কলকাতা, 10 জুন : শেষ হল 'তাহাদের' যুগ ৷ 'তাহারা' হলেন ঋত্বিক ঘটক (Ritwik Ghatak), সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray), মৃণাল সেন (Mrinal Sen) এবং অবশ্যই 'তাহাদের কথা'-র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ৷ 77 বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত অসুখে চরাচরের মায়া ত্যাগ করলেন একাধারে কবি ও চলচ্চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (Buddhadeb Dasgupta) ৷ এইসঙ্গে শেষ হল অন্যধারার তথা ধ্রুপদী বাংলা সিনেমার সোনালি অধ্যায়ও ৷
'নিম অন্নপূর্ণা'র পরিচালকের জন্ম 1944 সালের 11 ফেব্রুয়ারি ৷ জন্মস্থান দক্ষিণ পুরুলিয়ার আনারা ৷ তাঁর নির্মিত ছবিগুলির দিগন্ত বিস্তৃত পটভূমি দেখলেই বোঝা যায়, কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকলেও আমৃত্যু জন্মস্থান পুরুলিয়াকে ছাড়েননি তিনি ৷ বাবা তারকনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন ভারতীয়ে রেলওয়ের চিকিৎসক ৷ বারো বছর বয়সে কলকাতা শহরে পাড়ি বুদ্ধদেবের ৷ ভর্তি হন হাওড়ার দীনবন্ধু স্কুলে ৷ পরে স্কটিশ চার্চ কলেজের স্নাতক ৷ অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৷
অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবেই কর্মজীবন শুরু করেন বুদ্ধদেব ৷ প্রথমে বর্ধমানের শ্যামসুন্দরে কলেজে, পরে কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করেন ৷ তলেতলে লালিত চলচ্চিত্র প্রেম ৷ যার শুরু হাইস্কুলবেলা থেকে ৷ কাকার উৎসাহে ক্যালকাটা ফিল্ম সোশাইটির সদস্য হন কিশোর বুদ্ধদেব ৷ একে একে পরিচিত হন চার্লি চ্যাপলিন, ইঙ্গমার বার্গম্যান, আকিরো কুরোসাওয়া, ভিক্টর ডি-সিকা, রবার্তো রোসেলিনি এবং মাইকেল এনজেলো আন্তোনিওনির মতো পরিচালকের কাজের সঙ্গে ৷ যা পরবর্তীকালে তাঁকে চলচ্চিত্র পরিচালনায় অনুপ্রাণিত করবে ৷
1968 সালে দশ মিনিটের তথ্যচিত্র 'কন্টিনেন্ট অব লাভ' নির্মাণের মাধ্যমে পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের হাতেখড়ি ৷ প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি 'দূরত্ব' মুক্তি পায় 1978 সালে ৷ শুরুর দিকের ছবিগুলির মধ্যে 'নিম অন্নপূর্ণা' (1979), 'গৃহযুদ্ধ' (1982) চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ মহলের উচ্চপ্রশংসা পায় ৷ যদিও এই পরিচালকের প্রথম দিকের ছবি সত্যজিৎ রায়ের বাস্তবধর্মী ন্যারেটিভ আঙ্গিকে অনুপ্রাণিত ৷ বলা যেতে পারে, শুরুর দিকে বুদ্ধদেব তাঁর নিজের ভাষা খুঁজে পাননি বা খোঁজার প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলেন ৷ 'বাঘ বাহাদুর', 'তাহাদের কথা', 'চরাচর', 'লাল দরজা'র, 'উত্তরা'র মতো ছবিতে যে অপূর্ব চলচ্চিত্র ভাষার সঙ্গে দেখা হল বিশ্বের চলচ্চিত্র প্রেমীদের ৷ ছবির গল্পের থেকেও যেখানে মেটাফরগুলি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ৷ স্বপ্ন ও বাস্তব গুলিয়ে দেওয়া চরিত্র ৷ আর পুরুলিয়ার দিগন্ত বিস্তৃত পটভূমি, যা ভুবনডাঙার মাঠের মতো লার্জার দ্যান লাইফকে স্মরণ করায় ৷ 'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান' হোক কিংবা 'স্বপ্নের দিন', অথবা 'লাল দরজা'- ক্যামেরা ব্যবহারেও বাংলা সিনেমায় বিপ্লব আনেন বুদ্ধদেব ৷ অনেকের মতো যা কবিতার কাছাকাছি ৷ স্বাভাবিক, যেহেতু বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম কবিও বটে ৷ তার কাব্য়গ্রন্তের সংখ্যাও কম নয় ৷ তবে ছবি পরিচালনাই তাঁর জগৎজোড়া খ্যাতির কারণ ৷
আরও পডুন: প্রয়াত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
21টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি করার পাশপাশি তথ্যচিত্র ও দূরদর্শনের জন্যও একাধিক কাজ করেছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ৷ পেয়েছেন অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ৷ 'বাঘ বাহাদুর', 'চরাচর', 'লাল দরজা', 'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান', 'কালপুরুষ' পেয়েছে দেশের সেরা ছবির জাতীয় পুরস্কার ৷ 'উত্তরা' ও 'স্বপ্নের দিন'-এর জন্য পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ৷ সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার জিতেছে ছবি 'ফেরা' ৷ সেরা বাংলা ছবির সম্মান পেয়েছে 'দূরত্ব', 'ফেরা', 'তাহাদের কথা' ৷
ভেনিস, বার্লিন সহ বহু কুলীন চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মানিত হয়েছেন এই বরেণ্য বাঙালি পরিচালক ৷ পেয়েছেন অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার ৷ ভেনিসে সেরা পরিচালকের পুরস্কার সিলভার লায়ান পেয়েছেন ৷ এছাড়াও ভেনিসে গোল্ডেন লায়ান ও বার্লিনের গোল্ডেন বিয়ারের জন্য একাধিকবার মনোনীত হয়েছেন ৷ এর আগে এতখানি আন্তর্জাতিক খ্যাতি একমাত্র 'তাহাদের'ই ছিল ৷ বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মৃত্যুতে শেষ হল সেই বাঙালি-অহঙ্কারের অধ্যায় ৷