স্বপ্নে আসারও জায়গা ছিল না । আসলে গোটা ইউরোপ এই ভাইরাসটাকে কার্যত পাত্তা দেয়নি । এখন সেটার হাড়ে হাড়ে মাশুল দিতে হচ্ছে । এখন ব্রিটেনে আগামী 7 মে অবধি লক ডাউন চলবে । একটাই ভরসা, শিক্ষিত দেশ বলেই হয়তো লকডাউনটা আক্ষরিক অর্থে এখানে সবাই খুব মেনে চলছেন । কিন্তু এর মধ্যেও কিছু জায়গায় চলছে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড, রাস্তায় দেখা যাচ্ছে বাস, চলছে দূরপাল্লার ট্রেনও । এটা কী ধরনের লকডাউন বুঝলাম না । ভারতের মতো 130 কোটির দেশে যদি প্লেন, ট্রেন, বাস, ট্যাক্সি বন্ধ করে দেওয়া যায় তো ব্রিটেনে কেন সম্ভব না । এর উত্তর তো আমার কাছে নেই । এমনকী রাস্তায় কাউকে মাস্ক পরে বেরোতে দেখিনি ।
ব্রিটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রোজকার এই করোনা মোকাবিলার ধরণ দেখে সত্যি মনে হয় আমাদের ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ অনেক নিরাপদ স্থান । ব্রিটেনের মিডিয়া না করলেও পশ্চিমি অনেক মিডিয়াই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশংসা করে যাচ্ছে । কিন্তু আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টাকে এই পশ্চিমি মিডিয়ায় তুলে ধরার কেউ নেই বলেই খারাপ লাগে । রাতারাতি একটা স্টেডিয়ামকে হাসপাতালে বদলে ফেলা ৷ আস্ত একটা সরকারি হাসপাতালকে শুধুমাত্র কোরোনার জন্য নিয়োজিত করলেন ৷ নিজের সংক্রমণ হওয়ার ভয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে সব জায়গায় সরেজমিনে তদারকি করা তার উপরে রোজ সাধারণ মানুষকে প্রতিনিয়ত আশ্বস্ত করা, তাঁদের সাহস জোগানো এটা নিঃসন্দেহে অভাবনীয় । আমার মনে হয় শুধু হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন নয় ভারতের থেকে ‘‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট’’-টাও পশ্চিমি দুনিয়ার শেখা উচিত ।
লন্ডনকে এখন আক্ষরিক অর্থেই 'ঘোস্ট টাউন' বলা হচ্ছে । দুর্বল চিকিৎসা ব্যবস্থার কঙ্কালসার চিত্রটা একেবারে সামনে চলে এসেছে । গোটা দেশে অধিকাংশ হাসপাতালে নেই পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর । এখানকার NHS (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস) ডাক্তার আর নার্সের সংকুলানে ভুগছে । সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় লন্ডনে বড় সংখ্যক এশিয়ান বা বিশেষ করে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মানুষ মারা যাচ্ছেন । যাঁদের বয়স কিন্তু বেশি না । তিরিশ থেকে সত্তর বছরের মধ্যে এই মৃত্যু । তার উপরে দেওয়া হচ্ছে গণকবর । এক অবস্থা বার্মিংহ্যাম, ম্যানচেস্টার, লিভারপুল, লিডস-এর মতো শহরগুলোতেও ।
আমি থাকি পূর্ব লন্ডনের রমফোর্ড কাউন্সিলের রেইনহ্যাম নামের একটা জায়গায় । আমার ফ্ল্যাটটা রেইনহ্যাম রোডের উপরেই । ঘরবন্দী হয়ে আছি গত তিন সপ্তাহ থেকেই । জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকালে মনে হয় কোনও মৃত্যুপুরীতে আছি । যে কোনও 'হরর' ছবির শুটিং করার পারফেক্ট সেট । পুরো সুনসান । অথচ এই সময় লন্ডনে রোদ ঝলমলে দিন । প্রসঙ্গত এই দেশে রোদ ওঠা দেখাটা অনেকটা ক্যাসিনোতে বাজি জেতার মতো । কিন্তু করার কী আছে । জানলা দিয়েই দেখতে হয় পর্ণমোচী গাছে বসন্তের ফুল ফুটছে । তাও এই অবস্থায় দুদিন গিয়েছিলাম সুপার মার্কেটে । বলতে গেলে ইষ্টনাম জপ করতে করতে । সেখানে লোকে সোশাল ডিস্ট্যানসিং মানলেও কারও মুখে মাস্ক নেই । হাইজিন ব্যাপারটা তো সাহেবরাই শিখিয়েছে বলে জানতাম । আর আগেই বললাম হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ার পাওয়াটা মরুভূমিতে মরুদ্যান পাওয়ার মতোই ।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা আগামী সপ্তাহ থেকে এই ভাইরাসের টিকা নাকি মানবদেহে পরীক্ষা করবেন । শিম্পাজিদের উপর সেটা হয়ে গিয়েছে । আশা করছি এটা আমাদের শরীরেও কাজ দেবে । আশাই তো এখন করতে পারি । ওটা নিয়েই তো এখন থাকতে হবে । এ ছাড়া তো কোনও উপায় নেই ।