কলকাতা, 4 জুন: যে সব চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী COVID-19 রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, এ রাজ্যের সেই ফ্রন্টলাইন হেলথকেয়ার ওয়ার্কাররা কি আদৌ সুরক্ষিত? রাজ্যে COVID-19-এ প্রথম এক নার্সের মৃত্যু । এরপরই এমন প্রশ্ন তুলছে নার্সেস ইউনিটি নামের নার্সদের একটি সংগঠন । এই নার্সের মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগও উঠছে । একই সঙ্গে COVID-19 নির্ণয়ের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে একাধিক মহলে । কোরোনা আক্রান্ত ওই নার্সের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্তের দাবি জানিয়েছে সরকারি চিকিৎসকদের একটি সংগঠন ।
গত 1 জুন আর জি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ওই নার্সের মৃত্যু হয়েছে । মৃত্যুর পরে নার্সের সোয়াবের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া যায় । রিপোর্টে জানা যায়, ওই নার্স COVID-19 পজ়িটিভ ছিলেন । 55 বছর বয়সি ওই নার্স নৈহাটির বাসিন্দা ছিলেন । তিনি বারাসতে উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সদর হাসপাতালের সিস্টার ইনচার্জ ছিলেন । সূত্রের খবর, অসুস্থ হওয়ার পরেও নাইট ডিউটি করেছিলেন তিনি । নাইট ডিউটি শেষে বাড়ি ফেরার পরে তিনি প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হন । নার্সেস ইউনিটির তরফে জানানো হয়েছে, জ্বরের সঙ্গে শরীরে অসহ্য ব্যথা, পেটে যন্ত্রণা, বমি দেখা দেয়। এই অবস্থায় দু'টি হাসপাতাল ঘুরে অবশেষে নৈহাটির একটি COVID হাসপাতালে ওই নার্সকে ভরতি করানো সম্ভব হয়েছিল । ওই হাসপাতালে COVID-19 নির্ণয়ের জন্য দু'বার এই সিস্টার ইনচার্জের সোয়াবের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল । দু'বারই রিপোর্ট নেগেটিভ আসে । এ-দিকে তাঁর শারীরিক অবস্থারও ক্রমে অবনতি হতে থাকে । এই পরিস্থিতিতে তাঁকে আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয় । এই হাসপাতালে আবার তাঁর সোয়াবের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় । তবে ওই নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার আগেই 1 জুন ওই নার্সের মৃত্যু হয়।
এই নার্সের মৃত্যুর ঘটনায় নার্সেস ইউনিটির তরফে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, COVID-19 রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা কি আদৌ যথাযথ সুরক্ষা পাচ্ছেন? কোথাও বলা হচ্ছে, PPE কিট পরে 6 ঘন্টা ডিউটি করতে হবে, কোথাও বলা হচ্ছে PPE কিট পরে 12 ঘণ্টা ডিউটি করতে। রেল স্টেশনে পরিযায়ী শ্রমিকদের থার্মাল স্ক্রিনিংয়ের জন্য PPE কিট ছাড়া নার্সদের পাঠানো হচ্ছে। সেখান থেকে ডিউটি শেষে ফেরার পরে কোনও টেস্ট অথবা, কোয়ারানটিনে না পাঠিয়ে ফের জেনারেল ওয়ার্ডে ডিউটিতে পাঠানো হচ্ছে । এই অবস্থায়, চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী, তাঁদের পরিবার, রোগী এবং তাঁদের পরিজনদের, সবাইকে কি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে না ? COVID-19-এর মোকাবিলায় নার্সদের কি যেমন খুশি ব্যবহার করিয়ে নেওয়াই লক্ষ্য ? নার্সেস ইউনিটির তরফে জানানো হয়েছে, COVID-19-এর সংক্রমণের সঙ্গে ইমিউনিটি ক্ষমতার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে । অথচ, কলকাতার একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নার্সদের টানা সাতদিন নাইট ডিউটি দেওয়া হচ্ছে । কোনও প্রশ্ন করলে বদলির হুমকিও শুনতে হচ্ছে বলে অভিযোগ ।
নার্সেস ইউনিটির সম্পাদক বলেন, "বারাসত হাসপাতালের এই সিস্টার ইনচার্জ এ রাজ্যে প্রথম কোনও নার্স, যাঁর মৃত্যু হল COVID-19-এ । অসুস্থ হওয়ার পরে দু'টি হাসপাতাল ঘুরে অবশেষে নৈহাটির একটি COVID হাসপাতালে তাঁকে ভরতি নেওয়া হয়েছিল । হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব নিল না কেন, তা হলে তাঁর চিকিৎসার জন্য জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যেত না । দু'বার সোয়াবের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছিল । এই সিস্টার ইনচার্জের মৃত্যুর পরে, তৃতীয় বার নেওয়া তাঁর সোয়াবের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পজ়িটিভ আসে । এক্ষেত্রে আগের নমুনাগুলির পরীক্ষার বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে ।"
পাশাপাশি এই সিস্টার ইনচার্জের মৃত্যুর ঘটনায় গাফিলতির জন্য প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও মনে করছেন নার্সেস ইউনিটির সম্পাদক । তিনি বলেন, "COVID-19-এর মোকাবিলায় স্বাস্থ্য দপ্তর নাজেহাল । তবে যাঁদের গাফিলতিতে এই সিস্টার ইনচার্জের জীবনহানি ঘটল, সেখানে নিশ্চয়ই কোনও প্রশাসনিক পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাব।"
এই ঘটনায় রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয়কুমার চক্রবর্তীর বক্তব্য জানতে চেয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, তবে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এই সিস্টার ইনচার্জের মৃত্যুর ঘটনায় এ রাজ্যের সরকারি চিকিৎসকদের একটি সংগঠন সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক, চিকিৎসক সজল বিশ্বাস বলেন, "COVID-19-এর যুদ্ধে এ রাজ্যে প্রথম এক নার্সের মৃত্যুর ঘটনায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত। পর পর দু'বার তাঁর সোয়াবের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টে নেগেটিভ পাওয়া গিয়েছিল । তৃতীয়বার পরীক্ষায় তাঁর রিপোর্ট পজিটিভ আসে। COVID-19 নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সোয়াবের নমুনা পরীক্ষা নিয়ে এই ধরনের ছিনিমিনি খেলার আমরা তীব্র নিন্দা করছি। পরীক্ষার মান যে কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, তা এই সিস্টার ইনচার্জের বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট থেকে বোঝা যাচ্ছে। আমরা এই ঘটনায় উচ্চপর্যায়ের তদন্ত এবং ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছি।"