কেউ যদি জানতে চায়, ক্ষমতায় থাকা একজন অতি লোভী ব্যক্তিকে কেমন দেখতে হয় তাহলে তাঁকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের থেকে বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই । একদিকে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার ব্যাপারে উচ্চাকাঙ্খী, অন্যদিকে দ্বিতীয়বারের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হতে চাইছেন । এইসব লক্ষ্যে পৌঁছাতে গিয়ে তিনি বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলিকে নরক যন্ত্রণা ভোগ করাচ্ছেন । ফলস্বরূপ, ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন জায়গা, যেমন মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান আর ভেনেজুয়েলায় কোনও শান্তি নেই । যখন আর ন-মাসের মধ্যেই আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন তখন ট্রাম্প তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধুদের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজের স্বার্থরক্ষায় মগ্ন । ট্রাম্পের মধ্যেকার ব্যবসায়ী সত্ত্বা এখন লাভ ও ক্ষতির হিসেব কষছেন । এধরনের চেষ্টার সাম্প্রতিক উদাহরণ হল অ্যামেরিকা- তালিবান শান্তিচুক্তি । কাতারের দোহায় এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় অ্যামেরিকার বিশেষ প্রতিনিধি জালমে খলিলজাদ এবং তালিবান কমান্ডার মোল্লা বরাদরের মধ্যে । এই চুক্তিতে অংশ নেন পাকিস্তান, চিন, তুরস্ক এবং ইন্দোনেশিয়ার প্রতিনিধিরা ।
এই চুক্তি অনুযায়ী, আগামী 14 মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সেনা সরাতে সায় দেয় অ্যামেরিকা । তার উপর এই চুক্তি আফগানিস্তান সরকার এবং তালিবানের মধ্যে আলোচনার পথ তৈরি করে । এই আলোচনা যদি সফল হয় তাহলে অ্যামেরিকা 2014 সালে শুরু হওয়া অপারেশন রেজ়োলিউট সাপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসতে পারে । 2001 সালে শুরু হওয়া অপারেশন এনডিওরিং ফ্রিডম শেষ হয় 2014 সালে । কিন্তু, তালিবানের সঙ্গে সংঘাত চলতেই থাকে । 2014 থেকে অ্যামেরিকার সেনার বদলে আফগান সেনা তালিবানদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল । অ্যামেরিকা তাদের সাহায্যও দিচ্ছে । যদি শান্তি আলোচনা সদর্থক হয় তাহলে 18 বছর ধরে চলা এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হবে । এই চুক্তি নিয়ে প্রশ্নের সাবধানী উত্তর দিয়েছেন মার্কিন বিদেশসচিব মাইক পম্পেও । তিনি বলেন, "অ্যামেরিকা আর তার সহযোগীরা তখনই সফল হবে যখন আফগানিস্তানের মাটি থেকে সন্ত্রাসবাদকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা যাবে । বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের দিকে তাকালে পম্পেও-র স্বপ্নকে মরীচিকার মতো মনে হয় । অন্যদিকে, তালিবানের রাজনৈতিক প্রধান শের মহম্মদ আব্বাস স্তানিকজাই দাবি করছেন, এটা তাঁদের জয় । দ্য গার্ডিয়ানের মতো পত্রিকা বলছে যে তালিবানরা এই শান্তি-সমঝোতাকে কৌশলগত চুক্তি হিসেবে চিহ্নিত করছে ।
এই শান্তি সমঝোতার প্রতিটা শব্দে ফুটে উঠেছে, আফগানিস্তান থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে আসতে অ্যামেরিকার মরিয়া চেষ্টা । 14 মাসের মধ্যে সেনা সরাতে গেলে প্রথম 135 দিনেই পাঁচটি সেনাঘাঁটি সম্পূর্ণভাবে খালি করতে হবে । আর 8600 মার্কিন সেনা এবং জোটের বাহিনীকে সরিয়ে আনতে হবে । অ্যামেরিকা এবং রাষ্ট্রসংঘের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথাও রয়েছে চুক্তিতে । চুক্তির প্রথম অংশে, আমেরিকা কী কী করবে তার নির্দিষ্ট তারিখ ও সময় ধার্য হয়েছে । দ্বিতীয় অংশে তালিবান কী করবে তার কোনও উল্লেখ দেখা যাচ্ছে না । চুক্তিতে আলকায়দার মতো অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তালিবানকে যোগাযোগ রাখতে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে । তালিবানরা আলকায়দার জন্য তাদের রাজত্ব ত্যাগ করেছে । তারা ট্রাম্পের জন্য এ সবকিছু ছাড়বেই বা কেন ?
দ্বিতীয় অংশের পাঁচ নম্বর পয়েন্টে একটা বিপদ সংকেত রয়েছে । বলা হয়েছে যে, অ্যামেরিকা ও তার সহযোগীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে এমন কাউকে তালিবানরা ভিসা, পাসপোর্ট বা ট্র্যাভেল পারমিট দিতে পারবে না । এর অর্থ অ্যামেরিকা ঘুরিয়ে আফগানিস্তানে তালিবান শাসনকে মান্যতা দিচ্ছে । তালিবানরা নিজেদের আফগানিস্তানের ইসলামিক আমিরশাহী ঘোষণা করেছে, যার বিরোধিতা অ্যামেরিকাকে সর্বশক্তি দিয়ে করতেই হত । অ্যামেরিকা 14 মাসের সময়সীমা দিয়েছে এবং জানিয়েছে যে, চুক্তির শর্ত তালিবানরা না মানলে তারা আফগানিস্তানে ফিরে আসবে । যদি এই সময়ের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়ে যায় তাহলে নেতৃত্বর উপর রাজনৈতিক চাপ থাকবে না এবং তাদের মনোভাব বদলাতেও পারে ।
প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোলটন এই চুক্তি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন । আফগানিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও শান্তি চুক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে । যদিও নির্বাচন কমিশন 50.64 শতাংশ ভোট পাওয়া আশরফ গনিকে জয়ী ঘোষণা করেছে । তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল্লা যিনি 39.02 শতাংশ ভোট পেয়েছেন তিনি এই ফলাফলকে মানছেন না । আগের ভোটে যখন এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তখন অ্যামেরিকা গনিকে প্রেসিডেন্ট এবং আবদুল্লাকে চিফ এগজ়িকিউটিভ নিযুক্ত করেছে । কিন্তু, এখন অ্যামেরিকা তালিবানের সঙ্গে চুক্তি করতে ব্যস্ত । রাশিয়ার মতো দেশগুলি নেতাদের অনুরোধ করেছে যাতে তালিবানের সঙ্গে আলোচনা শেষ হওয়া পর্যন্ত তাঁরা নিজেদের রাজনৈতিক রেষারেষি দূরে সরিয়ে রাখেন । গনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ চালিয়ে যাবেন । কিন্তু সমস্যা ফিরে আসবেই। কারণ এই শান্তি আলোচনা নিয়ে কোনও রাজনৈতিক ঐক্যমত নেই ।
এই চুক্তির ফলে আফগানিস্তানে ভারতের বিনিয়োগ, তার শক্তি নিরাপত্তা এবং বাণিজ্য ধাক্কা খেয়েছে । এর পাশাপাশি থাকছে নিরাপত্তায় খামতির সম্ভাবনাও । ভারত সবসময়ই আফগানিস্তান সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে থেকেছে । তালিবানের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে । মস্কোয় যখন আফগানিস্তান সরকার এবং তালিবান নেতাদের মধ্যে আলোচনা হয় তখন ভারত তার দুই প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত, অমর সিনহা এবং টিসিএ রাঘবনকে পাঠিয়েছিল । আসলে, এই দর কষাকষির পরেই আফগানিস্তানের শান্তি আনার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছিল । সমঝোতা অনুষ্ঠানে পরিদর্শন হিসেবে ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রদূত পি কুমারন । অন্যদিকে পাকিস্তান, তালিবান এবং অ্যামেরিকার সঙ্গে তাদের সখ্যতা বাড়িয়েছে । অ্যামেরিকা এর মধ্যেই বালুচ লিবারেশন আর্মিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে । 2019-এর ডিসেম্বর থেকে অ্যামেরিকায় পাক সেনার প্রশিক্ষণ নতুন করে শুরু করেছে ট্রাম্প সরকার । এসমস্ত কিছুই ভারতের পক্ষে কৌশলগত সমস্যার কারণ ।
ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শংকর বলেন, "সবাই জানে যে, দোহায় কী হয়েছে । অ্যামেরিকার যা লাভ হয়েছে তার থেকে যেন সরে আসতে না হয়, সেব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত । আরও প্রভাব পড়বে 2018 সালে শুরু হওয়া তাপি (তুর্কমেনিস্তান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ভারত) গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পে । তুর্কমেনিস্তান থেকে ভারতে নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস সরবরাহকারী এই প্রকল্পের খরচ এবং নিরাপত্তায় প্রভাব পড়বে । এই প্রকল্প থেকে 400 মিলিয়ন ডলারের ডিস্ট্রিবিউশন ফি পেতে পারে আফগানিস্তান । এই পাইপলাইন আসবে হিরাট আর কান্দাহারের মতো তালিবান প্রভাবিত এলাকা দিয়ে । পাকিস্তানও তালিবানকে উসকানি দিয়ে ভারতকে বিপদে ফেলতে পারে । এই প্রকল্প থেকে পাওয়া টাকা তালিবানরা কীভাবে খরচ করবে সেটা নিয়ে বিরাট সংশয় রয়েছে । পাশাপাশি আফগানিস্তান থেকে ISI মদতপুষ্ট জঙ্গিদের কাশ্মীর সীমান্তে পৌঁছে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ।
অ্যামেরিকার নজরদারি সত্ত্বেও, বিশ্বের 90 শতাংশ আফিম আফগানিস্তানেই উৎপন্ন হয় । এইভাবে আয় করার স্বাদ যারা একবার পেয়েছে তারা একটা সামান্য শান্তিচুক্তির জন্য আফিম চাষ ছেড়ে দেবে কি না সেব্যাপারে সংশয় রয়েছে । বাড়তে থাকা মাদক সন্ত্রাস কাশ্মীর ও পঞ্জাবে সমস্যা তৈরি করবে । কাশ্মীরের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির আয়ের প্রধান পথই হল মাদক চোরাচালান । পাকিস্তান-ঘনিষ্ঠ তালিবান ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তান সরকারের ঘনিষ্ঠতাকে খুব একটা সুনজরে দেখে না । সংসদ ভবন, স্কুল, বাঁধ, সড়কের মতো 36টি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প সম্পূর্ণ করেছে ভারত । আরও অনেক প্রকল্পের কাজ চলছে । এই জন্যই তালিবান বার বার ভারতের দূতাবাস এবং ভারতের প্রকল্পগুলোর উপর হামলা চালিয়েছে । এইসব প্রকল্পে কর্মরত বহু ভারতীয়কে অপহরণ করা হয়েছে । অ্যামেরিকা সেনা সরে যাওয়ার সময়টুকু তালিবান চুপচাপ থাকলেও অ্যামেরিকা দৃশ্য থেকে সরে গেলেই তারা আবার ভারতকে নিশানা করবে । এই মুহূর্তে, চুক্তিতে তালিবানদের জন্য শর্তে মানবাধিকার, মহিলাদের অধিকার, সুশাসন এবং গণতন্ত্র নিয়ে কোনও কথা নেই । এককথায়, ট্রাম্প আফগানিস্তানের মানুষের সুরক্ষাকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেছেন । ঠিক যেভাবে হয়েছিল সিরিয়ায় ।
সরকারের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং তার সঙ্গে অ্যামেরিকার তালিবানের সঙ্গে হাত মেলানোর জেরে দেখা যাচ্ছে সংকটের মেঘ । 18 মাসের দর কষাকষি আর নাটকীয় পটপরিবর্তনের পরও অ্যামেরিকা বা তার সহযোগীদের তাৎপর্যপূর্ণ কোনও লাভই হয়নি । 10 মার্চের আগে 5 হাজার তালিবান জঙ্গিকে মুক্তি দিতে হবে আফগানিস্তান সরকারকে । আর 1 হাজার নাগরিককে মুক্তি দিতে হবে তালিবানদের । সমঝোতা কার্যকর করতে সহযোগিতা করতে হবে মুক্ত হওয়া বন্দীদের । আফগানিস্তান সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর বাকি তালিবান বন্দীদের মুক্ত করতে হবে তিন মাসের মধ্যে । এটা সমঝোতার একটা দিক । অদ্ভূতভাবে এই সমস্ত তালিবান জঙ্গিদের আফগানিস্তান সরকার বন্দী করেছিল । কিন্তু তারা এই আলোচনার ধারেকাছেও ছিল না । এই আলোচনা হয় শুধু অ্যামেরিকা এবং তালিবানদের মধ্যে । এর ফলে এই বন্দীদের মুক্তি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছে । সম্প্রতি একটি বৈঠকে প্রেসিডেন্ট আশরফ গনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, আফগানিস্তান সরকারের নেতাদের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ আলোচনা শুরু না হওয়া পর্যন্ত তারা কোনও বন্দীকে মুক্তি দেবেন না ।